চারদিকে উৎপাত : প্রতিকারের উপায় কী

Author Topic: চারদিকে উৎপাত : প্রতিকারের উপায় কী  (Read 884 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
চারদিকে উৎপাত : প্রতিকারের উপায় কী
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
৭ জানুয়ারি, ২০২০ (The daily Kalerkantho)

আমাদের দেশে উৎপাতের অন্ত নেই। চারদিকে উৎপাত। নানা ধরনের উৎপাত। পথে-ঘাটে-মাঠে সর্বত্র উৎপাত আর উৎপাত। অনেক সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও উৎপাত থেকে রেহাই মেলে না। সব কিছু দেখে মনে হয়, আমরা যেন উৎপাতের রাজ্যে বাস করছি। উৎপাত যেন জীবনেরই অনুষঙ্গ; তাই উৎপাতে এখন আমরা আর বিরক্ত হই না। আবার অনেকেই মনে করতে পারেন, দেশে বুঝি উৎপাত নিরোধক কোনো আইন নেই। আবার অনেকেই হয়তো জানি না, উৎপাত কী? আভিধানিক অর্থে, উৎপাত শব্দের অর্থ হচ্ছে উপদ্রব, দৌরাত্ম্য, অত্যাচার। উন্নত দেশগুলোতে উৎপাত করা একটি মারাত্মক অপরাধ; ভয়ানক দেওয়ানি অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য। সেখানে শান্তি ভঙ্গ করা বা উৎপাত করা ফৌজদারি অপরাধের মতোই দণ্ডযোগ্য একটি অপরাধ। সাধারণ অর্থে, অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটানোর নামই উৎপাত। এটি এমন এক ধরনের অপরাধমূলক কাজ, যা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। একজন আইন মেনে আরেকজনকে বিরক্ত না করে যদি তার ন্যায়সংগত অধিকার ভোগ করে, তাতে কারো ব্যাঘাত ঘটানোর অধিকার নেই। এই ব্যাঘাত ঘটানোই হলো উৎপাত। উৎপাতের দায়-দায়িত্ব সৃষ্টি হয়, এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করলে যার ফলে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। গণ-উৎপাত সম্পর্কে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির (১৮৬০) ২৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কর্তৃক জনসম্মুখে এমন কোনো কাজ করা, যার দ্বারা জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কার্য করাকে গণউৎপাত বলে’। আর দণ্ডবিধির ২৯০ ধারায় এর শাস্তি সম্পর্কে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির শাস্তি হিসেবে ২০০ টাকা যদিও বর্তমান বাস্তবতায় খুবই সামান্য, তবু শাস্তি শাস্তি হিসেবেই গণ্য হয়। দণ্ডবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তি তার অবৈধ কাজ যা জনসাধারণের উপদ্রব সৃষ্টির জন্য দায়ী, যা জনসাধারণের শারীরিক বা মানসিক আঘাত, বিপদ বা বিরক্তি সৃষ্টি করে। অতএব, কোনো ব্যক্তির উচ্চ শব্দের সংগীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বৈধ অধিকার, যা শব্দের তীব্রতার কারণে একটি অপরাধকে গঠন করে। এ প্রসঙ্গে বছর কয়েক আগে ঢাকার ওয়ারি রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মর্মান্তিক ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক। সেখানে একটি ভবনের ছাদে একদল লোক অনুষ্ঠান উপলক্ষে উচ্চশব্দে সংগীত বাজাচ্ছিল। ৬৫ বছর বয়সী নাজমুল হক নামক এক ব্যক্তি ওই একই ভবনের একজন বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ওই উচ্চশব্দের সংগীতের কারণে অসুস্থ বোধ করেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করলেন সংগীতে শব্দের তীব্রতা কমাতে। কিন্তু তারা তা না করলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মর্মান্তিক ঘটনায় রূপ নেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য পুলিশ চারজনকে গ্র্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে। আমাদের দেশে মশা-মাছির উৎপাত থেকে শুরু করে ভিক্ষুকের উৎপাত, হিজড়াদের উৎপাত, মাদকসেবীদের উৎপাত, যানবাহনে উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে শব্দদূষণের উৎপাত, বায়ুদূষণের উৎপাতসহ পরিবেশ দূষণজনিত উৎপাত, ভাসমান পতিতাদের উৎপাত, ময়লা-আবর্জনা-ধোঁয়া-দুর্গন্ধজনিত উৎপাত, হৈ-হুল্লোড়জনিত উৎপাত, চলাচলজনিত উৎপাত, উচ্চৈঃস্বরে মাইকে বা ঢাকঢোল বাজিয়ে বা সাউন্ডবক্সে গান-বাজনা বাজিয়ে বা রাতের বেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করে উৎপাত সৃষ্টি করাপূর্বক লেখাপড়া ও ঘুমে বিঘ্ন ঘটানোর উৎপাত, স্কুল-কলেজ আর রাস্তার মোড়সহ যেখানে-সেখানে বখাটেদের উৎপাত, আড্ডাবাজদের উৎপাত, হকারদের উৎপাত, পথে-ঘাটে চলাচলের সময় উৎপাতসহ নানা ধরনের উৎপাত আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেক সময় বখাটের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে অনেক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করে, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।

