নিরাপদ সড়ক সবার দাবি (দৈনিক কালের কণ্ঠ, তারিখ: ১২ আগস্ট, ২০১৮; পৃ.১৫)
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
নিরাপদ সড়কের দাবিতে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন অনেক আগে থেকেই আন্দোলন করে আসছেন। দেশের আপামর জনসাধারণও নিরাপদ সড়কের দাবিতে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে দুর্ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনার ফলে প্রতিনিয়ত আহত-নিহত হচ্ছে দেশের অসংখ্য মানুষ এবং দেশের সার্বিক যোগাযোগ ও উন্নতি-অগ্রগতির ক্ষেত্রেও এসব দুর্ঘটনা মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান অনেক সম্পদ। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিসহ নানা দাবিতে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে গত ৩০ জুলাই বাস উঠিয়ে দিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা ও কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হওয়ার প্রতিবাদে এ আন্দোলন এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে আসছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের কারণে কয়েক দিন ধরে রাজধানী ঢাকা একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ২ আগস্ট দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের সচেতন মানুষমাত্রই দেখে থাকবেন যে ঢাকা শহরের মধ্যে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে যাত্রী ওঠানামার ক্ষেত্রে এক ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলে। এ ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতার করুণ পরিণতি শুধু ঢাকার কুর্মিটোলার বিমানবন্দরের সড়কেই প্রথম নয়, বরং এ ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুটি বাসের চাপায় তরুণের হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং পরিণামে করুণ মৃত্যুর ঘটনাও দেশবাসী এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের গণপরিবহন খাতে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার না থাকা এবং চুক্তিভিত্তিক ড্রাইভারের হাতে মালিকপক্ষ কর্তৃক বাস ছেড়ে দেওয়ার জন্যই মূলত দেশের বিভিন্ন সড়কে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা যেন কিছুতেই ফলপ্রসূ হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবরাখবর। দেশে প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চললেও এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঘটে চলেছে হতাহতের ঘটনা। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর এ দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এতে প্রায় সমানসংখ্যক মানুষ মারা যায়। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে মনে হয়, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদে চলার পথ না হয়ে তা দিন দিন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন যাত্রা করা মানেই যেন নিজের জীবন বাজি রাখা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলোকে কোনোভাবেই এ দেশের জনগণের কপালের লিখন বলা যাবে না, বরং তা একপ্রকার হত্যাকাণ্ড। সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন, ড্রাইভারদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ড্রাইভারদের ওভারটেকিংয়ের মানসিকতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব (যেমন—১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার ড্রাইভারকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে), জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন না মানা প্রভৃতি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য; আর ড্রাইভারদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তা যদি অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করা হয়, তাহলে যে আগামী দিনেও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সড়ক দুর্ঘটনারোধকল্পে প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া বাস চালানো বন্ধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া বাস থামতে পারবে না, এটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং, আন্ডারপাস ও ফ্লাইওভারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এসবের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোও নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র ভয়াবহ। অদক্ষ ড্রাইভার কর্তৃক গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিয়ে, ট্রাফিক আইন না মেনে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য কোনো কঠিন বিষয় নয়। এ জন্য দরকার সরকার ও জগগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। রাস্তার ওপর ফুটপাতে দোকানপাট স্থাপনসহ ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হকারদের ব্যবসা করার ‘সুযোগ’ করে দেওয়া, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে ড্রাইভারদের হতে হবে দক্ষ ও সতর্ক। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য। মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ ড্রাইভারদের ‘ওভারটেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা বা শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। সর্বোপরি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুধীসমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে ও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদের পরিবর্তে হয়ে উঠবে নিরাপদে চলার পথ হিসেবে, যা সবারই একান্ত কাম্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
Link:
http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2018/08/12/668576