তরুণদের তৈরি হতে ঠেকাচ্ছে কী?
‘আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট। আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছি; সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১ জুলাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান ছিল। তারই একটিতে গিয়েছি, ব্যবসা অনুষদের মিলনায়তনে। অনুষ্ঠান শেষে অর্গানাইজেশনাল স্ট্র্যাটেজিক লিডারশিপ বিভাগের এক অধ্যাপকের কাছে এই ঘটনা শুনেছি। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করা এক তরুণ তাঁরই পরামর্শে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। উন্নতিও হয়, বিদেশে প্রশিক্ষণও হয়। নিয়োগদাতারাও খুশি। কিন্তু দুই বছর পর এক সকালবেলায় তরুণটি তাঁকে এসে জানান, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অধ্যাপক মশাই অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, গার্মেন্টসে চাকরি করা তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পছন্দ করছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস ইনস্টিটিউট থেকে ডিগ্রি নিয়ে ‘তাঁদের জামাই’ কেন গার্মেন্টসে চাকরি করবেন!
ঘটনাটি আমার কাছে নতুন নয়। কর্মক্ষেত্র, সম্ভাবনা এবং নতুন যুগের আহ্বান আমরা আমাদের সমাজে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারিনি। ফলে, শ্রমের বিভাজন, চাকরির স্তরায়ণ আমাদের তরুণদের স্বপ্নকে তাই কয়েকটি মাত্র সেক্টরেই আবদ্ধ করে দিয়েছে। আর সেই ফাঁকে অন্য দেশের তরুণেরা এসে দখল করে নিচ্ছে আমাদের কর্মক্ষেত্র।
এবারের বাজেট বক্তৃতায় খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের তরুণদের কর্মদক্ষতা ও কর্মকুশলতার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশিরা এসে আমাদের কর্মক্ষেত্র জাঁকিয়ে বসছে। প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষ্ঠানে একজন সরকারি কর্মকর্তা বললেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেখানে গড়ে দুই হাজার ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান, সেখানে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা বছরে গড়ে ২০ হাজার ডলার নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন!
এ অবস্থা তো এক দিনে তৈরি হয়নি। এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের পছন্দের কর্মক্ষেত্র হয়ে রয়েছে হাতে গোনা সরকারি চাকরি, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানি এবং কিছু বৃহদাকার এনজিও। অথচ কেবল আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ৪০ লাখের বেশি কর্মীর জন্য কতজন তত্ত্বাবধায়ক ও ম্যানেজার দরকার? তাঁদের দেখভালের জন্য কতজন মিডল ম্যানেজার ও জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক দরকার? সেই সংখ্যা কি আমরা তাদের বলছি? আমাদের মিডিয়াগুলো কেবল গার্মেন্টসের কর্মীদের কথা বলে থাকে। সেখানকার নির্বাহী, ডিজাইনার, বিপণন কিংবা ব্র্যান্ডিং কর্মীর কথা কি কখনো বলে? ফলে, আমার তরুণের স্বপ্নে কখনো দোলা দেয় না, তিনি একটা গার্মেন্টসের শীর্ষ নির্বাহী হবেন, তাঁর ব্র্যান্ডিং ক্ষমতা কোনো গার্মেন্টস গ্রুপের পণ্যকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরবে?
সমাজে আরও খারাপ অবস্থা হয় উদ্যোক্তাদের। শুরুর দিকে লেখা তরুণটি তাও ‘শ্বশুরবাড়ি’ জোগাড় করতে পেরেছেন। কিন্তু আমি এমন একজন উদ্যোক্তার কথা জানি, যিনি ২৪ জন প্রকৌশলীর চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বেচারা ‘শ্বশুরবাড়ি’ জোগাড় করতে পারছেন না, কারণ ‘পাত্র চাকরি করেন না’। এ থেকে আমরা বের হব কেমন করে?
