রোড অব লাইফ: লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো এক রাস্তার কথা

Author Topic: রোড অব লাইফ: লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো এক রাস্তার কথা  (Read 949 times)

Offline provakar_2109

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 124
  • Test
    • View Profile
আটশোরও বেশি দিন ধরে সামরিকভাবে অবরুদ্ধ এক শহর। খাদ্য নেই, তীব্র শীতে চারদিকে মারা পড়ছে মানুষ। জনবহুল সেই শহরের ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণের প্রদীপ ইতোমধ্যেই নিভে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাদ শহরকে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠিক এভাবেই অচল করে দিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী। ১৯৪১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর লেলিনগ্রাদকে সরাসরি আক্রমণ না করে চারদিক থেকে যতটা পারা যায় অবরোধের সিদ্ধান্ত নেয় হিটলার বাহিনী। তবে শহরের বাইরে চলতে থাকে খণ্ডযুদ্ধ।

১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ শহরের তেল আর কয়লা সরবরাহে টান পড়ে যায়। শীত যত সামনে এগুতে থাকে, বাসিন্দারা ততই সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। শহরের কেন্দ্রীয় তাপ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পানির পাইপে বরফ জমে সারা শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই।

সামর্থ্যের শেষটুকু পর্যন্ত লড়ে গেছে লেলিনগ্রাদের মানুষ। কিন্তু ক্রমেই চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে অনাহার আর তীব্র শীতের সাথে যুদ্ধ করে নাৎসিদের কাছে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ছিল তারা। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সব ধরনের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় দিনের পর দিন ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। প্রত্যকের রাষ্ট্রীয় খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ দাঁড়ায় এক তৃতীয়াংশে।

১৯৪১ এর ভয়াবহ সেই শীতের দিনে খাবার হিসেবে শহর কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের সরবরাহ করতো ১২৫ গ্রামের একটি পাউরুটি। এই পাউরুটি বানানো হতো গাছের ছাল, বাকল, পাতা আর সামান্য ময়দা দিয়ে। ব্যাপারটি হয়তো আজকের দিনে চিন্তাও করা যাবে না, এই বিচ্ছিরি স্বাদের রুটির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো শহরের বাসিন্দারা।

অনাহারে আর অর্ধাহারে ১৯৪১ সালের নভেম্বর নাগাদ প্রায় এগারো হাজার মানুষের মৃত্যু রেকর্ড করে সোভিয়েত প্রশাসন। ডিসেম্বর নাগাদ সেই সংখ্যা দাঁড়ায় অর্ধলক্ষে। শিশু আর বৃদ্ধদের বেশিরভাগই মারা যাচ্ছিল খাবারের অভাবে। তীব্র ঠাণ্ডা, চারদিকে বরফের রাজ্য, রাস্তা, পার্ক কিংবা খোলা মাঠে ছড়িয়ে আছে মানুষের লাশ।

তীব্র শীতের সেই দিনগুলোতে মৃত লাশের মাংস খেয়েও বেঁচে ছিলেন কেউ কেউ।[1] সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ NKVD ২১০৫ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে আটক করে।[1] কিন্তু আটক করে কী হবে? জেলখানাগুলোতে আর জায়গা নেই। কর্তৃপক্ষও খাবার দিতে পারছে না কয়েদিদের। জার্মান বাহিনীর গোলাবারুদের আক্রমণও বাড়ছে প্রতিদিন।

লেলিনগ্রাদের পতন ঠেকাতে অবরোধ ভেঙ্গে অস্ত্র গোলাবারুদ পাঠানো তখন একান্তই জরুরী হয়ে পড়ে। এর জন্য নাৎসি অবরোধ ডিঙ্গিয়ে নির্মাণ করতে হবে বিকল্প কোনো রাস্তা। কিন্তু তা শুধুমাত্র সম্ভব লেলিনগ্রাদকে ঘিরে থাকা লাদোগা হ্রদের উপর রাস্তা কিংবা রেলপথ নির্মাণ করতে পারলে। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ এই হ্রদের ভঙ্গুর বরফের চাইয়ের উপর রেলপথ নির্মাণ অসম্ভব প্রায়। তাই নির্মাণ করতে হবে সড়কপথ। লেনিনগ্রাদের লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে এই রাস্তার বিকল্প নেই।

