আন্তর্জাতিক মানবিক আইন
১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণ
বেসামরিক জনগণের অধিকার সংক্রান্ত ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন
(THE FOURTH GENEVA CONVENTION OF 1949 AND PROTECTION OF CIVILIAN PERSONS IN TIME OF WAR)
১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধের সময় বেসামরিক ব্যক্তিদের সংরক্ষণের বিধান রেখেছে৷ এই কনভেনশন যুদ্ধ সংক্রান্ত আইন এবং দখলকৃত এলাকার যুদ্ধ বিষয়ক নিয়মসংক্রান্ত ১৯০৭ সালের গেহ কনভেনশনের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত বিধানাবলীর সম্পুরক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে৷ বেসামরিক ব্যক্তির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে এখানে বলা হয়েছে যে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নয় এমন যে কোন ব্যক্তিই বেসামরিক ব্যক্তি বলে বিবেচিত (প্রটোকল-১, অনুচ্ছেদ-৫০)৷ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪ অনুচ্ছেদে সংরক্ষিত ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "Persons protected by the Convetion are those who...find themselves, in the case of a conflict or occupation, in the hands of a party to the conflict or Occupaing Power of which they are not nationals."
অত্র কনভেনশনের তৃতীয় ভাগে বেসামরিক ব্যক্তিদের মর্যাদা ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিধানবলী বর্ণিত হয়েছে৷ এই কনভেনশনের ১১৫টি অনুচ্ছেদকে ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়৷ যথা:
(ক) যুদ্ধমান এলাকায় এবং দখলকৃত এলাকায় প্রযোজ্য সাধারণ বিধিমালা (Provision Common to the Territories of the Parties to the Conflict and to Occupied Territories): ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংরক্ষিত ব্যক্তিরা যে কোন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী এবং সর্বস্থানেই তাদের ব্যক্তিত্ব, সম্মান, পারিবারিক ও ধর্মীয় অধিকারসহ অন্যান্য সকল অধিকার ভোগের সুযোগ থাকবে৷ তারা যে কোন পরিস্থিতিতে মানবিক সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হবে এবং ভীতি প্রদর্শন, আক্রমণ ও জনকৌতুহলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী হবে৷ মহিলাদেরকে ধর্ষণ, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি গ্রহণ বা অন্য কোন অশালীন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করানো যাবে না এবং তাদের ব্যক্তিগত মর্যাদা সংরক্ষণ করতে হবে৷৷ ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সমস্ত ব্যক্তির উপস্থিতিতে কোন সামরিক কার্য পরিচালনা করা যাবে না৷ সংরক্ষিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিধান করে ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অনুরূপ ব্যক্তিদের সংরক্ষণ করার৷ আটককারী কর্তৃপক্ষ এবং ত্রাণ সংগঠনগুলি উক্ত ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণ করবে (অনুচ্ছেদ-৩০)৷ ৩১ অনুচ্ছেদের বিধান বিধান অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের জন্য সংরক্ষিত ব্যক্তিদের কোনরূপ শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা যাবে না৷ সংরক্ষিত ব্যক্তিদের কোন ক্রমেই এমন শাস্তি প্রদান করা যাবে না যাতে তাদের অহেতুক ভোগান্তির সৃষ্টি হয় যেমন - মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা, শারীরিক শাস্তি, অনুচ্ছেদ অথবা কোন চিকিত্সা বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যাহা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নয় (অনুচ্ছেদ-৩২)৷ আবার ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংরক্ষিত ব্যক্তিরা যে সমস্ত অপরাধ তারা নিজেরা করে নাই, এরূপ কোন অপরাধের জন্য তাদের যৌথ শাস্তি দেয়া যাবে না৷ একই কারণে তাদের যৌথ শাস্তি দেয়া যাবে না কিংবা তাদের সম্পত্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা ভয়ভীতি প্রদর্শন বা সন্ত্রাসী পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না৷ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যও বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না৷ ৩৪ অনুচ্ছেদে চূড়ান্তভাবে জিম্মি রাখাকে সাধারণ ও মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
