একুশের গান: কালে কালে যা উজ্জীবিত করে গোটা দেশকে

Author Topic: একুশের গান: কালে কালে যা উজ্জীবিত করে গোটা দেশকে  (Read 1014 times)

Offline Fahmida Afrin

  • Newbie
  • *
  • Posts: 20
  • Test
    • View Profile
    • Fahmida Afrin
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।

কী এক মায়া ভরা গান! শোনার সাথে সাথে গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায়। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। মনের মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত একটা শিহরণ কাজ করে। বুকের চাপা আর্তনাদ চোখ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। সব ঘটনা, সব কিছুই যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে আমাদের। ১৯৫২ সালের সেই একুশে ফেব্রুয়ারি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই আমরা। কালে কালে এই গান উজ্জীবিত করে তোলে গোটা দেশকে। ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের সীমানা পেরিয়ে এই গানের সুরে সুরে ভাষা শহীদদের আত্মদানের ইতিহাস পৌঁছে যায় বিশ্ববাসীর কাছে।

হ্যাঁ, এটাই সেই কালজয়ী একুশের গান। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই চারিদিক থেকে শোনা যায় এই কালজয়ী একুশের গানটি।

একুশের গানের ইতিহাস

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সারাদেশে তখন চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে, ঢাকা শহরে সমস্ত মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) সকালবেলা এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে গুলিবর্ষণ করে।

গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় রাখা হয় লাশগুলো। এই সময় ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। মেডিকেলের আউটডোরে তিনি ভাষা সংগ্রামী রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ দেখতে পান। লাশটি দেখে তার বারবার মনে হতে থাকে, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তখনই এই গানের প্রথম দুটো লাইন তার মাথায় আসে। এরপরের কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি পুরো গানটি লিখে ফেলেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রকাশিত প্রথম লিফলেটে এটা 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৫৩ সালের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমান 'একুশে সংকলনে' ও এটি প্রকাশ করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

'একুশের গান' কবিতাটির প্রথম সুরকার ছিলেন আবদুল লতিফ। তিনি তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেছিলেন। এই গানটি গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এই গানটি প্রথমে আবদুল লতিফ সুর করলেও পরবর্তীতে গানটিতে সুরারোপ করেন সেই সময়ের নামকরা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গাওয়া হয় এটি। এরপর থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই গানটি গেয়ে থাকে বাংলার মানুষ। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১৫টি ভাষায় গাওয়া হয়।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমাদের সবার মুখে মুখে থাকে গানটি। কিন্তু আমরা কি জানি এই গানটির পেছনের মানুষগুলোর কথা। কাদের চেষ্টায় আমরা পেলাম ফেব্রুয়ারির এই অবিনাশী গান?

এই কালজয়ী গানটি সৃষ্টির পেছনে আছে যে মানুষগুলোর হাত, তাঁরা এ দেশেরই সূর্যসন্তান। আসুন জেনে নেয়া যাক তাদের কথা।

আবদুল গাফফার চৌধুরী

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়ার গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এই সময় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কর্মজীবনও পরিপূর্ণভাবে শুরু করে দিয়েছিলেন।

ঢাকায় আসার পরপরই তিনি 'দৈনিক ইনসাফ' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। খুব ছোটবেলা থেকেই তার ঝোঁক ছিল লেখালেখির উপর। সাহিত্যকর্মী হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তরুণ বয়সে তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন, যার অকাট্য দলিল হলো 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'। গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, নাটক,  কবিতা, ছোটদের উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রায় সব অঙ্গনেই তাঁর বিচরণ রয়েছে। 'চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান ', 'সম্রাটের ছবি', 'ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা ', 'পলাশী থেকে বাংলাদেশ ', 'রক্তাক্ত আগস্ট', 'নীল যমুনা' সহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ত্রিশটি।

তিনি অনেক রকম সম্মাননা ও পুরষ্কার পেয়েছেন। এগুলার মধ্যে ১৯৬৩ সালের ইউনেস্কো পুরষ্কার, ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক উল্লেখযোগ্য। প্রবাসে থেকেও তিনি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোয় রাজনীতি, সমসাময়িক বিষয়, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।

আবদুল লতিফ
বাংলাদেশের খ্যাতনামা এই গীতিকার ও সুরকার বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে গানের প্রতি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও গান গাওয়ার জন্য পারিবারিক স্বীকৃতি পেতে তাকে বেশ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে। মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা চলে যান এবং সেখানেই গানের চর্চা চালাতে থাকেন।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসার পর আগস্ট মাসে তিনি রেডিও পাকিস্তানের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি বেশ কিছু আধুনিক ও পল্লীগীতি লিখেন। তাঁর গানগুলো ছিল প্রকৃতির গান, মানুষের সাথে মিশে যাওয়া গান। কীর্তন, কবিগান, জারি-সারি, পালকির গান, পাঁচালি গানগুলো তাকে সঙ্গীত দুনিয়ায় অনন্য এক স্থান দিয়েছে। অনেক গানের মধ্যে তাঁর 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়' এবং 'আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা' বেশ জনপ্রিয়। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ' গানটির প্রথম সুরকারও তিনি ছিলেন। তাঁর লেখা সব গান সংগ্রহ করা না গেলেও ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর গানের বই প্রকাশ করা হয়। তিনি ২০০৬ সালে ভাষার মাসের (ফেব্রুয়ারি) ২৩ তারিখে পরলোকগমন করেন।

আলতাফ মাহমুদ

বাংলাদেশকে আলোকিত করার জন্য এ দেশে বিভিন্ন সময় জন্ম নিয়েছে অনেক গুনীজন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন আলতাফ মাহমুদ। অনেকেই তাঁকে 'সুরের বরপুত্র ' নামে আখ্যায়িত করেন। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার পাতারচর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনার চেয়ে গানের প্রতি আলতাফ মাহমুদের আকর্ষণ ছিল বেশি। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ধুমকেতু শিল্পীসংঘে যোগ দেন। পরে তিনি এখানকার সঙ্গীত পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তখন সারাদেশব্যপী জোরালোভাবে চলছিল ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতেন।

'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ' গানটির সুর করে এখনও আমাদের মাঝে তিনি তাঁর অস্তিত্বের জানান দেন। আনুমানিক ১৯টি বাংলা চলচিত্রে কাজ করেছেন। এগুলার মধ্যে 'জীবন থেকে নেয়া', ' আপন দুলাল', 'সপ্তডিঙ্গা', 'সুয়োরানী দুয়োরানী', 'আগুন নিয়ে খেলা' ,' নয়নতারা' উল্লেখযোগ্য। তিনি শুধু একজন গুনী শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট তাকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে আলতাফ মাহমুদকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। এছাড়াও ২০০৪ সালে দেয়া হয় স্বাধীনতা পুরষ্কার (মরণোত্তর)।

এটা শুধু মাত্র একটা গান না। এটা বাঙালীর আবেগ। এই গানের মাধ্যমেই আমরা তা জানিয়ে দেই পুরো বিশ্বকে। যুগে যুগে বাঙালির হৃদয়ে ভাষা আন্দোলন আর একুশের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে এই একুশের গান।

source:/https://roar.media/bangla/main/bangladesh/a-song-that-inspired-whole-nation/

Offline Dipty Rahman

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 102
  • Test
    • View Profile
Dipty Rahman
Lecturer
Department of English
Daffodil International University