আমাদের বাংলা এবং বাস্তবতা

Author Topic: আমাদের বাংলা এবং বাস্তবতা  (Read 1081 times)

Offline Fahmida Afrin

  • Newbie
  • *
  • Posts: 20
  • Test
    • View Profile
    • Fahmida Afrin
ভাষা মাত্রই গতিশীল, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীলতা ভাষার নিতান্তই প্রাকৃতিক ধর্ম। হুমায়ুন আজাদ ভাষার এই বৈশিষ্ট্যকে তুলনা করেছেন প্রবাহমান নদীর সঙ্গে। কিন্তু স্বাভাবিক গতিতে এবং সমাজের চিরায়ত বিষয়াদির প্রভাব স্বীকার করে যে সাবলীল পরিবর্তন, এর বাইরের স্থূল পরিবর্তনের সঙ্গে অহরহ পরিচিতি ঘটাটা একটি ভাষার জন্য মোটেও সুলক্ষণ বহন করে না।

বিশ্বায়নের অবাধ এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় শক্তিমত্তা ও উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে নানাবিধ ক্ষেত্রে একটি একরৈখিক মূলধারা সৃষ্টির প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের অন্যতম জীবন্ত অনুষঙ্গ ভাষাও এর আওতামুক্ত নয়। বিশ্বের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বৈচিত্র্যের যথাযথ ভারসাম্যের জন্য 'সাধারণ একরৈখিককরণ' এর বিলোপ এবং বিকেন্দ্রীকরণ অতীব জরুরী। এজন্য প্রয়োজন বিশ্বনাগরিকতার চেতনায় দীক্ষিত এবং তুলনামূলক মূল্যায়নের ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ মননের বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী, যারা নিজস্ব জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিপূর্বক 'ভাষা' নামক মাধ্যমটিকে উৎকৃষ্টরূপে ব্যবহার করবেন।

ভাষাভাষী জনসংখ্যার বিচারে চতুর্থ এই 'বাংলা' ভাষাটি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নেতিবাচকতার পানে অগ্রসর হচ্ছে, যা আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত। রুচিশীল ও নান্দনিক বেশ কিছু শব্দ দিন দিন পুরাতন এবং ব্যবহার সীমা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে যথাযথভাবে ভাব প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক শব্দও। তাছাড়া বহু শব্দের অর্থগত সংকোচন ঘটছে।

আরেকটি প্রবণতা ইদানীং লক্ষণীয়। অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ির মতো ভাষাগত ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইংরেজির মতো একটি প্রভাবশালী ভাষাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমরা অনানুষ্ঠানিক আবহে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করে থাকি। সেই ব্যবহার যথেষ্ট সাবলীলও বটে। কিন্তু বর্তমানে এই ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ শুধু শব্দতেই সীমাবদ্ধ নেই। ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, ইংরেজির কাঠামো অনুসরণ করে এর মধ্যে বাংলার অন্তর্ভুক্তি ঘটছে, যা একটি ভাষায় দীর্ঘদিন চললে ভাষাটি ব্যবহারের সঙ্গে সমান গতিতে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। অর্থাৎ ভাষাটির সর্বোচ্চ প্রমিত রুপ তখন মানুষের কাছে প্রাঞ্জলতা হারাতে থাকে, ধীরে ধীরে ভাষাটি পোশাকি হয়ে পড়ে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে।

একটি ভাষার পরিবর্তনকে ততটুকুর মধ্যেই ভাষাতাত্ত্বিকভাবে স্বীকার করা যায়, যতটুকু পরিবর্তনকে ভবিষ্যতে বৈধতা প্রদানের মাধ্যমে ভাষাটির স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু ভাষাগত স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন যেকোনো অপপ্রয়োগকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। অভিন্ন ধারণা কিংবা সংকেত প্রকাশক দুটি পরস্পর সমার্থক শব্দও কিন্তু পাঠক কিংবা শ্রোতার মনে একই ধরনের দ্যোতনা প্রদান করে না। আবার ব্যক্তিগত গ্রহণের ভিন্নতাকে উপেক্ষা করলে, নেটিভরা তাদের নিজের ভাষায় অন্তর্ভুক্ত শব্দগুলোর ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করার সহজাত পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এজন্যই বলেছিলেন, 'শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ।' তাই ভাষার ব্যাপারটিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখার সময় এসে গেছে।

