নারী নির্যাতন কমছে না কেন
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
যুগান্তর (১১ জানুয়ারি ২০২০)
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বস্তুত সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন।
দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে দুই-তিন বছরের কোমলমতি শিশু- কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও এ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এমন ঘটনা তো অহরহই ঘটানো হচ্ছে।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মানসম্মানের ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অনেক সময় এও দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ করা হচ্ছে কিংবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে।
একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ‘সমাজ’ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি, একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে।
আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পান না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ; যা প্রকৃতই উদ্বেগের বিষয়। শুধু তাই নয়, এটি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বলা বাহুল্য, কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না।
ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে সাধারণত দেখা যায়- ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ থাকে না। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায়। সুতরাং সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ।
৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কারণে ধর্ষণ হতে পারে।
তবে যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা হল- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড।
একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিু পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি।
ধর্ষকরা অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তী সময়ে তারা আবারও বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবারে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনোভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন, অগ্রগতির পাশাপাশি সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই ধর্ষণকে কঠোর হস্তে প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি এবং তা অপরিহার্য।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com
Link:
https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/265539/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8