ওষুধ খাতে মুদ্রাস্ফীতির ভয়াল থাবা
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ২৪ অক্টোবর ২০১১, ৯ কার্তিক ১৪১৮
অন্ন, বস¿, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষা— এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যে কোনো রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা হলো চিকিত্সা। এ চিকিত্সা ক্ষেত্রে মূল উপকরণ হলো ওষুধ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য- জনবহুল এক দেশ। এ দেশ সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও তিনটি বিষয়ে দিন দিন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও দুর্নীতি। পণমূল্য বৃদ্ধির অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি আমাদের দেশের ওষুধশিল্প। একদিকে জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি ভাবে বেড়ে চলেছে নিত্যনতুন রোগ-বালাই। একই সঙ্গে বাড়ছে ওষুধের দামও। অথচ এ দেশের জনগণের আয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না। যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সে দেশের মানুষের পক্ষে বেশি দাম দিয়ে ওষুধ কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই প্রভাব পড়ছে আমাদেও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ওপর।
এর মধ্যে আবার বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্যের দাম গত কয়েক মাসে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের টাকা অর্জনের নেশা এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে অনেক কোম্পানি সিন্ডিকেট করে ওষুধের ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। সবারই লাভ করার একটা সীমা আছে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের ব্যবসায়ীরা সীমা ছাড়ানো লাভের আশায় অতিরিক্ত দুর্নীতি করে চলছেন। তাদের বিবেকে একবারও আঘাত করছে না যে এর ফলে কত মানুষ বিনা চিকিত্সায় মারা যাচ্ছেন। প্রশাসন থেকেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ওষুধের দাম নিয়ন্¿ণের জন্য। এর এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে। বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে নিজেদের জীবন বাঁচাতেই আজ মানুষ দুর্নীতির আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করছে না। ওষুধের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যও জনগণ কিনতে পারছে না। প্রশাসন বা অধিদফতরের কর্মচারীরা ওষুধের দাম নিয়ন্¿ণের ব্যবস্থা তো নিচ্ছেই না, বরং তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক দিক দেখা যায়।
গত ১৭ অক্টোবর, ২০১১-এ দৈনিক ইত্তেফাকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের বর্তমান ও আগের দাম প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম ছকে উল্লেখ করা হলো—
এই ছকের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন ধরনের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ওষুধ বিক্রির দোকান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট’ সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, আগে প্রতি বছরে একবার ওষুধের দাম বাড়ানো হতো। বর্তমানে প্রতি মাসে কোনো কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
যে দেশের অধিকাংশ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা সে দেশের মানুষের জন্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধ দাম যদি এ হারে বাড়তে থাকে তা মানুষের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। বর্তমানে অর্থের অভাবে জীবন রক্ষার জন্য অনেক মানুষই জীবনরক্ষাকারী ওষুধও কিনতে পারছে না। ফলে কমে আসছে জীবনযাত্রার মান। মানুষ বাধ্য হচ্ছে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে। ওষুধ কোম্পানির ওষুধ তৈরি করতে যত খরচ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হচ্ছে ওষুধ বাজারজাতকরণ ও ডাক্তারদের খুশি করতে। এ খরচ তারা উঠিয়ে নিচ্ছে ওষুদের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।
১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে ৫১.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, ২০০৫ সালে এ সংখ্যা ০.৩১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬ মিলিয়নে দাঁড়ায়। এভাবে চলতে থাকলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকসংখ্যা ২০১১ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে ৫৭.৩ ও ৫৯.৮ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে। এদেশে দরিদ্র জনগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ হলো পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। এ দেশে ওষুধের দাম যদি উচ্চ হারে বাড়তে থাকে তবে দেশের বেশিরভাগ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অসম্ভব হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এবং অতিরিক্ত পরিবেশ দূষণে সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। অসুখ-বিসুখ এদেশে লেগেই থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ কথা প্রসঙ্গে সেদিন বললেন, প্রায় সব কোম্পানির ওষুধের দাম দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগীরা চিকিত্সা নিতে এসে ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সরকারের এদিকে কোনো নজরই যেন নেই।
রুগ্ণ, অসুস্থ জাতি কখনও অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। চিকিত্সা সেবা হলো যেকোনো মানুষের মৌলিক চাহিদা। অথচ কিছু স্বার্থানেস্বী ব্যবসায়ীর কারণে আজ সমগ্র জাতি চিকিত্সা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। ওষুধের দাম যেভাবে বেড়ে চলছে, তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ সরকারের অল্প কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। সেইগুলো হলো—
প্রথমত, সরকারকে নিয়মিত ওষুধের বাজার মনিটর করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ওষুধ বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আইন সংশোধন করে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট চালু করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল বাড়াতে হবে।
ওষুধের নাম বর্তমান আগের
দাম (টাকায়) দাম (টাকায়)
কাশির ১০০ মিলি এবেক্স সিরাপ ৫০ ৩৫
লাইটেক্স ১০০ মিলি সিরাপ ৪০ ৩০
ভি প্লেক্স ট্যাবলেট ১০ ৪
সিরাপ ড্রপ ৪০ ৩৫
এজিম্যাক্স ট্যাবলেট ২০ ১৫
ফুনাক ক্যাপসুল ৮ ৬
ইপিক্যাল ডি ট্যাবলেট (প্রতি পট) ৭৫ ৬০
১০০ মিলি এন্টাসিড সিরাপ ৬৪ ৩২
এন্টাসিড প্লাস সিরাপ ৬৫ ৫৫
এন্টাসিড ট্যাবলেট ১ ০.৫০
এলাট্রোল সিরাপ ২০ ১৬
এলাট্রোল ড্রপ ২২ ১৫
সেডিল ট্যাবলেট ০.৭০ ০.২০
রেডিয়েন টোরাডোল ট্যাবলেট ৩০ ২৩
টোরাডেলিন ইনজেকশন ১৩০ ৯৯
এটোস ট্যাবলেট ১২ ১০
ভি-প্লেক্স ভেট ইনজেকশন ২০ ১২
ইসোপ্লেক্স- ২০ গ্রাম ট্যাবলেট ৬ ৫
লেখক : প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি