Faculty of Humanities and Social Science > Human Rights

Human Rights

(1/1)

Anayetur Rahaman:
একটি জানাজার মানবিক শক্তি

জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার ধর্মবিশ্বাসকেন্দ্রিক প্রথার মধ্য দিয়ে নিজের সৎকারের অধিকারও অর্জন করে। কিন্তু সবাই সেই অধিকার ভোগ করতে পারে না। শুধু যৌনকর্মীই নয়, ট্রান্স জেন্ডার মানুষদের ক্ষেত্রেও মৃত্যুর পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে জটিলতা আছে।

যৌনকর্মীরা সমাজের কাছে নিগৃহীত হলেও সমাজের একশ্রেণির পুরুষের জন্যই যুগ যুগ ধরে টিকে আছে ‘যৌনপল্লিগুলো’। অথচ সেখানকার নারীদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেছে সেই পুরুষপ্রধান সমাজই। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী হিউম্যান রাইট ওয়াচের প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১৪টি বৈধ যৌনপল্লি আছে এবং সেখানে প্রায় ২০ হাজার যৌনকর্মী বসবাস করেন। এই প্রথমবার দৌলতদিয়ায় বহু পুরোনো যৌনপল্লিতে প্রথমবারের মতো হামিদা বেগম নামের এক যৌনকর্মীর দাফন-কাফন পুরোপুরি ধর্মীয় প্রথা মেনে করা হয়েছে, তাঁকে জানাজা দেওয়া হয়েছে। পরে হামিদা বেগমের চেহলামেরও আয়োজন করা হয়। প্রয়াত যৌনকর্মী হামিদা বেগমের জানাজায় হাজির ছিলে প্রায় দুই শ মানুষ। আর চেহলামের দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলেন চার শরও বেশি মানুষ।
বাংলাদেশের বৃহত্তম ও বহু পুরোনো যৌনপল্লি গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায়। এখানে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার যৌনকর্মী আছেন। এখানে আগে কারও মৃত্যু হলে প্রথম দিকে লাশের সঙ্গে পাথর বেঁধে পদ্মা নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হতো। তবে কয়েক বছর থেকে ডুবিয়ে দেওয়ার বদলে কবরস্থান পেয়েছেন যৌনকর্মীরা। বিভিন্ন আন্দোলন এবং অ্যাকটিভিস্টদের লবির ফলে তাঁদের জন্য পল্লির পাশে মুসলিম যৌনকর্মীদের জন্য কবরস্থান করা হয়। তবে জানাজা-কাফন ছাড়াই মৃত ব্যক্তিকে মাটিচাপা দেওয়া হতো ।

সামাজিক চোখে পেশার কাছে জীবনের মর্যাদা ডুবে গিয়েছিল। যাঁদের জন্য এই যৌনপল্লি, তাঁরাই যৌনকর্মীদের জানাজার বিরোধিতা করে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেন। কিন্তু যৌনকর্মীরা তাঁদের আন্দোলন জারি রেখেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে মাদক, জোর করে দেহ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গত সপ্তাহে পল্লির বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়। গোয়ালন্দ ঘাট থানা-পুলিশের সহযোগিতায় যৌনকর্মীদের সংগঠন অবহেলিত নারী ঐক্য নামের একটি সংগঠন এ মতবিনিময়ের আয়োজন করে। এই মতবিনিময় চলাকালেই পল্লির প্রবীণ বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী হামিদা বেগমের মৃত্যুর খবর আসে। তখনই দীর্ঘদিনের এই আন্দোলন নগদে জোরালো হয়। সেখানেই পল্লির বাসিন্দারা মৃত হামিদা বেগমের জানাজাসহ দাফনের দাবি তোলেন।

এবারই তাঁদের দাবির প্রতি সম্মান জানানো হয়। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান তাঁদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে মৃত ওই নারীর জানাজা, দাফন, কাফনের ব্যবস্থা করেন। প্রথমে হুজুর জানাজা পড়াতে অস্বীকৃতি জানালেও ওসির অনুরোধে জানাজা পড়ান। এতে মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসকেন্দ্রিক প্রথার মধ্য দিয়ে জীবনের শেষের আনুষ্ঠানিকতা পাওয়ার যে অধিকার, সেটির স্বীকৃতি মেলে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজে এই জানাজা এবং চেহলামের অনুষ্ঠানটি নিছক একটি ধর্মীয় আচার ছিল, তা নয়; এটি যৌনকর্মীদের দেখার ক্ষেত্রে সামাজিক যে চাহনি আছে, তাকেও মানবিক হতে বলে। আশা করা যায়, এই উদ্যোগ বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে। এ জন্য পুলিশ প্রশাসন ধন্যবাদ পেতে পারে।

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন যে একজন ওসি বলাতে ইমামসহ অনেকে এই জানাজা ও চেহলামে এসেছেন। অন্যরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, তবে কাজ হয়নি। এবার হয়েছে। রাষ্ট্রেরই একজন দায়িত্ব নিয়েছেন, বোঝাতে পেরেছেন যে এ রাষ্ট্রে সবার অধিকার সমান। সমাজের-রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের তো সমাজের ইতিবাচক চোখ বদলাতে অবদান রাখারই কথা। এর আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। তবে কথা হলো, উদ্যোগটি যেন নিছক একটি ব্যক্তির উদ্যোগ হিসেবে পাঠ না করা হয় এবং সীমিত না থাকে। এই উদ্যোগ যেন রাষ্ট্রকে এই জায়গায় নিতে পারে যে কারও অধিকারে বাধা দিলেই শাস্তি হবে।

হামিদার মেয়ে, যিনি বর্তমানে যৌনকর্মী হিসেবেই কাজ করছেন, মুগ্ধভাবে চেয়ে দেখেছেন সমাজের মানুষের এই বদল। বলছেন, ‘আমার মা মানুষের স্বীকৃতি পেয়েছে।’ মেয়েটির মুগ্ধতা আমাদেরও চোখেমুখে। সমাজের মানুষই তবে মানুষের স্বীকৃতি পাচ্ছে...এটা ভালো।
(প্রথম আলো)

Navigation

[0] Message Index

Go to full version