Faculties and Departments > Departments
বাঘা, ছাগা ও যাগা
sisyphus:
অনার্স ও মাস্টার্স - নিজের উচ্চশিক্ষার দীর্ঘ পাঁচবছরের প্রায় সবগুলো ক্লাস কাটিয়েছি ক্লাসের সবশেষ বেঞ্ছটিতে বসে। ছাত্রজীবনে ব্যাকবেঞ্ছার হওয়ার অনেকগুলো সুবিধার একটি হচ্ছে সহপাঠিদের কে কী করছে সেটা খুব চমৎকারভাবে দেখা যায়। বিপুল আগ্রহে বারো রকমের মানুষ দেখেদেখে তের রকমের জিনিষপাতি শেখা যায়। যে কখনো পেছনের বেঞ্ছে বসেনি তাকে সে আনন্দ ঠিক বোঝানো সম্ভব না। দায়িত্ব নিয়ে জোর গলায় বলিঃ ক্লাসে বসে উচ্চমার্গীয় দর্শন (বা সস্তা ফিলোসফি কপচানোর) সুযোগ ফ্রন্টবেঞ্ছারদের চাইতে অতি অবশ্যই ব্যাকবেঞ্ছারদের বেশী। সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জলজ্যান্ত প্রমাণ আমি নিজে। গতকাল পুরাতন বই ঘাটতে গিয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারের আমার এক ক্লাসখাতার ছেড়া পাতা পেলাম। নিজে ছাত্র থাকা অবস্থায় ছাত্রত্বের প্রকারভেদ নিয়ে একটা লেখা। “ছোটবেলার” (!) সেই হাস্যকর, কিঞ্ছিৎ সস্তা, চটকদার ফিলোসফি জনসম্মুক্ষে প্রচার করার লোভ সামলানো গেলোনা!
::)
_______
ভালো ছাত্র, খারাপ ছাত্র বলে আদৌ কি কিছু আছে? এ প্রশ্নের সবচাইতে ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর হতে পারে “না, সব ছাত্রই সমান”। আসলেই কি তাই? নাকি দিনশেষে জর্জ অর্লওয়েলর সার্কাজমই সত্য- "All animals are equal but some animals are more equal than others"। প্রতিটা মানুষই আলাদা- এ যুক্তিতে হাজার শিক্ষার্থী হবে হাজার রকমের। তবু জানা-অজানার অযৌক্তিক- ছেলেমানুষী শ্রেণীভাগে একজন শিক্ষার্থী হতে পারে তিন কিসিমেরঃ
১. যাগাঃ যে জানেনা যে সে জানেনা - অনেকটা দিকভ্রান্ত, গন্তব্যহীণ পথের পথিক। অস্থিরতা ও বিভ্রান্তির কারণে এরা নিজেরাই জানেনা যে এরা জীবনে কী চায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও জানার আগ্রহ প্রায় শূণ্যের কোঠায় । তবে সেটা নিয়ে তারা মোটেও বিচলিত নয় বরং এদের কেউ কেউ নিজের অজ্ঞতা নিয়ে গর্বিত।
এনারা মাছভাজা খেতে আগ্রহী তবে মাছ কীভাবে ধরতে হয় সেটা শেখার ব্যাপারে আগ্রহ নেই। তবে মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এদের ছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। পরীক্ষার আগের রাতে সিলেবাস জেনে প্রথম পড়তে বসা এদের নিত্য অভ্যাস। সাহসী এ মানুষগুলোর কাছে পাস-ফেল নিয়ে টানাটানি রীতিমত ডালভাত। ভয়শূণ্য চিত্তে, বীরবেশে এদেরকে ছাত্রজীবন পার করতে দেখে অন্যগোত্রীয় অনেককে এদের নিয়ে কিঞ্ছিৎ ঈর্ষান্বিত হতেও দেখা যায়। শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং গোষ্ঠি কারণ এরা আদরেও পোষ মানেনা, ধমকেও পোষ মানেনা। পড়াশুনায় এদের আগ্রহী করে তোলা হিমালয় পর্বত জয়ের সামিল। এদের যে শিক্ষক সামলাতে পারে, তাঁকে লাল সালাম!
