বাংলাদেশ-ইউরেশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা

Author Topic: বাংলাদেশ-ইউরেশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা  (Read 2738 times)

Offline alsafayat

  • Newbie
  • *
  • Posts: 22
  • Seeker of the Unknown
    • View Profile
    • Al Safayat
বাংলাদেশের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক  ইউএসএসআর) অসামান্য ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বোধগম্য কারণেই ক্রেমলিনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক আর সেভাবে টিকে থাকেনি। অন্যদিকে ১৯৯১-এর ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই অবশিষ্ট সম্পর্কটুকুও পরিবর্তনের চাপে পড়ে অনেকটাই গতি হারায়। তবে ১৯৯৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে রাশিয়ার সঙ্গে পুনরায় সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তা অন্য কতিপয় ইউরেশীয় দেশের সঙ্গেও সম্প্রসারিত হতে থাকে (সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্ট এই ১৫টি ইউরেশীয় দেশ হচ্ছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান ও রাশিয়া; যেগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেটস—সিআইএস)। কিন্তু প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে এ দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক যে হারে বিকশিত হতে পারত, বাস্তবে তা একেবারেই হয়নি।

প্রশ্ন হলো, এ সম্পর্ক জোরদার হওয়াটা জরুরি কিনা এবং জরুরি হলে সম্পর্কের সে ক্ষেত্রগুলো কী ও কেন? প্রথম কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে বিকশিত হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর হিস্যা আরো দ্রুত হারে ও অধিক পরিমাণে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, বিশেষত রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিসরে বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ এখন বছরে প্রায় ১৪ হাজার ৩১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩৮,৭১৫ মিলিয়ন ডলার আমদানির বিপরীতে রফতানির পরিমাণ মাত্র ২৪,৩৯৭ মিলিয়ন ডলার: ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব)। দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করতে হলে বা এটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইলে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা যেমন জরুরি, তেমনি বা তার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে বহুমুখীনতা আনা। অর্থাৎ শুধু তৈরি পোশাকের মতো একক পণ্যের ওপর বা মূলত ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর না করে নতুন পণ্য নিয়ে নতুন বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপ ও মার্কিন বাজারের চাহিদানুরূপ মান সংরক্ষণে আমাদের অপারগতা এবং দ্বিতীয় অসুবিধাটি হলো, রফতানির নতুন বাজার খুঁজে না পাওয়া। আর এ দুটি সমস্যারই একটি উত্তম সমাধান হচ্ছে, ইউরেশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা।

বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এমনকি স্থানীয় বাজারকে লক্ষ্য করে উৎপাদিত পণ্যেরও মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারণ এ বাজারেও আমদানীকৃত বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই স্থানীয় পণ্যকে টিকে থাকতে হচ্ছে। তবে রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে মানোন্নয়নের বিষয়টি আরো অধিক জরুরি। কিন্তু রাতারাতি যেহেতু সেটি সম্ভব নয়, সেহেতু এ পর্যন্ত উন্নীত মান নিয়েই আপাতভাবে আমরা যা করতে পারি, তা হচ্ছে ইউরেশীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় রফতানি বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো। কারণ সেসব দেশের বাজারে পণ্যমানের গুণগত চাহিদা এখনো ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের মতো অতটা উচ্চপর্যায়ের নয়। বাংলাদেশ তার পণ্যের বিদ্যমান গুণগত মান নিয়েই অনায়াসে ইউরেশীয় বাজারে প্রবেশের সক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত. এসব দেশ বর্তমানে অন্য যেসব দেশ থেকে যে মূল্যে পণ্য আমদানি করে, বাংলাদেশের পক্ষে তার চেয়ে অনেক কম মূল্যে সেখানে পণ্য রফতানি করা সম্ভব। ফলে ইউরেশীয় বাজারই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশী পণ্যের নতুন গন্তব্য। তদুপরি ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যেসব বাংলাদেশী পণ্যের তেমন একটা চাহিদা নেই, সেসব বহু পণ্যের চাহিদাও ইউরেশীয় দেশগুলোর বাজারে রয়েছে। ফলে ওই দেশগুলো শুধু বাংলাদেশী নতুন বাজার হিসেবে নয়, নতুন পণ্য বাজারজাতের সুযোগ হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সম্প্রতি ইউরেশীয় ইকোনমিক ইউনিয়নের (ইইইউ) নির্বাহী পরিষদ ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিশনের (ইইসি) সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এখানে স্পষ্টীকরণের জন্য জানাই, সিআইএভুক্ত ১৫টি দেশের মধ্যকার সবগুলো দেশই কিন্তু এখনো ইইইউর সদস্য নয়। কেবল রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তান—এ পাঁচ দেশ নিয়েই বর্তমানের ইইইউ; যার যাত্রা ২০১৫ সালে। অর্থাৎ সিআইএভুক্ত ১৫টি দেশের মধ্যে ১০টি এখনো উল্লিখিত সহযোগিতা চুক্তির বাইরে থেকে গেছে। এখানে তাই প্রস্তাব রাখতে চাই, ইইসির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের সিআইএভুক্ত অন্য ১০টি দেশের সঙ্গেও ক্রমান্বয়ে এবং যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে অনুরূপ বাণিজ্য সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কেননা বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক কারণে শেষোক্ত ১০টি দেশ এখনো ইইইউর সদস্য না হলেও দেশগুলোয় বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কোনো কোনো ইইইউ সদস্য দেশের চেয়েও অধিক সম্ভাবনাময়।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা হয়তো বলবেন, দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, সেখানকার বাণিজ্য সংগঠনগুলোও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সহযোগিতা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তদুপরি তাদের পণ্য সংগ্রহ ও বিতরণ নেটওয়ার্কও এখন পর্যন্ত আধুনিক বিশ্ববাজারের কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে এসব দেশের বাজারগুলো এখনো যথেষ্ট পরিচিত নয়। এসব দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েও বলব, এ দেশগুলোর উল্লিখিত দুর্বলতার আড়ালেই কিন্তু লুকিয়ে আছে বাংলাদেশী পণ্যের বিপুল রফতানি সম্ভাবনা। উল্লিখিত দুর্বলতাগুলোর কারণে বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশই এখন পর্যন্ত সেখানে তাদের পণ্যাদি নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেনি। আর এ অকর্ষিত সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ যদি সেখানে বাণিজ্য সম্প্রসারণে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে দেখা যাবে সে দেশগুলোই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশী পণ্যের অন্যতম ও অধিকতর লাভজনক গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোয় পণ্য রফতানির আরেকটি সুবিধা হলো, সেখানকার কোনো কোনো দেশের সামাজিক রীতিনীতি ও অর্থনৈতিক স্তর আমাদেরই মতো। ফলে আমরা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করি, তাদের বাজারের চাহিদাও অনেকটাই অনুরূপ। অতএব, এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক মামুলি পণ্যও সেখানে রফতানি করা সম্ভব। এমনকি কিছু কৃষিপণ্যও সেখানে রফতানি করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলি, সেখানে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ জনবল (বিশেষত আইটি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক) পাঠানোরও সুযোগ রয়েছে। তবে আর কোথায় কোথায় এসব সুবিধা রয়েছে, তা তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে।

পণ্যের গুণগত মান বিচারে বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে যে স্তরে অবস্থান করছে, তাতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজার দখল করা বা অধিকতর মুনাফা অর্জন—এর কোনোটিই হয়তো অত সহজ নয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সিআইএভুক্ত দেশগুলোর মতো মাঝারি মানের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে সেটাই বাংলাদেশের জন্য অধিকতর নিরাপদ ও কৌশলী অবস্থান হবে বলে মনে করি। আর সে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশী উৎপাদক ও রফতানিকারকদের উৎসাহ ও সহযোগিতাদানের লক্ষ্যে সরকার ওইসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে সহসাই ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং তা থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কাজটি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। ফলে কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদারের পাশাপাশি এরই মধ্যে এসব দেশের বাজার সম্ভাবনা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে আসল কথা হচ্ছে, চরম প্রতিযোগিতা এড়িয়ে কম ঝুঁকিতে অধিকতর মুনাফার সুযোগ খুঁজে পেতে চাইলে শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে ইইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রকৃত বাজার পরিস্থিতি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরই খুঁজে বের করতে হবে এবং আশা করা যায়, সে প্রক্রিয়ায় কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগোতে পারলে তাতে সফল না হতে পারার কোনো কারণ নেই। সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ইউরেশিয়াই হয়ে উঠুক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের নতুন অংশীদার, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: http://bonikbarta.net/bangla/news/2019-07-05/202062/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%87%E0%A6%89%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%A8%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE--/
Al Safayat
Administrative Officer, CDC, DIU
Cell: +8801991195579
www.safayat.info