মদপানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না :
রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।*৮*
মদ্যপের ৪০ দিনের ছালাত কবুল হয় না :
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহ’লে জাহান্নামে যাবে। যদি তওবাহ করে তাহ’লে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার নেশাদার দ্রব্য পান করলে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহ’লে জাহান্নামে যাবে। আর যদি তওবাহ করে তবে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার যদি নেশাদার দ্রব্য পান করে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। এ অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে যাবে। তওবাহ করলে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। লোকটি যদি চতুর্থবার মদ পান করে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন ‘রাদাগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছা.)! ‘রাদাগাতে খাবাল’ কী? রাসূলুল্লাহ (ছা.) বললেন, ‘আগুনের তাপে জাহান্নামীদের শরীর হ’তে গলে পড়া রক্তপূজ মিশ্রিত গরম তরল পদার্থ’।*৯*
মদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর অভিসম্পাত :
মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর লোকের প্রতি রাসূল (ছা.) অভিশাপ করেছেন। (১) যে লোক মদের নির্যাস বের করে (২) প্রস্তুতকারক (৩) মদপানকারী (৪) যে পান করায় (৫) মদের আমদানীকারক (৬) যার জন্য আমদানী করা হয় (৭) বিক্রেতা (৮) ক্রেতা (৯) সরবরাহকারী এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী’।*১০*
ক্বিয়ামতের পূর্বে মদের ব্যাপকতা :
ক্বিয়ামতের পূর্বে মাদকতা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে মদ পানকারীরা তা পান করাকে অপরাধ মনে করবে না। হাদীছে এসেছে,
আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছা.)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘ক্বিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠে যাবে, মূর্খতা, ব্যভিচার ও মদ্যপান বেড়ে যাবে। পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন মহিলার পরিচালক হবে একজন পুরুষ’।*১১* শুধু তাই নয়; শেষ যামানায় মানুষ মদকে বিভিন্ন নামের ছদ্মাবরণে পান করবে বলে রাসূলুল্লাহ (ছা.) আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।*১২*
মাদকের কুফল :
যেকোন প্রকার মাদকদ্রব্য যা নেশা সৃষ্টি করে, সুস্থ মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটায় এবং জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয়, তা হারাম বা নিষিদ্ধ, চাই তা প্রাকৃতিক হোক যেমন- মদ, তাড়ি, আফিম, গাঁজা, চরস, হাশিশ, মারিজুয়ান ইত্যাদি অথবা রাসায়নিক হোক যেমন- হেরোইন, মরফিন, কোকেন, প্যাথেড্রিন ইত্যাদি। মাদক মানুষের শরীরে বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করে থাকে। নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি বিনষ্ট হয়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়, শারীরিক ক্ষমতা লোপ পায়। আবার এমন অনেক মাদকদ্রব্য আছে, যা সম্পূর্ণরূপে কিডনী বিনষ্ট করে দেয়। মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে ফেলে, যেটা কোন চিকিৎসার মাধ্যমেই সারানো সম্ভব নয়। মাদক সেবনের ফলে লিভার সিরোসিস রোগের সৃষ্টি হয়, যার চিকিৎসা দুরূহ।
প্রতিকার :
১. ইচ্ছাশক্তি : মাদক বর্জনের জন্য মাদকগ্রহণকারীর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রামাযান মাস মুসলমানদের মাদক বর্জনের উপযুক্ত সময়। সারাদিন মাদক ছাড়া থাকতে পারলে রাতটুকুও থাকা সম্ভব। এভাবে এক মাস অভ্যাস করলে মাদক ত্যাগ করা সহজ হবে।
২. ইসলামের শিক্ষা : ইসলামের শিক্ষা ও বিধি-বিধান পুরোপুরি মেনে চললে মাদক বর্জন করা সহজ হবে।
৩. সামাজিক প্রতিরোধ : মাদক নিবারণের জন্য সমাজ ও স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। মাদক গ্রহণ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা উচিত। সমাজপতিগণ নিজেরা মাদকমুক্ত থেকে এবং তাদের প্রভাব খাটিয়ে মাদক প্রতিরোধ করতে পারেন।
৪. মাদকমুক্ত এলাকা গড়ে তোলা : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস, আদালত প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মাদক বর্জন করা প্রয়োজন।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে। যাতে ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ পালনে তারা আগ্রহী হয়। সাথে সাথে মহান আল্লাহ্র প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা তৈরী করতে হবে। যাতে আল্লাহ পাকের প্রতিটি কথা পালন করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। মাদক গ্রহণের ক্ষতিকর বিষয় সম্বন্ধে শারীরিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিকগুলো তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকের ক্ষতি ও অপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত হলে এই বদাভ্যাস ত্যাগ করা ও এর প্রতি ঘৃণা জন্মানো সহজ হবে।
৬. চিকিৎসকদের উদ্যোগ : মাদক প্রতিরোধে চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন এবং জনগণকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবগত করে তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
৭. আলেমগণের ভূমিকা : মসজিদের ইমামসহ সমাজের আলেমগণ ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকের অপকারিতা সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করতে পারেন এবং মদ্যপায়ীদেরকে ছালাতের দিকে আহবান করে ন্যায়ের পথ দেখাতে হবে। যাতে করে তারা অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ছালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’ {আনকাবূত ৪৫}। আর ছালাত আদায়ের প্রতি যদি কেউ বিনয়ী হয় তাহ’লে তাকে নেশাদ্রব্য অবশ্যই ছাড়তে হবে।
উপসংহার :
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ার কারণে মাদকের মারাত্মক ক্ষতি সর্বজন স্বীকৃত। ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতা মদ, নারী ও সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বিশ্বে এ সভ্যতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর পূর্বেই সমাজকে সুসভ্য করার জন্য মাদক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
ইসলাম মানবতার রক্ষাকবচ। ইসলাম মানুষকে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে। ইসলাম মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে হেফাযতের জন্য মাদক বিরোধী আইন রচনা করেছে। একটি সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য সুস্থ মস্তিস্ক একান্তভাবেই কাম্য। মাদক মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা গোটা মানব সমাজের অকল্যাণ ও অমঙ্গল সাধিত হয়। আজ মাদকাসক্তি বিশ্ব মানবতার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি অসংখ্য পাপকার্য, অপরাধ ও অসামাজিক কর্মের মূল। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো লক্ষ্য করে এর প্রতিকারের জন্য বর্তমান বিশ্বে বহু দেশ ও জাতি এগিয়ে আসছে। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় মাদকতা থেকে বিরত থেকে মাদকমুক্ত আদর্শ সমাজ গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!!
*৮*. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৬, হাদীছ ছহীহ।
*৯*. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৭৩৮, হাদীছ ছহীহ।
*১০*. তিরমিযী, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/২৭৭।
*১১*. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/৫৪৩৭, ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘ক্বিয়ামতের আলামত’ অনুচ্ছেদ।
*১২*. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮৪, হাদীছ ছহীহ।