(খ) যুদ্ধমান এলাকার বিদেশী ব্যক্তিবর্গ (Aliens in the territories of parties to the conflict) : চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনে বিদেশী ব্যক্তি বর্গের সংরক্ষনের বিধান রয়েছে৷ কনভেনশনের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংরক্ষিত বিদেশী ব্যক্তিদের শক্রপক্ষের জাতীয় এলাকা ত্যাগ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দখলকারী কর্তৃপক্ষের রাষ্টীয় স্বার্থের পরিপন্থী না হলে বিদেশীরা আটককৃত এলাকা ত্যাগ করতে পারবে৷ আটকারী কর্তৃপক্ষ যদি এরূপ ব্যক্তিদের এলাকা ত্যাগ করার অনুমতি না দেয় তাহলে বিষয়টি পূর্নবিবেচনার জন্য তারা এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত বা প্রশাসনিক বোর্ডের নিকট আবেদন করতে পারবে৷ সংরক্ষিত ব্যক্তি যারা এলাকা ত্যাগ করবে না, তাদের কতকগুলি মৌলিক অধিকার থাকবে, যেমন ত্রাণ গ্রহণ, ধর্মচর্চা ইত্যাদি (অনুচ্ছেদ-৩৮)৷ ৩ঌ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংরক্ষিত ব্যক্তিবর্গের আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকবে৷ একইভাবে রাষ্ট্র তাদের এবং তাদের অধীনস্থদের আতপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিশ্চিত করতে বাধ্য৷ ৪০ অনুচ্ছেদ ঘোষণা করেছে যে, সংরক্ষিত ব্যক্তিদের দ্বারা কেবলমাত্র সেই সমস্ত কাজ করানো যাবে না একান্তভাবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, পরিবহন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য কিন্তু সরাসরি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোন কাজ তাদের দ্বারা করানো যাবে না৷ পূর্ণ নিরাপত্তার জন্য যা প্রয়োজন যুদ্ধমান কোন পক্ষ যদি সেরূপ নিরাপত্তার বিধান করতে পারে, তাহলে সংরক্ষিত ব্যক্তিদের তার নিজস্ব এলাকায় বা নির্দিষ্ট বাসস্থানে অন্তরীন রাখা যাবে না৷ পক্ষান্তরে একজন সংরক্ষিত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় অন্তরীনে থাকার দাবী করতে পারে [অনুচ্ছেদ-৪১, ৪২]৷
(গ) দখলকৃত এলাকা (Occupied territories) : চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন দখলকৃত এলাকার নিরাপত্তার বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে৷ কনভেনশনের ৪৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, দখলকৃত এলাকায় কোন অবস্থাতেই সংরক্ষিত ব্যক্তিদের কনভেনশনে বর্ণিত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না৷ ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একক বা সমষ্টিগতভাবে সংরক্ষিত ব্যক্তিদেরকে স্থানান্তর এবং দখলকৃত এলাকা থেকে অন্য কোন রাষ্ট্রে নির্বাসন দেয়া যাবে না, তবে সামরিক কারণে যদি তাদের স্থানান্তর আবশ্যক হয়ে পড়ে, তাহলে অনুরূপ ক্ষেত্রে স্থানান্তর করা যাবে৷ ৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল শিশুদের যত্ন এবং শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে৷ দখলকারী রাষ্ট্রের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রয়োজনে সংরক্ষিত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকায় কাজ করানো যাবে এবং কোন সামরিক উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য কোন কাজ করানো যাবে না৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেবলমাত্র ১৮ বছরের উর্ধ্বের ব্যক্তিদের দ্বারাই অনুরূপ কাজ করানো যাবে (অনুচ্ছেদ-৫১)৷
দখলকৃত এলাকার সরকারী কর্মকর্তা এবং বিচারকগণ তাদের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে এবং ঐ সময় দখলকারী কর্তৃপক্ষ তাদের মর্যাদার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না কিংবা বলপ্রয়োগ করে কোন কাজ করতে বাধ্য করতে পারবে না৷ দখলকারী কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে তাদেরকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করতে পারবে (অনুচ্ছেদ-৫৪)৷
