ফরমিন আক্তারের সঙ্গে প্রথম যখন আমার দেখা হয়, তখন সে হেলেন কিলারকে নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছিল। এখন তার বয়স ১৮। তার সঙ্গে যখন আলাপ করছি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের বাঁশের ছাউনিতে একটি প্লাস্টিকের টুলে সে বসেছিল।
চারপাশের লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো সে পরিবারকে নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের পর সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। ফরমিন আক্তার ও তার পরিবারও তাদের মধ্যে আছে।
হেলেন কিলারকে নিয়ে কথা বলতে উৎসুক হয়ে উঠল ফরমিন। বধির ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এ মার্কিন লেখককে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছে সে।
এ ছাড়া পাকিস্তানি শিক্ষা অধিকারকর্মী নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজায়ীকে নিয়েও তার বেশ আগ্রহ।
সবচেয়ে কম বয়সী নোবেলজয়ী মালালা তার আরেক নায়ক।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া বসতবাড়িতে ফরমিনের পাঠ্যবইও ধ্বংস হয়ে যায়। সেসব বই নিয়েও আলোচনা পাড়তে চাইল এ রোহিঙ্গা তরুণী।
তার ইচ্ছা একদিন সে একজন আইনজীবী হবে। শুধু তা-ই নয়, বঞ্চিত রোহিঙ্গা নারীদের শিক্ষার অধিকার নিয়েও কাজ করতে আগ্রহী সে।
প্রতিবেদন তৈরি করতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বছরখানেক ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। সেই সময় ফরমিনের বয়সী কিশোরীদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। তাদের অনেকেই যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে নারীদের রান্নার পাত্রে আগুন চড়াতে দেখা যায়। কেউ কেউ শিশুদের নিয়ে হাঁটছে, দোল দিচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত একটি জাতি হিসেবে এসব নারী নিরক্ষর। শিক্ষার আলো তাদের কাছে পৌঁছেনি।
তবে তাদের অল্পসংখ্যক লোক মিয়ানমারে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা বার্মিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে ফরমিনের মতো কাউকে চোখে পড়েনি। কথা বলার সময় তার থেমে থেমে ফিকফিকে হাসি, কখনও কখনও লজ্জায় মুখ লুকিয়ে কথা বলছিল সে।
কিন্তু এত এত কথার মধ্যে বই ও শিক্ষার প্রতি তার গভীর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। রাষ্ট্রহীন এ তরুণী শিক্ষার মূল্যবোধ নিয়ে ছিল দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মিয়ানমারে সে নৃশংসতা দেখেছে, কিন্তু আদর্শিক জীবন নিয়ে তার সিদ্ধান্ত অনড়।
রয়টার্সের মিয়ানমার ব্যুরোপ্রধান অ্যান্টোনিও স্লোডকাউসকি ও আমি তাৎক্ষণিকভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে উৎসুক হয়ে উঠি। সে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী বলেছে। পরে কয়েক মাসে যখন উল্লেখ করার মতো অনেক কিছু জেনেছি।
দরিদ্র রাখাইন রাজ্যের এক বিচ্ছিন্ন গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। রোহিঙ্গাদের যে অল্প কয়েকজন নিজেরা ইংরেজি শিখতে পেরেছে, তাদের একজন ফরমিন।
যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরের মধ্যে সে কাউন্সেল করায়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সক্ষম বলে যে ২৫ রোহিঙ্গা কিশোরীকে শনাক্ত করা হয়েছে, সেই তালিকায় ফরমিনও আছে।
তার পরবর্তী গল্প মেলাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। এর পর তার চাচাকে খুঁজে বের করলাম, যিনি শরণার্থী হিসেবে নরওয়ে পালিয়ে গেছেন।
কক্সবাজারের বিস্তৃত রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আমি তার কয়েকজন শিক্ষককে খুঁজে পেলাম। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যার কাছ থেকে ফরমিন প্রথম মালালার কথা শুনেছেন।
২০১৭ সালে ফরমিনের স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা ১৫০ কিশোরী সম্পর্কে আমি জানতে পারলাম। সে বছর পাস করা চারজনের মধ্যে সে একজন ছিল। স্কুলের প্রায় সবাই তার সম্পর্কে জানতেন। তার ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
পরিবার ও বন্ধুরা ফরমিনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও দৃঢ়প্রতিশ্রুতি নিয়ে বলার পাশাপাশি তার বড় বোন নূরজাহানের গল্পও করছিলেন। দুই বোন শৈশবে একসঙ্গে কলেজে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু নূরজাহানকে তার পরিবার বিয়ে দিয়ে দেয়।
নূরজাহানের সঙ্গে কথা বলার সময় তার স্বামী পাশেই ছিলেন। আর তাঁবুর ফাঁক গলিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের আলাপ শুনছিলেন।
একসঙ্গে কলেজে যেতে ফরমিন ও তাদের প্রতিজ্ঞার গল্প শুনছিলাম তখন। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই নূরজাহান কেঁদে ফেলেন। তার দুচোখ পানিতে ভরে যায়। আর আশ্রয়শিবিরের তাঁবুরও ওপর তখন টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। ওড়নার পার দিয়ে নূরজাহান চোখ মুছে ফের কথা শুরু করেন।
কথা বলার মাস কয়েক পার হতেই দেখি অন্যরকম এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠছে ফরমিন। ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে জিন্স ও স্কার্ফ পরে কলেজে যায় সে। ক্যাম্পাসে যখন সে আমার দিকে এগোচ্ছিল, বন্ধুরা তখন তার দিকে হাত নাড়ছিল। তাদের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীও রয়েছে। যাদের কাছ থেকে ফরমিন ফারসি শিখেছে।
ইতিমধ্যে সে কারাতে ও গিটার বাজাতে শিখেছে। এক ইন্দো-মার্কিন শিক্ষকের কাছ থেকে তার এসব শেখা।
কিন্তু তার কিছু অভ্যাস আগের মতোই রয়ে গেছে। গ্রন্থাগারে সে আমাকে তার পছন্দের বইগুলো দেখিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শার্লট ব্রন্টির জেন ইয়ার। শৈশবে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও কথা বলে ফরমিন।
রয়টার্সে ফরমিনের পরিচয় প্রকাশের পরই লিংকসহ মালালা ইউসুফজাই টুইটারে সেটি শেয়ার দেন। এতে রোমাঞ্চিত বোধ করে ফরমিন। মিয়ানমারে স্কুলে বসে শিক্ষকের মুখে মালালার গল্প শোনার কথা স্মরণ করে সে। ভাবতেই পারছে না, মালালা এখন তার গল্প পড়ছেন, যা তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
ফরমিন বার্তা পাঠিয়ে আমাকে জানায়, এ ঘটনায় সে যে কতটা আন্দন্দিত, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
‘আপনি জানেন, তাকে (মালালা) আমি ভালোবাসি।’
ফরমিন জানায়, সেমিস্টার পরীক্ষার ফাঁকে শরণার্থী শিবিরে দাতব্য সংস্থাগুলোর জন্য সে কিছু তরজমার কাজ করবে। এর আগে কাজ করে এক বছরে সে যে কয়টা পয়সা জমিয়েছিল, তা নূরজাহানের বিয়েতে খরচ হয়ে গেছে।
রয়টার্সে প্রকাশিত জেবা সিদ্দিকীর প্রতিবেদনের তরজমা