বর্তমান বিশ্বসভ্যতার দিকে তাকালে একটি প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে- মানুষ মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করতে ব্যর্থ কেন? তাহলে মানুষ কি এখন আর মানুষ নেই? এমনটি হলে তো সমাজে এত মানুষের বসবাস অর্থহীন হয়ে পড়ে। বর্তমান সভ্যতায় তো আমরা যৌক্তিক কারণেই আমেরিকা ও ইসরাইলের অনেক সমালোচনা করে থাকি, কিন্তু অন্যরা কেমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে? আমেরিকার বিপরীতে অনেকে চীনের পক্ষ থেকে আশাবাদী ভূমিকা আশা করে থাকেন। কিন্তু সেই আশাবাদে যেন পানি ঢেলে দিল চীন স্বয়ং। উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনের দমন-অবদমন ও নির্যাতনের কথা আমরা বহুদিন ধরেই শুনে আসছি, কিন্তু সম্প্রতি বিবিসি’র প্রতিবেদনে যে চিত্রটি তুলে ধরা হলো তা তো বেশ ভয়ংকর। এখন তো শুধু দমন-পীড়ন নয়, জাতিগত মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলার জন্য শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে এবং বড়দের আটকে রাখা হচ্ছে বন্দী শিবিরে। একটি দেশের নাগরিকদের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার তথা শিকড় ছিন্ন করার এই প্রয়াসকে কি সভ্য ও মানবিক আচরণ হিসেবে অভিহিত করা যায়?
চীনের বিপরীতে অনন্য উদাহরণ হওয়ার সুযোগ ছিল আমাদের প্রতিবেশী বড় দেশ ভারতের। দেশটির সাবেক নেতারা তেমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টির চেষ্টাও করেছিলেন। বহু ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার দেশটিতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ দর্শনকে তুলে ধরা হয়েছিল। তবে বিজেপির বর্তমান আমলে ওই দর্শনের বদলে ভারতকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দর্শনে পরিচালিত করার তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারী ঘরানার নেতা-কর্মীদের আচরণেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জনজীবনে এর প্রভাব লক্ষণীয়। গো-রক্ষা গোষ্ঠীর উগ্রতৎপরতা ও নাগরিক-পঞ্জির আতংকের মধ্যে এখন আবার যোগ হয়েছে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানের জবরদস্তি। বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন নোবেল জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেনও। গত ৫ জুলাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্মৃতিতে কলকাতা’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমি এর আগে কখনও এভাবে জয় শ্রী রাম শুনিনি। এখন মানুষকে মারধরে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই বলেই আমার ধারণা।’ অর্মত্য সেন আরও বলেন, ‘আজ যখন শুনি বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ ভীত-শঙ্কিত হয়ে রাস্তায় বের হন এই শহরে, তখন আমার গর্বের শহরকে চিনতে পারি না। এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার।’ বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘জয় শ্রী রাম, রাম-নবমী এসব কোনো কিছুর সঙ্গেই বাঙালির কোনও যোগ নেই। এখানে দুর্গাপূজো হয়।’ নতুন এই সংস্কৃতি আমদানির পেছনে বিভেদের রাজনীতি কাজ করছে বলেও ইঙ্গিত দেন নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ। তাঁর ভাষায়, ‘এক সময় হিন্দু মহাসভা এ ধরনের সংস্কৃতি আমদানির চেষ্টা করেছিল বাংলায়। বিভেদের রাজনীতির বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করেছিল। এখন বিজেপি ঠিক সেই একই উদ্দেশ্যে বাংলায় ‘জয় শ্রী রাম’ সংস্কৃতির আমদানি ঘটানোর চেষ্টা করছে।’ লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখন ভারতের রাস্তাঘাটে, এখানে-সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের তাদের ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই স্লোগান না দিলে তাদের প্রহার করা হচ্ছে। এমন স্লোগানের পেছনে বিভেদের রাজনীতি কাজ করছে বলে ইঙ্গিত দেন অর্মত্য সেন। যদি তাই হয়, তাহলে ভারতের বর্তমান শাসকরা ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ গড়বেন কী করে? এ পথে কি সম্ভব হবে মানবিক-ভারত বিনির্মাণ?