এই শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফুট বেড়ে বাংলাদেশের ১৭% স্থলভাগ পানির নিচে চলে যাবে। সম্ভবনা আছে উচ্চতা ৫ ফুট বৃদ্ধিরও। সেক্ষেত্রে ঢাকাও চলে যাবে সমুদ্রের নিচে
ইউরোপীয় দেশগুলোতে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ, ক্যারোলিনায় হ্যারিকেন ফ্লোরেন্স আর ফিলিপাইনে টাইফুন মাংখুটের তান্ডব দেখে খুব সহজে অনুমান করা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আগে কখনই এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের দেয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে কীভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্র ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো যেতে পারে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের প্রভাবে ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা সতর্কতা দিয়েছেন তাপমাত্রা আর ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বীপরাষ্ট্রগুলো বিলীন হয়ে যাবে। পাশাপাশি তলিয়ে যাবে স্থলভাগের নিম্নাঞ্চলের বড় একটি অংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ঘুরে ইংরেজি গণমাধ্যম ডেইলি মেইলে গবেষণাধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন পিটার ওবর্ন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানও আশঙ্কাজনক জানিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনে আমি নৌকায় করে ঘুরেছি। সেখানকার মৎস্যজীবীরা আমাকে বললো তাদের ঘরগুলোর মাঁচার উপরে করতে হচ্ছে, কেননা পানির উচ্চতা আগের তুলনায় বেড়েছে। আর স্রোতের পানিতে তাদের ফসলও নষ্ট হয়ে গেছে।”
বঙ্গোপসাগরের থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গবুরা নামক স্থানে আরও কিছু বিদেশি নাগরিকদের দেখা পান তিনি। তাদের চারপাশে ছোটখাটো জটলাও তৈরি করে স্থানীয়রা। তাদেরই একজন মোহাম্মাদ আরাজাদ বলেন, “আবহাওয়া বদলে গেছে। এলাকার গাছ গাছড়া বাড়ছে না। কিছু একটা গাছগুলোর মাথার দিকে নষ্ট করে ফেলছে।”
তিনি যোগ করেন, “আমি যখন যুবক বয়সী ছিলাম তখন ছয়টা ঋতুর উপস্থিতি ছিল। এখন শুধু তিনটি অনুভব করতে পারি_ গ্রীষ্ম, শীত আর বর্ষা। ঢেউ আগের চেয়ে উঁচু হয়েছে। আমার বয়স যখন কম ছিল, তার থেকে প্রায় ১ বা ২ ফিট উচ্চতা বেড়েছে ঢেউয়ের।”
আরাজাদের আরেক প্রতিবেশী সারা বানু বললেন, “আগের চেয়ে এখন সাইক্লোনের প্রবণতা বেড়েছে। আগে মেঘগুলো পানির মতো স্বচ্ছ ছিল দেখতে, আর এখন কেমন যেন ধোয়ার মতো রঙ।”
তাদের সাথে কথা বলে পিটার জেনেছেন, ঢাকনা ছাড়া পাত্রে খাবার পানি রাখলে কিছুক্ষণ পর বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে অনেক বেশি লবনাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এই পানি খেতে হচ্ছে নিরুপায় হয়ে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে অসুখ। গ্রামে অধিকাংশ মানুষ উচ্চরক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন, বেড়েছে হৃদরোগ। কমবয়সে মৃত্যু ঘটছে। চোখের সমস্যা বেড়েছে, চর্মরোগ-ডায়েরিয়া-কলেরা তো মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। নারীদের অনেকেই যোনিতে তীব্র ব্যথার সমস্যায় ভুগছেন।
বিস্মিত পিটার লিখেছেন, “গবুরার মানুষকে নিরাপদ পানির জন্য প্রায় ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, যা দুই দশক আগে ছিল ১০০ গজ দূরেই। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সেই পানি সংগ্রহ করেন তারা। “মিঠা পানি”র জন্য তাদের প্রতিদিনই কোনো না কোনো গন্ডগোলের মধ্যে পড়তে হয়।” বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা স্বাদ আছে বলেন তিনি। এ স্বাদটা লবণের!