আমরা অনেক সময় উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলাকে এক বিষয় হিসেবে মনে করি বা মনে হতে পারে। কিন্তু উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলা এক বিষয় নয়। অবহেলার ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে বিবাদীর সাবধানতা অবলম্বন করা দায়িত্ব ছিল কি না এবং বিবাদী সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি না। আর উৎপাতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের প্রশ্ন উঠে না। বিবাদীর আচরণই মুখ্য বিষয়। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করার পরও যদি উৎপাতের সৃষ্টি হয় তার পরও বিবাদী দায়ী। কিন্তু কারো জমিতে কোনো আগন্তুক যদি উৎপাতের কারণ সৃষ্টি করে তবে জমির মালিক অসতর্কতার জন্য অবহেলার দায়ে দায়ী। কারণ তার জমিতে এসে কেউ উৎপাত সৃষ্টি করলে তার দায়-দায়িত্ব মালিককেও নিতে হবে। অবহেলার ক্ষেত্রে বাদীর অবদান বিবাদীর দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে হ্রাস করে। উৎপাতের স্থলে বাদী নিজেই এসেছিল—এ রকম আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। পরিস্থিতি, স্থান, পদ্ধতি, ফলাফল, সংবেদনশীলতা ইত্যাদির আলোকে বিচার করতে হবে সেখানে উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যাবে কি না। আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে উৎপাত বৈধ হয়ে যায়, কিন্তু অবহেলার জন্য আইন ক্ষমতা প্রদান করে না। কেউ ক্রমাগত উৎপাত করলেও বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বা অজ্ঞতা বলে ক্ষমার চোখে দেখি। ফলে উৎপাতের পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না। সম্ভাব্য ও অনুমেয় ক্ষতির জন্য সাবধানতা অবলম্বনে কেউ ব্যর্থ হলে বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু উৎপাত নয়। কেউ তার এ কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আমরা অবহেলার দায়ে দায়ী করতে পারি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য অবহেলা অথবা উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যায়, কিন্তু এ দুটি বিষয় এক নয়। যদিও আইনের ভাষায় দুটি বিষয়ই টর্ট আইনের অন্তর্গত। বর্তমানে অবহেলা স্বতন্ত্র টর্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রে উপাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমাদের দেশে টর্টের যে দুই-চারটি মামলা হয়ে থাকে, তা মূলত মানহানিকেন্দ্রিক। টর্টের অন্যান্য বিষয় যেমন : উৎপাত, গণ-উৎপাত, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি বিষয়ক মামলা আদালতে যেন অজ্ঞাত কারণে দায়ের হতে দেখা যায় না। ফলে আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। অথচ টর্ট আইনে মামলা করে সহজেই উৎপাত বা গণউৎপাতের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

উৎপাত বা উপদ্রবের মতো ক্ষুদ্র অপরাধ হত্যাকাণ্ডে পর্যন্ত রূপান্তরিত হতে পারে বা হয়ে থাকে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের আইনি শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2020/01/07/859703

 


Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd