আবুল বারকাত
আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত ধ্যানধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বিধায় নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক একটি গবেষণা ফলাফল উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি। পশ্চিমা একজন সমাজ গবেষক গবেষণা কাজটি করেছিলেন বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ঐ গবেষক বার্মায় গিয়ে দেখলেন যে, নারীরা সবসময়ই পুরুষদের পেছনে পেছনে হাঁটেন
নারীর ক্ষমতায়ন অর্থনীতিসহ সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত_এ কথা কেউই (গুটিকয়েক মৌলবাদী ছাড়া) সম্ভবত এ দেশে প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন না। দলিল-দস্তাবেজে সরকারও যে তা স্বীকার করে তার অন্যতম প্রমাণ হল বাংলাদেশের সংবিধানে সংবিধানের প্রাধান্যসহ, সমসুযোগ সংক্রান্ত সব বিষয়কে অন্তভর্ুক্তি; ১৯৯৭-এ নারীনীতি প্রণয়ন (যদিও এখন এ নীতির বিরোধী শক্তি জঙ্গি কায়দায় মাঠে নেমেছে); স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীর অন্তভর্ুক্তির বিধান প্রচলন; সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায় (গরষষবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ উবপষধৎধঃরড়হ) রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের স্বাক্ষর করা; সব পরিকল্পনা দলিলে নারীর সরব উপস্থিতি (অন্তত কাগজে)। তবে কাগুজে স্বীকৃতি আর বাস্তবে ফারাক আছে_ব্যাপক ফারাক।
নারীর ক্ষমতায়ন আসলে সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হতেই হবে। কারণ এ দেশের জন্মটাই হয়েছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের সবার উন্নয়নেরই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। যে আকাঙ্ক্ষার মর্মবস্তু হলো বৈষম্যহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক মানস-কাঠামো সৃষ্টি। আকাঙ্ক্ষার এ অর্থে প্রকৃত উন্নয়ন মানে শুধু মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি নয়। প্রকৃত উন্নয়ন হল মানব উন্নয়ন (যঁসধহ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ), আরও সঠিক অর্থে বললে বলতে হয় মানবিক উন্নয়ন (যঁসধহ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ)। আর জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ নারীকে বাদ দিয়ে, নারীকে অক্ষমতায়িত রেখে এ উন্নয়ন কল্পনাতীত। কল্পনাতীত এ কারণে যে, আমাদের দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রকৃত এ উন্নয়নের অর্থ হতে হবে (যা সাংবিধানিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যপূর্ণ) :
১. মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের সুযোগ সৃষ্টি ও তা সমপ্রসারণ (বহংঁৎরহম ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং ভড়ৎ ধ ভঁষষ ষরভব)_এ দিক থেকে নারীরা পিছিয়ে আছেন_নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে;
২. (উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়) বহিঃস্থদের অন্তভর্ুক্তিকরণ (রহপষঁংরড়হ ড়ভ ঃযব বীপষঁফবফ)_নারীরা বহিঃস্থই ছিলেন বহিঃস্থই আছেন (তথাকথিত সচলতা যতই বাড়ুক না কেন);
৩. মানুষের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ সম্প্রসারণ (বহংঁৎরহম ভঁষষ ভৎববফড়স ঃযধঃ ঢ়বড়ঢ়ষব ংযধষষ বহলড়ু)_যেখানে থাকবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (বপড়হড়সরপ বসঢ়ড়বিৎসবহঃ অর্থে), রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক সুবিধাদি, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা_এসব স্বাধীনতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী অ-স্বাধীন।
৪. মানুষ তার নিজের জন্য যে জীবন মূল্যবান মনে করেন সে জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগ সম্প্রসারণ (বীঢ়ধহফরহম পযড়রপবং ঃড় ষবধফ ষরাবং ঢ়বড়ঢ়ষব াধষঁব)_এ ক্ষেত্রেও নারী অবশ্যম্ভাবীভাবেই পশ্চাৎপদ।
৫. অ-স্বাধীনতার সব উৎস তিরোহিত করা (ৎবসড়াধষ ড়ভ ধষষ ংড়ঁৎপবং ড়ভ ঁহ-ভৎববফড়স)_নারীর জন্য কোথায় এ প্রক্রিয়া?
৬. সাংবিধানিক ও ন্যায় অধিকারকে শ্রদ্ধা করা (ৎবংঢ়বপঃরহম ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ ধহফ লঁংঃরপরধনষব ৎরমযঃং)_নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি আদৌ মান্য করা হয় কি?
৭. সব ধরনের দারিদ্র্য উচ্ছেদ-নিমর্ূল-হ্রাস(!) করা (বৎধফরপধঃরহম ঢ়ড়াবৎঃু)_কোথায় এ প্রক্রিয়া?
৮. বঞ্চনার ফাঁদ ভেঙে ফেলা (নৎবধশরহম ফবঢ়ৎরাধঃরড়হ ঃৎধঢ়)_দারিদ্র্য-উদ্ভূত বঞ্চনা, ক্ষমতাহীনতা-উদ্ভূত বঞ্চনা, নিঃসঙ্গতা-বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্ব-উদ্ভূত বঞ্চনা, শারীরিক দুর্দশা-উদ্ভূত বঞ্চনা, ভঙ্গুরতা-উদ্ভূত বঞ্চনা_এসবের কোন বঞ্চনা থেকে নারী মুক্ত? অথবা এ মুক্তির অর্থপূর্ণ প্রক্রিয়ারই বা অস্তিত্ব কোথায়?
আসলে মানবিক উন্নয়নের উলি্লখিত মর্মবস্তু এ দেশে বাস্তব জীবনে স্বীকৃত নয়। নারীর জন্য তা আরও বেশি অস্বীকৃত। আর দরিদ্র নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অস্বীকৃত। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষকে বিশেষত নারীকে কখনও অবস্থান করানো হয়নি_সম্ভবত সচেতনভাবেই এটা করা হয়নি। পিতৃতান্ত্রিকতাসহ সামন্ত ধ্যানধারণা থেকে শুরু করে মুক্তবাজার অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট অনেক কারণেই এর পেছনে অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত ধ্যানধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বিধায় নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক একটি গবেষণা ফলাফল উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি। পশ্চিমা একজন সমাজ গবেষক গবেষণা কাজটি করেছিলেন বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ঐ গবেষক বার্মায় গিয়ে দেখলেন যে, নারীরা সবসময়ই পুরুষদের পেছনে পেছনে হাঁটেন। এ থেকে তিনি উপসংহারে উপনীত হলেন যে, বার্মার নারীরা পশ্চাৎপদ, অক্ষমতায়িত এবং পিতৃতান্ত্রিকতার শিকার। ঐ একই গবেষক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারও নারীর ক্ষমতায়ন অবস্থা দেখার জন্য বার্মায় গিয়ে দেখলেন ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ আগে নারী চলত-হাঁটত পুরুষের পেছন পেছন আর এখন পুরুষরা হাঁটছে নারীর পেছন পেছন অর্থাৎ নারী সামনে পুরুষ পেছনে। উৎফুল্ল হয়ে গবেষক লিখলেন বার্মায় নারীর ক্ষমতায়নে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে_নারীরা এখন পুরুষের সামনে। আসলে ঘটনা উল্টো। নারীরা যে আগে হাঁটছেন আর পুরুষরা নারীর পেছনে (বেশ দূরত্বে) তার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় প্রচুর ল্যান্ড মাইন পোঁতা হয়েছিল। অর্থাৎ যে আগে হাঁটবে সে আগে মরবে।