মা ও শিশুর অপুষ্টি: বিজ্ঞজনের মতামত

Author Topic: মা ও শিশুর অপুষ্টি: বিজ্ঞজনের মতামত  (Read 2259 times)

Offline Sultan Mahmud Sujon

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 2674
  • Sultan Mahmud Sujon, Sr. Admin Officer
    • View Profile
    • Helping You Office Operation & Automation Management
বিশ্বে জনগোষ্ঠীতে যে স্বাস্থ্যসংকট, এর একটি বড় অংশের পেছনে রয়েছে মা ও শিশুর অপুষ্টি। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শিশুমৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশ এবং সার্বিক রোগের ১১ শতাংশের কারণ হলো মা ও শিশুর অপুষ্টি। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট-এ মা ও শিশুর অপুষ্টি নিয়ে সারা বিশ্বের নানা গবেষকের প্রকাশিত নিবন্ধমালার সারসংক্ষেপ করলে তা-ই দাঁড়ায়। পাঁচজন বিখ্যাত শিশুবিশেষজ্ঞের বক্তব্য থেকে একটি প্রতিবেদন ল্যানসেট জার্নালের সম্পাদক রিচার্ড হর্টন তুলে ধরেন।
স্বাস্থ্যসমস্যা বিবেচনা করতে গিয়ে পুষ্টি বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়নি। মা, নবজাতক শিশু ও শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পুষ্টিসমস্যা গুরুত্ব পায়নি মোটেও। এই অবহেলার বিষয়টি হয়তো বোধগম্য; কিন্তু যুক্তিযুক্ত নয়, অবশ্যই। রিচার্ড হর্টন এই প্রতিপাদ্যটি তুলে ধরে বিভিন্ন সংস্থা, দাতা সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এই গুরুত্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আহ্বান জানান। ‘সব শিশুমৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশ—৩৫ লাখের বেশি শিশুমৃত্যুর প্রতিরোধযোগ্য বড় কারণ হলো—অপুষ্টি, খর্বতা, গুরুতর শীর্ণতা এবং গর্ভের শিশুর বাড়ন রোধ হলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এটি প্রতিরোধের সুবর্ণ সময় হলো গর্ভকাল থেকে শিশুর দুই বছর পর্যন্ত বয়স। দুই বছর বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর অপুষ্টির কারণে যে ক্ষতি, তা পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাড়নে অপূরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুষ্টিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বও অনুপস্থিত, সম্পদ অত্যন্ত সীমিত, ক্ষমতাও ভঙ্গুর। আর এ জন্য জরুরি প্রয়োজন দ্রুত সাড়া দেওয়া।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে শিশুমৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশের বেশি এবং রোগের মোট বোঝার ১১ শতাংশের কারণ হলো মা ও শিশুর অপুষ্টি। আর মা ও শিশুর অপুষ্টি খুব বেশি দেখা যায় নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়। আর এ জন্য মৃত্যুহার ও রোগের প্রবণতা মোটামুটি অনেক বেড়েছে। এই পরিণতি এড়াতে জরুরি তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গর্ভের শিশুর বাড়নে ত্রুটি বা জন্মের পর দুই বছর পর্যন্ত খর্বতা পরবর্তী জীবনে আনে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব। এ ক্ষতি হতে পারে অপূরণীয়, খর্বতা হতে পারে, বিদ্যালয়ে পারফরম্যান্স ভালো না-ও হতে পারে, রোজগার কমে যেতে পারে, সন্তানদের জন্ম-ওজন কম হতে পারে। গবেষকেরা নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় মা ও শিশুর অপুষ্টির সঙ্গে সেসব দেশে বয়স্কদের রোগের ঝুঁকির একটি সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। আর এ জন্য ব্রাজিল, গুয়াতেমালা, ভারত, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষণাগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছেন, দুই বছর বয়সে শিশুদের অপুষ্টির সূচকগুলো পূর্ণবয়স্ক হলে কী পরিণতি আনবে, এর সঙ্গে বেশ সম্পর্কযুক্ত। এ ছাড়া তাঁরা আরও দেখালেন, যেসব শিশু জন্মের প্রথম দুই বছরে অপুষ্ট থাকে এবং শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে যাদের শরীর স্থূল হয়ে যায়, তাদের পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ক্রনিক রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়ে। তবে জন্মের পর প্রথম দুই বছর দ্রুত ওজন বৃদ্ধি বা দ্রুত লম্বা হওয়া ঘটলে, এমনকি যেসব শিশুর মায়ের গর্ভে বাড়ন খর্ব হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রেও ক্রনিক রোগের ঝুঁকি বাড়ে না।

গবেষকদের বক্তব্য
প্রথম জীবনে যে ক্ষতি হয়, এতে স্থায়ী প্রতিবন্ধক ঘটতে পারে, এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এর প্রভাব পড়ে। একে প্রতিরোধ করলে ঘটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে বড় রকমের সুফল।
তাই বলা যায়, মা ও শিশুর পুষ্টি বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে শিশুমৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ প্রতিরোধ করা যাবে। অপুষ্টির বড় ভার যে ৩৬টি দেশে রয়েছে, সেসব দেশে এ বোঝা অনেক হালকা হবে। শিশুমৃত্যু হ্রাসের সম্ভাবনাময় একটি কৌশল হলো, মায়ের স্তন দুধদান ও শিশুকে ভিটামিন-এ বড়ি খাওয়ানো। শিশুর বাড়নের ধরন ও মৃত্যুঝুঁকিকে নানা পুষ্টি উপাদান প্রভাবিত করে, তাও দেখা হয়েছে। যেসব জনগোষ্ঠীতে খাদ্যের প্রাচুর্য, সম্পূরক খাদ্য সম্পর্কে ভালো ধারণা রয়েছে, এসব লোকের সমাজের মধ্যে বয়স অনুপাতে দৈহিক উচ্চতা ভালো, আবার যেসব জনগোষ্ঠীতে খাদ্যের অভাব, তাদের মধ্যে সম্পূরক খাদ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। গবেষকেরা আরও দেখেছেন, তীব্র অপুষ্টিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শসূচি অনুযায়ী চিকিৎসা করলে মৃত্যুহার ৫৫ শতাংশ কমানো গেছে। তবে এ জন্য তাদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়েছে। কেবল পুষ্টি-কৌশলই সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট নয়, মা ও শিশুর অপুষ্টি মোকাবিলা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা বড় প্রয়োজন।
পৃথিবীর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর ৮০ শতাংশ রয়েছে মাত্র ২০টি দেশে, সেসব দেশে জোরালো পুষ্টি প্রকল্প গ্রহণ করলে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বেশ কমানো সম্ভব। জাতীয় অগ্রাধিকার থাকবে পুষ্টি কার্যক্রমে। লাতিন আমেরিকান দেশগুলোয় এসব কার্যক্রম গ্রহণ করে খর্বতা, কম ওজন ও শীর্ণতা অনেক কমানো গেছে। চীনে বহুধাবিস্তৃত প্রকল্প ফলপ্রসূ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পুষ্টি কার্যক্রমের ধরন কী রকম?
বহুধাবিভক্ত, অকার্যকর—সে কার্যক্রমের জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজন একটি সংস্কারের। আন্তর্জাতিক ও দাতা সংস্থা, একাডেমিয়া, সিভিল সোসাইটি এবং প্রাইভেট সেক্টর—এদের মধ্যে এমন অবস্থা—অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক এসব সংস্থাকে নাজুক ও শিথিল বন্ধনে আবদ্ধ করেছে অথচ আন্তর্জাতিক পুষ্টি কার্যক্রমে চার ধরনের সুযোগ মানুষের জন্য সৃষ্টি করা উচিত—তত্ত্বাবধান, অর্থনৈতিক সম্পদ আহরণ ও সংগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে সরাসরি পুষ্টি জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা, মানব ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদকে শক্তিশালী করে তোলা। বর্তমানে এর প্রতিটি ধাপে রয়েছে অনেক ঘাটতি।
বহুধা-বিভাজন, অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা ও ব্যর্থতা এবং সমাজে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারার দুর্বলতা।

এসব সংস্কার এখন সময়ের দাবি
এসব বিষয় বাস্তবায়ন করলে, আন্তর্জাতিক পুষ্টি কার্যক্রম জোরালো করে ও সমন্বিত করলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত অনেক দেশে প্রতিবছর জন্মগ্রহণকারী ছয় কোটি ৭০ লাখ শিশুর জন্য আরও ভালো, আরও উৎপাদনমুখর জীবন দেওয়া যাবে।

শুভাগত চৌধুরী পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৮, ২০১০