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যত ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। না, সেখানে কোনো উদ্যোক্তার নাম নেই। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ পদক দেওয়ার জন্য এখনো কোনো উদ্যোক্তাকে বাছাই করতে পারিনি। এমনকি যাঁর হাত ধরে আমাদের শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টসের সূচনা, যাঁর উদ্ভাবিত ‘ব্যাক-টু-ব্যাক’ এলসির কথা এখন বিশ্ববাসী জানে, সেই মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী নুরুল কাদেরকেও আমরা এ পদক দিতে পারিনি। আমরা কথায় কথায় বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলি। এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সমাবর্তন বক্তা নির্বাচন করার সময় সিলিকন ভ্যালির দিকে তাকায়, ওয়ালস্ট্রিটে খোঁজ নেয়। খুঁজে ফেরে এমন উদ্যোক্তাদের, যাঁদের কারও কারও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতরণি পার হওয়ার সনদ নেই। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাবর্তন বক্তা খোঁজার জন্য এমনকি পাড়ি জমায় দেশের বাইরে, দেশের ভেতরে তাকায় না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তনে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে সমাবর্তন বক্তা করা ছাড়া আমি দেশীয় উদ্যোক্তাদের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে—এমন উদাহরণ তো সবিশেষ দেখি না!
এসবের ফলাফল: আমাদের ৪৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী চাকরি জোগাড় করতে পারেন না, প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি লোক কর্মহীন। কিন্তু অর্থনীতি বড় হচ্ছে, হবেই। ২০২৩ সাল নাগাদ প্রতিবছর গড়ে এক লাখ মিড ও সিনিয়র স্তরের ম্যানেজারের দরকার হবে। যেভাবে এগোচ্ছি, তাতে ২০ হাজারের বেশি আমরা বানাতে পারব কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু অফিসগুলো কি বসে থাকবে? থাকবে না। আরও আরও লোক আসবে বাইরে থেকে। আর আমরা ক্রমাগত শ্রমিক জাতিতে পরিণত হব। অথচ এ প্রশ্নের উত্তর তো আমাদের জানাই আছে। বড় কোম্পানিগুলোর মিড ও সিনিয়র লেবেলের কর্মীদের সরবরাহ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেগুলোর জন্য আমরা কী করি। এ দেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পাওয়া সহজ, কিন্তু মাত্র ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার জন্য হাজার হাজার তরুণ তাঁদের উদ্যোগকে বড় করতে পারেন না।
এ ধারা থেকে বের হওয়ার বুদ্ধি কী? ডাক দিতে হবে এখন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন কিংবা চাকরি খুঁজছেন তাঁদের। তাঁদের বলতে হবে চাকরিদাতারা কী খোঁজেন? কেমন করে তিনি তাঁর নিজের একটা কিছু হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। তাঁদের সামনে সবকিছু খোলাসা করে জানাতে হবে, যাতে তিনি বুঝতে পারেন ঘাটতি কোথায়। নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কী করা দরকার।
পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, যে মেয়েটি ফেসবুকে একটি পেজ খুলে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান চালান, তাঁকে বিজনেস লাইসেন্স দেওয়ার সময় ‘তোমার দোকান কোথায়? কত নম্বর বাড়িতে’—এ প্রশ্ন করা যাবে না। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম এবারের বাজেটে ভার্চুয়াল বিজনেসের স্বীকৃতি দেখে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটিগুলো এখনো তাদের ট্রেড লাইসেন্স নীতিমালায় বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। সামান্য সদিচ্ছা থাকলে এই পরিবর্তনের জন্য বেশি সময় লাগার কথা নয়।
ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবে আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তরুণদের কথা শুনছি। তাঁদের সামনে তুলে ধরছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের শুরুর ক্ষণে নতুন এক জগতের কথা। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু এলাকা ঘুরে এসেছি। ২৯ ও ৩০ জুলাই এবং আগামী ১ আগস্ট আমরা যাচ্ছি যথাক্রমে রংপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায়। হাজারো তরুণকে জানিয়ে দিতে চাই, দেশের ১৬ কোটি লোক তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্ঞান, সাহস ও দক্ষতাকে পুঁজি করে নেমে পড়ো পথে।
মুনির হাসান: যুব কর্মসূচি সমন্বয়কারী, প্রথম আলো।