মহাশূন্যে দেশের প্রথম স্যাটে-লাইট 'বঙ্গবন্ধু' উৎক্ষেপণের জন্য আমেরিকান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টার-ন্যাশনালকে (এসপিআই) চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেরেটি কমিশন (বিটিআরসি)। জানা যায়, এসপিআই 'স্যাটেলাইট যান বঙ্গবন্ধু' উৎক্ষেপণের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা জরিপ, স্যাটেলাইটের সেবাগুলোর বিপণন, প্রস্তাবিত স্যাটেলাইটের পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলকে প্রশিক্ষণ দেবে। এজন্য ওই প্রতিষ্ঠানের ২৫ জন বিজ্ঞানী কাজ করবে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেরও দুইজন বিজ্ঞানী অংশ নেবেন। সূত্রমতে, বিটিআরসি'র পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এক চিঠির মাধ্যমে এসপিআই'র চূড়ান্তকরণের বিষয়টি জানানো হয়েছে। এখন সরকারের পক্ষ থেকে সম্মতি পাওয়া মাত্র কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে ২ স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি কাঠামো তৈরি, গ্রাউন্ড স্টেশন ব্যবস্থাপনা, বাজার মূল্যায়ন, স্যাটেলাইট বাজারজাতকরণ এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব কর্মকা- সম্পন্ন করবে। সূত্র আরো জানায়, স্যাটেলাইট যানটি উৎক্ষেপণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) কাছ থেকে কক্ষপথের ১০৫ ডিগ্রি পূর্বে একটি সস্নট বরাদ্দ পেয়েছে বাংলাদেশ। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পটিতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের মহাকাশে নিজস্ব কোনো স্যাটেলাইট নেই। বাংলাদেশের আকাশ সীমানায় রাশিয়ার দুটি, চীন, জাপান ও মালয়েশিয়ার একটি করে স্যাটেলাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে মহাকাশের ৮৮ দশমিক ০৮ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে রাশিয়ার ইয়াম্মেল-১০২ ও ৯০ দশমিক ০০ ডিগ্রিতে ইয়াম্মেল-২০১, ৯০ দশমিক ০৭ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে জাপানের কোদমা ডিআরটিএস, ৯১ দশমিক শূন্য ০৪ ডিগ্রিপূর্ব দ্রাঘিমাংশে মালয়েশিয়ার সিমাট-৩ নামের স্যাটেলাইট রয়েছে। বিষুব রেখায় চীনেরও একটি স্যাটেলাইট কাজ করছে। তাদের কাছ থেকে ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ। এজন্য বিটিআরসি'র প্রতিবছর প্রায় ১১ থেকে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। শুধু তাই নয়; এর ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তাও চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানান, আকাশ উন্মুক্ত থাকায় অন্য দেশ বিষুব রেখার সুযোগ-সুবিধাগুলো দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট না থাকায় তারা এ সুযোগকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। বাংলাদেশে নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকলে উন্নত দেশগুলোর মতো যোগাযোগ সুযোগ-সুবিধা পেত। তাছাড়া বাংলাদেশের স্যাটেলাইট থাকলে পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ আরো কয়েকটি দেশে ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া দেয়া যাবে। সূত্র মতে, বিশ্বের ৪৫ দেশের মহাকাশে নিজস্ব স্পেস রয়েছে। তাদের আকাশে অন্য কোনো দেশের স্যাটেলাইট নেই। এদের মধ্যে ১১ দেশ নিজস্ব ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। এ ছাড়া ৫০টি মতো দেশ অন্য দেশের সহযোগিতায় স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। এসব দেশের শতাধিক স্যাটেলাইট বিষুব রেখা, মেরু বিন্দু বা ক্রান্তীয় অঞ্চল অথবা বিভিন্ন কৌণিক পথে পরিভ্রমণ করে যাচ্ছে। যোগাযোগ মাধ্যমের স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত বিষুব রেখার ওপর স্থাপন করা হয়। কক্ষপথের এ স্থানে স্যাটেলাইট স্থাপন করলে পরিচালন ব্যয় অনেক কম। তাই উন্নত দেশগুলো এ কক্ষে একটার পর একটা যোগাযোগ স্যাটেলাইট স্থাপন করে যাচ্ছে। বিটিআরসি'র মতে, বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়, পাহাড় এবং সিলেট ও চট্টগ্রামের দ্বীপগুলোসহ দেশের সব জেলা-উপজেলায় এখনো সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্ক পর্যাপ্ত নয়। এসব কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের আরো অনেক আগেই এ প্রকল্পটি নেয়া উচিত ছিল। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এসব প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে গতবছর মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইট নির্মাতা কোম্পানির কাছে প্রস্তাব আহ্বান করে। এতে আগ্রহী ৩০ কোম্পানি প্রস্তাব পাঠায়। এখান থেকে সাত কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত এসব কোম্পানির কাছে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল) চাওয়া হয়। গত ২৭ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির কাছে দাখিল করে। এতে আমেরিকার দুটি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া ও কানাডার একটি করে কোম্পানির প্রস্তাব বিটিআরসি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আমেরিকার স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের (এসপিআই) প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। অন্য চার কোম্পানি হলো- ফ্রান্সের 'সাউদার্ন অ্যারোস্পেস অ্যান্ড টেলিকম কনসালটিং (এসএটিসি), ইন্দোনেশিয়ার টেলিকমিউকাসি, ইন্দোনেশিয়া ইন্টারন্যাশনাল, আমেরিকার গ্লোবকম অ্যান্ড টেলি স্পেস ও কানাডার টেলিস্যাট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে অনেক লাভবান হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ সেবা নিরবচ্ছিন্ন থাকবে।