২. ছাগাঃ যে জানেনা যে সে জানে - খুব সম্ভবত ছাত্রজগতের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠি। এদের জ্ঞানপিপাসা মধ্যমপন্থি। সমাজ নিয়ে, নিজেকে নিয়ে কিছুটা হতাশা থাকলেও আত্মোউন্নয়নের ইচ্ছেটুকু এদের মধ্যে আছে। স্বভাবচরিত্রে নীরহ-গোবেচারা, দুধভাত শ্রেণীর। সিলেবাসের বাইরের জগৎ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। পড়াশুনা শুধু পরীক্ষার জন্য এই সরল নীতিতে বিশ্বাসী। বেশী পড়াশুনা > ভালো রেজাল্ট > ভালো চাকুরী > ভালো বিয়ে > জীবনের সার্থকতা – এই হচ্ছে তাদের জীবনের সহজ সমীকরণ। ফলস্বরূপ এদের বেশীরভাগের দৌড় প্রথাগত সমাজের ভারবাহী গাধা হওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য কদাচিৎ এদের কেউ কেউ প্রথাবিরোধী পথে হাঁটার আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে এই বিদ্রোহী গোত্রের বেশীরভাগেরই শেষমেষ প্রচলিত ধারার বাইরে যাওয়ার সাহসে কুলায় না। পড়াশুনা করে কম, টেনশন করে বেশী।
হালকা ফাঁকিবাজির কারণে রেজাল্ট মনঃপূত না হওয়ায় প্রতি সেমিস্টার শেষে এরা ঠিক করে “পরের সেমিস্টারে দেখায় দিব”। কিন্তু দিনশেষে দেখানো হয়না কিছুই, শুধু দেখে-দেখেই ডিগ্রি পার! আফসোস!! আমার মতে শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশী কাজ করা উচিত এই ছাগাদের নিয়ে। কারণ এরাই সমাজের বড় অংশ, এরাই দেশ চালাবে, এরাই দেশের ভবিষ্যৎ।
৩. বাঘাঃ যে জানে যে সে জানে/ যে জানে যে সে জানেনা- উচ্চ সিজিপিএধারী, পড়ুয়া, সামনের সিটে বসা টিপিক্যাল ভালো ছাত্র। এদের জ্ঞানপিপাসা অসীম। শিক্ষক যেমনই হোক, সিলেবাসে থাকুক আর নাইবা থাকুক, আগ্রহের বশে নিজের তাগিদে যে কোন কিছু শিখে ফেলতে পারে।
বদঅভ্যাস বলতে নিজেকে “আঁতেল” ট্যাগ খাওয়া থেকে বাঁচাতে এদের কাউকে কাউকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে দেখা যায়। সিলেবাস ভাজা ভাজা করে পড়া শেষ তবু পরীক্ষার আগে বলতে শোনা যায় “দোস্ত, কিস্যু পড়িনাই! রিটেক খামু” কিংবা দূর্দান্ত পরীক্ষা দেয়ার পরও দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ ভংগিতে বলে “পরীক্ষা ভালো হয় নাই, বাঁশ খাইছি”। তবে গুটিকয়েকের ভিতর আবার নিজের পান্ডিত্য জাহির করার প্রবণতা আছে। বিশেষ করে পরীক্ষার আগের দিনগুলায় ও পরীক্ষার আগের রাতে বন্ধুমহলে এদের কদর আকাশচুম্বি। পুরো সেমিস্টারে স্যার/ম্যাডাম যা বুঝাতে পারেন নাই, সেটা মিনিট দশেকের ভিতর জলবৎ-তরলং, সহজিয়া ভংগিতে বুঝানোর দূর্দান্ত প্রতিভা বাঘাদের আছে। প্রথা ভেঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের সক্ষমতা এদের থাকলেও দিনশেষে মোটাদাগে সমাজ এদের থেকে তেমন কিছুই পায়না। কারণ তেনাদের সিংহভাগই দেশে থাকেনা; জিরআরই/আইএলটিএস দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। শ্রেণীকক্ষে বেশীরভাগ শিক্ষকরা এদের নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত থাকার কারণে অন্য গোত্রীর শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও বঞ্চিত বোধ করে। আমার বিচারে এই বঞ্ছনাবোধ যৌক্তিক। স্বশিক্ষিত শিক্ষার্থীকে নতুন করে শিক্ষিত করার তো কিছু নেই?! বরং স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষিত করার মাঝেই ত শিক্ষকতার আনন্দ!
শেষকথাঃ
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি বাঘাদের জন্য শিক্ষক খুব একটা দরকারী না বরং এদের ভালো শিক্ষক পাওয়াটা অনেকটা বোনাসের মত। মালি যতই যোগ্য কিংবা অযোগ্য হোক, গোলাপ গাছে গোলাপই ফুটবে, ধুতুরা ফুল না। আমার কোর্সে যে বাঘারা ভালো করেছে নিশ্চিতভাবে তারা আমার যায়গায় অন্য যে কোন শিক্ষককে পেলেও ভালোই করতো। কাজেই শিক্ষকতার শুরু থেকে আমি খুব সচেতনভাবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি ছাগা আর যাগাদের। আমার প্রয়োজন এদেরই সবচেয়ে বেশীচ এদেরকেই আমার সবচেয়ে বেশী দরকার।
গত সোয়া তিনবছরের শিক্ষকতা জীবনে শুধুমাত্র দুইজন যাগা ও ছাগার চিন্তাতে যদি পরিবর্তন এনে থাকি, যদি মাত্র দুইজনের হৃদয়ও স্পর্শ করতে পারি তবে সার্থক এই শিক্ষকজীবন।
জয়তু শিক্ষকতা!
Anhar Sharif:
Thanks for sharing.
shamsi:
খুব ভালো লাগলো লেখাটা. আমিও এই একই ধারণা পোষণ করি:
“স্বশিক্ষিত শিক্ষার্থীকে নতুন করে শিক্ষিত করার তো কিছু নেই?! বরং স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষিত করার মাঝেই ত শিক্ষকতার আনন্দ!”
শামসি
Shamsi Ara Huda
Assistant Professor
Department of English
zafrin.eng:
Thanks for sharing! :)
kamrulislam.te:
দারুণ লিখনি👍
Navigation
[0] Message Index
[#] Next page
Go to full version