বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দুর্নীতির প্রভাব
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১, ৪ আশ্বিন ১৪১৮
দুর্নীতি শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ দুঃ+নীতি। এতেই বোঝা যায় এর মূল ভাব বা এর অর্থ কী। দুর্নীতি হলো এমন অবস্থা যেখানে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শ এবং নৈতিকতার অভাব বিদ্যমান। একটি দেশের অর্থনীতিতে দুর্নীতি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দুর্নীতির কারণে একদিকে অর্থনৈতিক কর্মকা বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে দেশের মানুষের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা পিছিয়ে পড়ে। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করার কথা থাকলেও বর্তমানে তারা এর দুর্নীতির সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, দুর্নীতি মুক্ত না হলে তারা এখানে অর্থায়ন করবে না।
স্বাধীনতার এত বছর পরও অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির প্রবল গতি সংক্রামিত হচ্ছে দেশের সর্বস্তরে। বন্যার মতো দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বাংলাদেশের সর্বত্র আজ দুর্নীতি দেখা দিয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক— সব জায়গায় রাজত্ব কায়েম করছে এ দুর্নীতি। দুর্নীতির গাঢ়ত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশে অনিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়ম। কোনো ধরনের অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে হয় না। সমাজ জীবনের শিরায় শিরায় দুর্নীতির কালো থাবা। দুর্নীতির এই থাবার প্রভাব উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বিশ্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা রিপোর্টেও। প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে ১৪২টি দেশের মধ্যে এদেশের অবস্থান ১০৭ থেকে একধাপ কমে ১০৮-এ নেমে এসেছে। রিপোর্টে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি ঝুঁকিকে সবচেয়ে বড় করে বিবেচনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। তিনটির পেছনেই রয়েছে দুর্নীতির অবদান। দেশের অবকাঠামো খাতের যে করুণ দশা তার পেছনে বড় কারণ দুর্নীতি। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রতিবছরই বড় আকারের বাজেট করা হচ্ছে। এমনকি তা ব্যয়ও করা হচ্ছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না। যে টাকা খরচ করা হচ্ছে তার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই চলে যায় রাজনীতিবিদ এবং ঠিকাদারদের পকেটে।
দেশের আর্থিক খাত নিয়ে যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনেও দুর্নীতি। আর্থিক খাতে যে শঙ্কা তা হলো ব্যাংকিং সেক্টর থেকে শিল্পের জন্য ঋণ প্রাপ্তির অভাব। ব্যাংকগুলো নিয়ম ভঙ্গ করে অতিরিক্ত পরিমাণে টাকা শেয়ারবাজারে খাটিয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অমান্য করে ঋণ-আমানত হার বজায় না রেখে অতিরিক্ত পরিমাণে বিভিন্ন খাতে ঋণ দিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে শিল্প খাতে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও অনিয়মই দায়ী। বর্তমান সময়ে শেয়ারবাজারে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। শেয়ারবাজারে অনেকেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে অনৈতিকভাবে টাকা তুলে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তদন্তের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে দেওয়ায় তিনি এখন চাপের মুখে রয়েছেন। অর্থাত্ সরকারিভাবে দুর্নীতিকেই বাহবা দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে। সবকিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা দুর্নীতি। এটা কখনও অবকাঠামো খাতের দুর্বলতার মাধ্যমে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। কখনও আর্থিক খাতের দুর্বলতার মাধ্যমে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
এ দেশের শিক্ষা খাতের সিংহভাগ অর্থ আসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে। শিক্ষা খাতে দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৯৪-৯৫ থেকে এডিবি শিক্ষা খাতে অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এ অর্থদান বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষা খাত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ২০০১ থেকে ২০০২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ঘোষণা করে। কোনো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে। দুর্নীতিতে শীর্ষ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে সে সময়ের বিরোধী দল খুশিতে আটখানা! আবার সেই বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন আবার আগের চেয়েও বেশি খারাপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা রিপোর্ট ২০১০-এ বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বড় ঝুঁকি হিসেবে দুর্নীতির অবস্থান যা ছিল ২০১০ সালে এসে তা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বড় ঝুঁকি হিসেবে দুর্নীতির অবস্থান ছিল তৃতীয়। ২০১০ সালে এসে দ্বিতীয় বড় ঝুঁকি হিসেবে ত িউঠে এসেছে।
বর্তমানে পরিস্থিতি হয়েছে ক্ষমাতাসীন ও প্রধান বিরোধী দল দুটি নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছোড়ি করলেও দুর্নীতির দিক থেকে কে কার চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকবে এমন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে দুর্নীতি প্রবল গতিতে সংক্রামিত হচ্ছে দেশের সর্বস্তরে। অফিস-আদালতে চলছে ঘুষ-দুর্নীতি, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি আর শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে বৈষম্য। প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি।
আন্তরিকতার অভাব, মানুষের প্রতি সহানুভূতির অভাব, স্বার্থ সাধনের জন্য ব্যাপক তত্পরতা এবং জনকল্যাণের প্রতি অনীহার কারণে দুর্নীতি আমাদের দেশে অক্টোপাসের মতো চেপে বসেছে। মানুষ শুধু নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত, দেশের জন্য বা মানুষের জন্য কোনো মায়া তাদের মধ্যে নেই।
দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশন নামে তথাকথিত স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের সাফাই গেয়ে যাচ্ছে। যে সময় যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের দুর্নীতি এ কমিশনের নজরে পড়ে না। বিরোধী দলের ছোট ছোট দুর্নীতি তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। অর্থাত্ দুর্নীতি দমন কমিশনেই চলছে বড় রকমের দুর্নীতি। এ যেন ভূত তাড়াবে যে সরিষা সেখানেই ভূত। দুর্নীতি দমনে এ ধরনের তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে গড়া আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে গেলেও দুর্নীতির দিক থেকে সব সময়ই সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি আমাদের সবার জন্যই লজ্জার এবং অমঙ্গলজনক। দুর্নীতি নামক বিষক্রিয়ায় এই দেশ আজ নীল। শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে নয়, এ দেশের প্রতি মায়া থেকে, এ দেশের মানুষের প্রতি মমতা থেকে এবং সততা ও নৈতিকতার জোরেই হয়তো দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা জাগিয়ে তুলে দেশের প্রতি মায়া ও মমতা তৈরি করতে পারলে হয়তো দুর্নীতির প্রকটতা কমিয়ে আনা যাবে।
লেখক : প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি