আবাসিক হলের খাবার মেধা বিকাশে কতটা সহায়ক?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
দৈনিক কালের কণ্ঠ (২৭ নভেম্বর, ২০১৮)
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪২টি পাবলিক ও ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, দুই হাজার ৩০০ কলেজ ও ইনস্টিটিউট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এককভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলোয় অধ্যয়ন করছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। আর এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলোয় কিংবা মেসে থেকে তাঁদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আবাসিক হলের ডাইনিং ও মেসে শিক্ষার্থীদের যে খাবার দেওয়া হয় তা মেধা বিকাশে কতটুকু সহায়ক? একজন পুরুষ শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের জন্য প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ কিলো ক্যালরি এবং নারী শিক্ষার্থীর জন্য এক হাজার ৯০০ কিলো ক্যালরি খাবার প্রয়োজন। আদর্শ খাদ্য তালিকা ‘চার্ট ইজ রিকোমেন্ডেড বাই দ্য নিউট্রিশন এক্সপার্ট গ্রুপ’ অনুযায়ী প্রতিদিনের খাবারের মধ্যে মাংস ৬০ গ্রাম, মাছ ৬০ গ্রাম, তেল ৪০ গ্রাম, ডাল ৭০ গ্রাম, শাক ১০০ গ্রাম, ফল ৬০ গ্রাম এবং দুধ ৬০০ গ্রাম থাকা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের লক্ষ্যে আবাসিক হল বা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে পরিবেশিত খাবারের এ মান নির্ণয় করা জরুরি।
পুষ্টিবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, খাবারের এ মান নিয়ন্ত্রণ করা না হলে কিংবা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় উপরোক্ত খাদ্যমান না থাকলে তা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে যথেষ্ট নয় বলে বিবেচিত হবে। এসব হল বা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে প্রতিনিয়ত যে ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয়, তা কি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক? নিশ্চয়ই না। বিভিন্ন আবাসিক হল বা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে খাবারের ব্যাপারে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দুপুরে খাবার হিসেবে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের চালের ভাত, ছোট এক টুকরা মাছ বা ছোট এক বা দুই টুকরা মাংস আর এর সঙ্গে পানির মতো পাতলা ডাল দেওয়া হয়। রাতেও ঠিক একই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। আর সকালের নাশতা হিসেবে দেওয়া হয় এক-দুটি রুটি বা পরোটা এবং এর সঙ্গে যৎসামান্য ডাল। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন আবাসিক হল বা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে প্রতিদিন যেসব খাবার দেওয়া হয়, তা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক নয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ডাইনিংগুলোয় খাবারের নিম্নমান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা আর সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিমানহীন খাবার খেতে হচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা এই যে ডাইনিংয়ের খাবারের যে অবস্থা তা দিয়ে মেধা ভালোভাবে বিকাশ হওয়া তো দূরের কথা, জীবন বাঁচানোই অনেকটা দায় হয়ে যায়। তবে এর মাঝেও যেসব শিক্ষার্থী ডাইনিংয়ের খাবার খেয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন এবং রাখছেন, তাঁদের অতি মেধাবীই বলতে হবে। ডাইনিংয়ে বারবার খাবারের দাম বাড়ানো হলেও খাবারের মান বিন্দুমাত্র বাড়ে না, বরং তা কমে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ডাইনিং-সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুদৃষ্টির অভাব আর পুষ্টিমানহীন খাবারের কারণে দেশের অনেক শিক্ষার্থীই আজ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা যে মেধা ও স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন, কিছুদিন যেতে না যেতেই তাঁদের অনেকের সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে অবস্থানরত আবাসিক শিক্ষার্থীর অনেককেই হল বা হোস্টেলে সিট পাওয়ার আগে প্রথম দুই-তিন বছর ভাড়া বাসায় থাকতে হয় বা হয়েছে। তাঁরা প্রথম দুই-তিন বছর বাসাবাড়িতে বা মেসে থেকে তুলনামূলক ভালো ফল করলেও পরবর্তীকালে হলে বা হোস্টেলে সিট পাওয়ার পর তাঁরা আর আগের মতো ফল ধরে রাখতে পারেননি। ডাইনিংয়ের পুষ্টিমানহীন খাবার এ জন্য অন্যতম প্রধান কারণ বলে ওই গবেষণায় বলা হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসে শিক্ষার্থীদের যত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, খাবারের সমস্যা তার অন্যতম। দুঃখের বিষয় এই যে ডাইনিংয়ের খাবারের মান নির্ণয় করা তো দূরের কথা, শিক্ষার্থীরা কী খাচ্ছেন তা দেখতে বছরান্তেও কোনো আবাসিক শিক্ষক বা হল প্রাধ্যক্ষ হলের ডাইনিংয়ে উঁকি পর্যন্ত দিতে আসেন না। অনেকে এ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টিকে দায়ী করলেও বলা যায়, শুধু বাজারমূল্যই পুষ্টিহীন খাবারের প্রধান কারণ হতে পারে না। ডাইনিংয়ের খাবারের পরিবর্তে হোটেলে খেতে গেলে তাঁদের দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা গুনতে হয়, অতিরিক্ত সময় নষ্ট করতে হয়। শিক্ষার্থীরা খাবারের মান বৃদ্ধির ব্যাপারে বারবার দাবি জানিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় না—যেন এ বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। বলা বাহুল্য, পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার মেধা বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আর শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ভালোভাবে না ঘটলে তা দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতির কারণ, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই পূরণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের লক্ষ্যে ডাইনিংগুলোয় পরিবেশিত খাবারের মান নির্ণয় করা অত্যাবশ্যক। আর এ কাজটি শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর কল্যাণেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনীহা বা গাফিলতি করা মোটেও উচিত হবে না। কারণ, এ কাজটি যত দ্রুত করা সম্ভব হবে ততই তা শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। অনেক সময় দেখা যায়, ডাইনিংয়ের নিম্নমানের খাবারের হাত থেকে বাঁচতে অনেক শিক্ষার্থী কক্ষে হিটার ব্যবহার করে রান্না করে খান। এ কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে প্রতি মাসে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ গুনতে হয়। অথচ ডাইনিংয়ের খাবারের বিষয়ে যদি সঠিকভাবে তদারকি করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে পারতেন, অন্যদিকে বিদ্যুৎ খরচও সাশ্রয় হতো। ডাইনিংয়ের খাবারের এ সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ শিক্ষার্থীরা একযোগে এগিয়ে এসে তা দ্রুত সমাধান করতে যথেষ্ট আন্তরিক হবেন, এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com
Link:
http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2018/11/27/708003