খুব কষ্ট করে আমাকে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে
নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডে মেডিকেল প্রতিনিধি পদ দিয়ে পেশাজীবন শুরু, জি এম কামরুল হাসান এখন আবদুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু আইসক্রিম, ডেইরি ও ফুডের গ্রুপ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। দেশি-বিদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সিইওদের মধ্যে তিনি সুপরিচিত নাম।
এই উঠে আসাটা সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে টাকার অভাবে কখনো কখনো না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়েছেন, পেশাজীবনে বড় পদ ছেড়ে ছোট পদে যোগ দিয়েছেন, বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিতে নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে দেশি প্রতিষ্ঠানে মামলার মুখে পড়েছেন—সব মিলিয়ে কামরুল হাসানের পেশাজীবন বৈচিত্র্যময়।
কামরুল হাসান যে প্রতিষ্ঠানের সিইও, সেই ইগলুর কথা আগে জানিয়ে নিই। এটি দেশের আইসক্রিমের বাজারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান। বাজারে তাদের হিস্যা ৪০ শতাংশের মতো। চার বছরে ইগলুর ব্যবসা প্রায় দ্বিগুণ করেছেন কামরুল হাসান।
দেশি-বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠানের সিইও পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) শিক্ষার্থীদের আধিপত্য। অন্তত ব্যবসায় বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকলে পাত্তা পাওয়া কঠিন। সেখানে জি এম কামরুল হাসান পড়েছেন প্রাণরসায়ন বা বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সালেহা আক্তার ও আবদুল হামিদ দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে কামরুল হাসান সবার ছোট। যে বছর তাঁর জন্ম, সেই বছর (১৯৭০) পিতা খাদ্য বিভাগের চাকরি থেকে অবসর নেন। ফলে সবচেয়ে ছোট সন্তানের পড়াশোনা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সংগতি তাঁর ছিল না। কামরুল হাসান বলেন, ‘ভালো ছাত্র ছিলাম। সব সময় প্রথম হতাম। তাই স্কুল ও কলেজে বেতন লাগত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এক ভাই ও এক বোন মাসে মাসে কিছু টাকা দিত। তাই দিয়েই চলত।’
তবে সে টাকা নিতে তাঁর আত্মসম্মানে লাগত। নিজের খরচ নিজেই জোগাতে কখনো টিউশনি করেছেন। একসময় গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে রসায়নের একটি কোর্সের ৬০ জন শিক্ষার্থীর একটি ব্যাচকেও পড়িয়েছেন। কিছুদিন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন।
কামরুল হাসান বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আড্ডাময় বিকেল বলতে কিছু ছিল না। সহপাঠীরা যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিত, আমি তখন রোজগারের পেছনে ছুটতাম। এমনও দিন গেছে, টাকার অভাবে না খেয়ে থেকেছি। ঈদের দিন না খেয়ে হলে শুয়ে থেকেছি।’ তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার মেয়ে একটি বার্গার কিনতে এক হাজার টাকা চাইল। সে বলল, এক হাজার টাকার নিচে কি ভালো বার্গার হয়? আমি ভাবলাম, তাদের বাবা একসময় বানরুটি খেয়ে দিন কাটিয়েছে, এগুলো বাচ্চারা কি বিশ্বাস করবে?’
কামরুল হাসানের দুই সন্তান। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণি ও ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অন্যদিকে তিনি এখন সর্বোচ্চ বেতনধারী সিইওদের একজন।
আয় করতেই হবে
কামরুল হাসানের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের। কিন্তু নিজের খরচ নিজেই চালাতে হবে। পড়াশোনা শেষ করেই চাকরিতে যোগ দিতে হবে। এই তাগিদ থেকে আবেদন করলেন নেসলে বাংলাদেশের মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ পদে। ১৬২ জনের মধ্য থেকে ২ জন চাকরি পেলেন, যার একজন কামরুল হাসান (১৯৯৫ সালে)। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা যেমন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ওষুধ সম্পর্কে পরিচিতি তৈরির কাজ করেন, কামরুল হাসানের কাজ ছিল শিশুখাদ্যের বাজার তৈরি।
ব্র্যান্ডে টিটকারির মুখে
কামরুল হাসান বলেন, ‘নেসলেতে শুধু পরিশ্রম করেছি। স্টেশনে, ছারপোকা ভরা হোটেলে রাত কাটিয়েছি। সফলতাও এসেছে। একসময় আমি নেসলের ব্র্যান্ড বিভাগে যুক্ত হলাম। প্রাণরসায়নের ছাত্র হয়ে ব্র্যান্ডিংয়ে গিয়ে শুরুতে টিটকারি শুনতে হতো। সহকর্মীরা আমাকে এড়িয়ে নিজেরা আড্ডা দিতেন।’
অবশ্য সময় বেশি লাগেনি, দুই বছরের মধ্যে কামরুল হাসান সেরা ব্র্যান্ড ম্যানেজার হলেন। অবশ্য ব্র্যান্ডে যোগ দিতে শর্ত হিসেবে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে হলো তাঁকে। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ৩ দশমিক ৯৬ সিজিপিএ (চারের মধ্যে) নিয়ে নিয়মিত বা রেগুলার এমবিএ করলেন কামরুল হাসান। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় শুরুতে তাঁকে ব্র্যান্ডে দিতে রাজি হয়নি নেসলের ব্যবস্থাপনা। তিনি বলেছিলেন, ‘না পারলে আমাকে বাদ দিয়ে দিয়েন।’