৫৯-৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অপর্যাপ্ত ত্রাণ সাহায্যের ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্র ও নিরপেক্ষ মানবিক সংস্থার মাধ্যমে যৌথ ত্রানকর্মসূচী পরিচালনার বিধান করা হয়েছে৷ ৬২ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী দখলকৃত এলাকার বেসামরিক ব্যক্তিগত যৌথ সাহায্য ব্যতীত তাদের নিকট প্রেরিত ব্যক্তিগত সাহায্য গ্রহণ করতে পারবে৷ জাতীয় রেডক্রস বা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি আহত, পীড়িত জাহাজডুবীদের সাহায্য করতে পারবে এবং দখলকৃত এলাকায় ত্রাণ কর্মসূচী পরিচালনা করতে পারবে (অনুচ্ছেদ-৬৩)৷ ৬৪-৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দখলকারী কর্তৃপক্ষ দখলকৃত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ ৬৭ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী দখলকারী কর্তৃপক্ষের আদালতে ফৌজদারী বিচার প্রশাসনের মান নির্ধারিত হয়েছে৷ কোন ব্যক্তিকে অন্তরীন রাখা সাধারণ কারাবাসের চেয়ে বড় শাস্তি৷ কেবলমাত্র যে ব্যক্তি দখলকারী কর্তৃপক্ষের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করবে, তাকেই অনুরূপ শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া যাবে৷ (অনুচ্ছেদ-৬৮)৷
(ঘ) অন্তরীন ব্যক্তি বর্গের প্রতি ব্যবহার (Regulations for the treatment of Internees) : চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৭৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দীদের সংরক্ষণের যে বিধান রয়েছে, ঠিক তেমনি সংরক্ষণ বিধি অন্তরীণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে৷
(ঙ) তথ্য ব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় ট্রেসিং এজেন্সী (Information Bureau and central Trachin Agency) : চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন একটি জাতীয় তথ্য ব্যুরো এবং একটি কেন্দ্রীয় এজেন্সী প্রতিষ্ঠা এবং উহার কার্যাবলী সম্পর্কে বিধান রেখেছে৷ ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেন্ট্রাল এজেন্সী পরবর্তীকালে সেন্ট্রাল ট্রেসিং এজেন্সীতে রূপান্তরিত হয়েছে, যাহা রেডক্রস কর্তৃক সুসংগঠিত ও পরিচালিত হয়৷ এই এজেন্সী বেসামরিক ব্যক্তি এবং যুদ্ধবন্দী উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর৷
১৯৭৭ সালের অতিরিক্ত প্রটোকল-১ দ্বারা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের উন্নয়ন:
১৯৭৭ সালে গৃহীত অতিরিক্ত প্রটোকল-১ এ বেসামরিক লোকদের সংরক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট সংরক্ষণ বিধি সংযোজনের মাধ্যমে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে৷ এই প্রটোকলের ৭৫ অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায় যে, বেসামরিক লোকদের সংরক্ষণের জন্য ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ইহা নিজেই নিজেকে একটি মিনি কনভেনশনে পরিণত করেছে৷ যুদ্ধমান পক্ষের অধীনে আটক বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখানে মৌলিক নিশ্চয়তার বিধান করা হয়েছে এবং মৌলিক নিশ্চয়তা স্বরূপ নিম্নলিখিত কার্যাবলী সকল পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে :
(ক) জীবন, স্বাস্থ্য এবং মানুষের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণের প্রতি আক্রমণ বিশেষ করে হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, দৈহিক শাস্তি, অঙ্গচ্ছেদ ইত্যাদি;
(খ) ব্যক্তিগত মর্যাদার উপর আঘাত, বিশেষ করে নিন্দনীয় এবং অবমাননাকর আচরণ, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি গ্রহণ এবং যে কোন প্রকার অশালীন আচরণ;
(গ) জিম্মি করে রাখা;
(ঘ) যৌথ শাস্তি;
(ঙ) পূর্বোক্ত যে কোন কাজ করার হুমকি৷
১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন বেসামরিব লোকদের সংরক্ষণের জন্য যে ব্যবস্থা করেছে তা বিপদকালীন সময়ে মানুষের অধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে৷