বরফের উপর রাস্তা নির্মাণে রাশিয়ানদের ধারেকাছে কোনো জাতি নেই। কিন্তু এবার চ্যালেঞ্জটা একটু বেশিই। বরফের নীচে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি, উপরে হিটলার বাহিনীর বিমান, যেকোনো সময় একটিমাত্র বোমা নস্যাৎ করে দেবে পুরো রাস্তা। তবে এই ভয়ে বসে থাকলে তো আর চলবে না।

১৯৪১ সালের তিন নভেম্বর, লেনিনগ্রাদ মিলিটারি কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেকোনো মূল্যে লাদোগা হ্রদের উপর ২০ থেকে ত্রিশ মাইল দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। তীব্র শীতে হ্রদের পুরো বরফকে কাজে লাগিয়ে শহর থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। এই সড়কের নাম দেওয়া হয় Military Road No. 101, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এই রাস্তা হয়ে উঠে জীবনের রাস্তা। লেনিনগ্রাদের মানুষ এই রাস্তার নাম দেয় 'রোড অব লাইফ'।

১৯৪১ সালের উনিশ নভেম্বর রোড অব লাইফ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু হয়। খাদ্য আর মিলিটারি সরঞ্জাম বোঝাই ভারী ভারী ট্রাক চলতে শুরু করে সে রাস্তায়।
কিন্তু ভঙ্গুর বরফ আর ক্ষণে ক্ষণে বিমান থেকে ধেয়ে আসা বোমা এই রাস্তাকে অকার্যকর করে দেয়। বারবার রাস্তা পরিবর্তন করতে হয়। বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যেতেও ব্যবহার করা হয় এই রাস্তা। ভারী ট্রাক আর সামরিক গাড়ির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তাদের ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নিরাপদ গন্তব্যের খোঁজে।

ফলে এই রাস্তায় তৈরি হয় ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের দীর্ঘ লাইন। সাধারণ মানুষেরাই এই সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নারীদের অনেকেই সেনাবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ায়। এমনকি নারী ট্রাক চালকও নিয়োগ দেওয়া হয় শহরের অভ্যন্তরে মালামাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য।কিন্তু বরফের চাইয়ের উপর একসাথে অনেক গাড়ি কিংবা ঘোড়া উঠতে না পারায় গতি মন্থর হয়ে গিয়েছিল অনেক।

তাই লাদোগা হ্রদের বিকল্প আরো কয়েকটি রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। তাই হ্রদের বিভিন্ন জায়গায় বরফের পুরুত্ব পরীক্ষা করে পরিসংখ্যান তৈরি করে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আবহাওয়া অধিদপ্তর। যে জায়গাগুলোতে বরফ বেশি পুরো সেইদিক দিয়ে বিকল্প রাস্তা নির্মাণ শুরু করা হয়।লেনিনগ্রাদের মানুষের তখন দরকার খাদ্য, পানীয়, কেরোসিনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রায় এক হাজার টনের সাপ্লাই।

রোড অব লাইফের নির্ঘুম সড়কে প্রতিনিয়ত ৬০০ থেকে ৭০০ টন সাপ্লাই আসতে থাকে। টানা গাড়ি চালিয়ে ড্রাইভাররা শিকার হতে থাকেন একের পর এক দুর্ঘটনার। ধু ধু বরফের রাজ্যে, একটি সাধারণ দুর্ঘটনাও হয়ে উঠে প্রাণঘাতী। এই রোড অব লাইফ শুধু সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কাজেই ব্যবহার হচ্ছিল না, পাশাপাশি জার্মান বাহিনীকে পালটা আক্রমণেও এই রাস্তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। তাই সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে রাস্তার স্থলভাগে রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছিল।

৮৭২ দিনের জার্মান অবরোধে দশ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই চরম ঠাণ্ডায় খাদ্যের অভাবে মৃতুবরণ করেছিল। লাদোগা হ্রদের উপরে নির্মিত এই রোড অব লাইফ প্রাণ বাঁচিয়েছে প্রায় পনেরো লক্ষাধিক লোকের। ১৫ মিলিয়ন টন খাদ্য লেনিনগ্রাদবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এই রাস্তার কল্যাণে।

সোভিয়েত সেনাদেরকেও যুদ্ধে সামরিকভাবে সহায়তা করেছে এই রাস্তা। সময়ের কালোস্রোত পাড়ি দিয়ে এখনো এর অংশবিশেষ দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো দিনগুলোর স্মৃতি হিসেবে।

Offline Mizanur Rahman (GED)

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 216
  • Change in a person leads to a change in a nation
    • View Profile
Mizanur Rahman
Lecturer of Mathematics
Department of General Educational Development
Faculty of Science and Information Technology
Daffodil International University
Parmanent Campus