১২ বছর চাকরি করার পর ২০০৭ সালে নেসলে ছেড়ে দেন কামরুল হাসান। যোগ দেন রহিমআফরোজে। সেখান থেকে ইগলু, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, নিউজিল্যান্ডের দুধ বিপণনকারী ফন্টেরা (সিঙ্গাপুরে) ও প্রাণ হয়ে আবার ইগলুতে।
কামরুল হাসান বলেন, ‘নিউজিল্যান্ড ডেইরিতে আমি এক পদ নিচে যোগ দিই। এর কারণ ছিল, আমি ভালো একটি জায়গা খুঁজছিলাম। নিউজিল্যান্ড ডেইরিতে তিন মাসের মধ্যে ব্র্যান্ড ম্যানেজার থেকে আমাকে মার্কেটিং ম্যানেজার, এক বছর পরে হেড অব মার্কেটিং করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘ফুটবলে আক্রমণ করার জন্য অনেক সময় বল মাঝমাঠ থেকে রক্ষণভাগে পাঠানো হয়। আমিও চাইছিলাম আমার ক্যারিয়ারকে পুনর্গঠন করতে। এ কারণেই ছোট পদে যোগ দেওয়া।’
‘এ লোক নাছোড়বান্দা’
ফন্টেরায় পদ ছিল কান্ট্রি ম্যানেজার, অফিস সিঙ্গাপুরে। একদিন বিমানবন্দরে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁর পরামর্শ ও পরিবারের কাছে থাকার তাগিদে কামরুল হাসান যোগ দেন প্রাণে। পদ ছিল প্রাণের মার্কেটিং প্রধান (২০১৫ সালে)।
অবশ্য প্রাণে বেশি দিন থাকেননি কামরুল হাসান। হঠাৎ প্রাণ ছেড়ে চাকরি খুঁজছিলেন। গেলেন এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীরের কাছে। তিনি বললেন, সেখানে যোগ দিতে। কিন্তু বেতন ততটা দেওয়া যাবে না।
অফার লেটার নিলেন। এর মধ্যে কামরুল হাসানকে ফোন করলেন আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মোনেম নিজে। দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ইগলুর দায়িত্ব নিতে। কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি নানা কারণ দেখিয়ে যোগ দেব না বলে বেরিয়ে গেলাম। আবদুল মোনেম সাহেব আবার ফোন করলেন। বললেন, তুমি মুখের ওপর না বলতে পেরেছ। তুমিই পারবে। ইগলুর দায়িত্ব নাও। আমি তোমাকে কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা দেব।’
২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর কামরুল হাসান ইগলুতে যোগ দেন। চলতি বছর চার বছর হয়েছে। এক দফা পদোন্নতি হয়েছে। ডেইরি ও ফুডসের দায়িত্ব যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে অসাধু বেশ কিছু কর্মী ও পরিবেশক বাদ দিয়েছেন। পরিবেশকেরা হুমকি দিয়েছে, মামলা করেছে, সবকিছু সামলে ইগলুর ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন কামরুল হাসান।
‘শুরুর দিকে অফিসের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কেউ কেউ বলত, এ লোক তিন মাসও টিকবে না। এখন সবাই বলে, এ লোক নাছোড়বান্দা’—যোগ করেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, এখনকার তরুণেরা পেশাজীবনে টি-২০ ঢংয়ে উন্নতি চায়। দরকার আসলে টেস্ট খেলা। ক্রিজে পড়ে থাকলে রান আসবেই, সেঞ্চুরিও হবে। ২০১৭ সালে সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ সামিটে এফএমসিজি শ্রেণিতে সেরা সিইওর সম্মাননা পান কামরুল হাসান।
পেশাজীবনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেও দিনভর কাজ করাই কামরুল হাসানের কাজ। তিনি মনে করেন, সফলতার জন্য কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। আর দরকার সততা।
একনজরে
শিক্ষা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। পরে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ।
পেশা শুরু
১৯৯৫ সালে নেসলে বাংলাদেশ লিমিডেটের মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে।
চাকরি
নেসলে ছাড়াও রহিমআফরোজে, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, ফন্টেরা ও প্রাণ গ্রুপের বিভিন্ন পদে।
এখনকার পদ
আবদুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু আইসক্রিম, ডেইরি ও ফুডের গ্রুপ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
তরুণদের প্রতি পাঁচ পরামর্শ
১. তরুণেরা যা কিছুই করবে, তাতে প্যাশন বা তীব্র অনুরাগ থাকতে হবে। সবাই তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়, যা সবচেয়ে বড় ভুল।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু একটা করা উচিত। এমনকি হতে পারে টিউশনি অথবা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা। এতে যোগাযোগদক্ষতা ও নেতৃত্বগুণ তৈরি হবে।
৩. উপস্থাপনায় দক্ষ হতে হবে। ভারতীয়রা বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি মেধাবী নয়। কিন্তু তাদের উপস্থাপনার দক্ষতা অনেক ভালো।
৪. নিজেকে অন্যদের থেকে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে আলাদাভাবে যোগ্য করে তুলতে হবে।
৫. কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রমের সুফল একসময় না একসময় পাওয়া যাবেই।
Source:
https://www.prothomalo.com/economy/article/1620303/%E0%A6%96%E0%A7%81%E0%A6%AC-%E0%A6%95%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%8F-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87