বাঘের আক্রমণের শিকার থেকে বেঁচে ফেরা এক জেলে তাকে জানান যে, নদীগুলো প্রতিনিয়ত ভাঙছে, আরও লবনাক্ত হচ্ছে। মিঠাপানির মাছের অনেকগুলো প্রজাতিই হারিয়ে গেছে।
এই গ্রামসহ আশেপাশের সব গ্রামগুলোতেই ধান চাষ, সবজি চাষ আর গবাদি পশুপালন করা হতো, যা কিনা পানির লবণাক্ততার কারণে আর সম্ভব হচ্ছে না, জানালেন অনা রাণী নামে মাগুরা কুনী গ্রামের এক নারী। তিনি পিটারকে জানালেন, “এমনকি গাছের খেজুর আর ডাবের পানিও নোনতা হয়ে গেছে।”
আলোচনায় পিটার জানতে পারেন, এ এলাকায় নোনা পানি বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ও গবাদিপশু পালন বাদ দিয়ে অনেকেই চিংড়ী চাষ শুরু করেন। কিন্তু পানি এতোটাই নোনা যে চিংড়ী চাষের জন্যও তা অনুপযুক্ত। আর চিংড়ীর ঘেরের কারণে আশেপাশের জমিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে চাষাবাদের আরও অযোগ্য হয়ে যায় বলে, সেখান থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন স্থানীয়রা।
লবণের মাত্রারিক্ততার কারণে এখানকার মাটির বুনটও দুর্বল হয়ে গেছে। মাটির বাড়ির দেয়ালগুলো সবসময় নজরদারীর ভেতর রাখতে হয়। অতিরিক্ত কাঠ বা বাঁশের যোগাড় দিতে হয়। এতে করে প্রতিদিনের কাজ বেড়ে গেছে স্থানীয়দের। এসব তথ্য পিটারকে জানান অনা রাণী।
ধানখালির নাসিরউদ্দিন মোড়ল (৬৫) পায়ে হেটে নদী পাড়ি দিয়ে ওপাড় থেকে পাকা কলা এনে খেতেন। কিন্তু, এখন ওপারে কলা গাছের কোনো অস্তিত্বই নেই। এ পরিবর্তন তিনি দেখেছেন তার জীবদ্দশায়।
একজন গ্রামবাসী পিটার ওবর্নকে জানান এই উচ্চতাপমাত্রার প্রভাবে এখানকার শিশুদের শৈশবকালের স্থায়ীত্ব কমেছে। “অল্পবয়সেই কিশোর-কিশোরীরা শারিরীকভাবে পরিণত ও প্রজননক্ষম হয়ে যাচ্ছে।”
এখানকার জীবন সংগ্রামে হার মেনে অনেকেই কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছেন রাজধানী শহরে। সেখানে পরিবার নিয়ে থাকছেন বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। কাজ হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছেন রিকশা চালনা আর গার্মেন্টসকে। তারা বিশ্বের প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট “শরণার্থী”। আগামী বছরগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। কিন্তু সে তুলনায় জায়গা নেই এই শহরেও। স্বাধীনতার সময়ের ৭ কোটি জনসংখ্যা ইতোমধ্যেই বেড়ে ১৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের তকমা পেয়ে গেছে।
পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে আসাটা কষ্টের হলেও তারা তা করতে বাধ্য হচ্ছেন। দুই সন্তানের জননী সেলিনা পিটারকে কথা প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা জানিনা অন্য কোথাও কি করে থাকবো। আমরা এই প্রকৃতিকে বুঝি। কিন্তু, ঢাকায় কি করে টিকে থাকবো তা জানিনা। এখানে থাকতে হলে আমাদের প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করতে হবে।”
তবে বিজ্ঞানীদের করা লন্ডনের “জুয়োলোজিকাল সোসাইটি”র এক গবেষণার ফলাফল বিচারে সেলিনাকে সান্তনা দেয়ার কোনো অযুহাত খুঁজে পাননি পিটার। এ গবেষণায় উঠে এসেছে, সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূল প্রতি বছর প্রায় ২০০গজ করে এগিয়ে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফুট বেড়ে বাংলাদেশের ১৭% স্থলভাগ পানির নিচে চলে যাবে। সম্ভবনা আছে উচ্চতা ৫ ফুট বৃদ্ধিরও। সেক্ষেত্রে ঢাকাও চলে যাবে সমুদ্রের নিচে।