শব্দের অর্থগত প্রসারণ এবং ব্যবহারিক উন্নয়নের পেছনে প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক এবং কথাশিল্পীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো এবং শৈলীতে ব্যবহৃত হওয়ার মাধ্যমে একটি শব্দ তার নিজস্ব কেন্দ্রীয় অর্থকে ছাপিয়ে যায়, সেই শব্দের সঙ্গে নানা সম্পূরক আবেগ প্রযুক্ত হয় এবং শব্দটি নানা ধরনের ব্যঞ্জনায়-সৌন্দর্যবোধে প্রকাশিত হওয়ার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে থাকে। সময়ের কিংবদন্তিতুল্য পন্ডিত নোয়াম চমস্কি ভাষার যে দুটি স্তর (ব্যবহারকারীর ক্ষমতা এবং প্রয়োগ বা সম্পাদনা) দেখিয়েছেন, সেই দুই স্তরেই বাংলা ভাষা পরস্পর সম্পর্কিতভাবে পিছিয়ে পড়ছে। মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টি কিংবা গবেষণার মাধ্যম হিসেবে বাংলার সীমিত ব্যবহারের দায় তো আছেই, অর্থনৈতিক উপযোগিতার হ্রাসকে মোটাদাগে প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো যায়। কেননা, অন্যান্য সকল কারণই এর সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত।

চাহিদার তুলনায় বাংলায় ভাল কনটেন্টের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য এবং প্রভাবশালী অংশের সাংস্কৃতিক বিনোদনের প্রধান মাধ্যমের জায়গাটিতে বাংলা নেই। বিপরীতক্রমে বলা যায়, প্রভাবশালী এই অংশের অনীহা এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণেও বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে না। প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে গিয়ে আমাদের সমাজ থেকে ভালো শিল্পী কিংবা কলাকুশলীও উল্লেখযোগ্য হারে তৈরি হচ্ছে না। বাংলার নিজস্ব পারম্পরিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙ্গালিদের পরিচয়েরও সুযোগ ঘটছে না তেমন। কিংবা তাদের মনোজগতটাও এমনভাবে তৈরি হচ্ছে না যা বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। তাই মাতৃভাষার জন্য চিরন্তন আবেগকে মৌখিক স্বীকার করলেও উপযোগিতার জায়গাটায় তারা বাংলাকে মোটেই শীর্ষস্থান দিচ্ছে না। এসব কারণে বাংলা সস্তা জনপ্রিয়তার সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে,  'লোকরঞ্জনবাদ' এর কুপ্রভাবে বাংলার প্রমিত এবং নান্দনিক ব্যবহারের জায়গাটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গণ-গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে পত্রপত্রিকা, জার্নাল এবং ম্যাগাজিনেও বাংলার পরিমার্জিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপোষ করা হচ্ছে। অন্যদিকে রেডিও-টেলিভিশনেও যাচ্ছেতাইভাবে নানা কুরুচিপূর্ণ শব্দ এবং পরিমার্জনা-বিবর্জিত অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টিকে সাধারণ বৈধতা দেয়া হয়েছে। অনেক চটুল এবং স্থূল প্রয়োগ প্রমিত বাংলার সমান্তরালেই হচ্ছে এবং এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা।

মানুষকে সহজেই আকর্ষণের কৌশল হিসেবে বিভিন্ন অনলাইন কন্টেন্টের টাইটেলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলা ব্যবহারের সবচাইতে বাজে দৃষ্টান্ত। এভাবেই বাংলা পতিত হয়েছে এমন এক চক্রে, অর্থনীতির 'দারিদ্রের দুষ্টচক্রের' মতোই যা বাস্তব কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদেরকে এই চক্র ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজ ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথ যত উন্মুক্ত হবে, জনসাধারণের কাছে তা ততই দ্রুত এবং সাবলীলভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারবে। একটি দেশের উন্নয়ন মানে সার্বিক জনগণের  উন্নয়ন। তাই জনগণকে সার্বিকভাবে সংযুক্ত করতে হলে মাতৃভাষাতেই করতে হয়। তা না হলে সুযোগ-সুবিধা একটি বিশেষ শ্রেণীর কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। এপারের বাঙালিদের মাতৃভাষার চর্চা এবং বিকাশের জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণ উপযোগী। কেননা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালিত্বের মধ্যে ভাষাগত কোনো বিরোধ নেই।

ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটে প্রবেশ করলেই একটি ফলক চোখে পড়ে যেখানে লেখা, 'বিশ্বমানব হবি যদি, শাশ্বত বাঙালি হ'! চীন এক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা নিজেদের ভাষার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি প্রভাবশালী স্থান অধিকার করতে সমর্থ হয়েছে।। কেননা পৃথিবীর কোনো জাতির জন্যই মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। আব্দুল লতিফের গানের এই চরণগুলো আমাদের সবারই আত্মিক নিবেদন,

'ও আমার এই বাংলা ভাষা
এই আমার দুখ-ভুলানো বুক-জুড়ানো
লক্ষ মনের লক্ষ আশা।'


courtesy : https://roar.media/bangla/main/bangladesh/bangla-language-and-the-reality/

Offline Dipty Rahman

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 102
  • Test
    • View Profile
Re: আমাদের বাংলা এবং বাস্তবতা
« Reply #1 on: February 21, 2020, 11:46:36 PM »
Thank you for sharing
Dipty Rahman
Lecturer
Department of English
Daffodil International University