নবজাতকের খিঁচুনি

Author Topic: নবজাতকের খিঁচুনি  (Read 1804 times)

Offline Sultan Mahmud Sujon

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 2674
  • Sultan Mahmud Sujon, Sr. Admin Officer
    • View Profile
    • Helping You Office Operation & Automation Management
নবজাতকের খিঁচুনি
« on: January 03, 2012, 08:20:24 AM »
কেস স্টাডি
তিন দিনের ছোট্ট শিশু, হাত-পা খিঁচে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। গায়ে জ্বর। মা-বাবা চিকিৎসকের কাছে নিতে চাইলেন। দাদার কড়া নিষেধ, ‘সাত দিনের আগে এই ছোট্ট শিশুকে ঘর থেকে বের করা যাবে না। আর ডাক্তার কী-ই বা করবে? এ তো হচ্ছে ভূতের আছর। ভালো করে ঝাড়ফুঁক করলেই ভূত পালানোর পথ পাবে না।’ আসেন এলাকার সবচেয়ে কামেল ফকির। ফুঁ দেন। তেলপড়া দেন। মাকে তিন দিন গোসল করতে নিষেধ করেন। কিন্তু এ যেন শক্ত ভূত! কিছুতেই ছাড়ে না। খিঁচুনি বন্ধ হয় না। দুই দিন পর বাচ্চা দুধ খাওয়া বন্ধ করে আরও নির্জীব হয়ে যায়। মা-বাবার মন আর মানে না। সাত দিন পার হওয়ায় দাদাও কিছুটা নমনীয় হন। মুমূষুê শিশুকে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসকের কাছে। তিন সপ্তাহ ধরে চলল জীবন-মৃত্যুর এক অসম যুদ্ধ। নিবিড় পরিচর্যার পর নবজাতক বেঁচে গেল। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ রয়ে গেল অনিশ্চিত।

চিকিৎসাযোগ্য রোগ নবজাতকের মেনিনজাইটিসের এ হলো এক অনভিপ্রেত পরিণতি। তবে মেনিনজাইটিসই নবজাতকের খিঁচুনির একমাত্র কারণ নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক হাজার জনের মধ্যে ১৪টি নবজাতকেরই জ্নের পর খিঁচুনি হতে পারে।

মস্তিষ্ক-কোষের ভেতরে ও বাইরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ভারসাম্যে ব্যাঘাত অথবা উদ্দীপক ও নিস্তেজক রাসায়নিকের ভারসাম্যহীনতার কারণে সাধারণত খিঁচুনি সৃষ্টি হয়। সাধারণ কারণগুলো হচ্ছে-

    জন্মের পরপরই অক্সিজেন-স্বল্পতাঃ জ্নের প্রথম ২৪ ঘণ্টায় সাধারণত এ ক্ষেত্রে খিঁচুনি হয়।
    মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণঃ অক্সিজেনের অভাবে এ ব্যাপারটি ঘটে।
    শর্করা-স্বল্পতাঃ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের শিশু ও অপুষ্ট নবজাতকের এ সমস্যা হয়।
    ক্যালসিয়ামের স্বল্প মাত্রাঃ জ্নকালীন স্বল্প ওজন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের শিশু, বিরল ডিজর্জের রোগ এবং প্যারাথাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত মায়ের শিশুর সাধারণত ক্যালসিয়ামের মাত্রা নি্নগামী থাকে। এ ক্ষেত্রে
    ম্যাগনেশিয়ামও কম থাকতে পারে।
    সোডিয়াম-স্বল্পতাঃ তরল ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে এটি হতে পারে।
    সোডিয়ামের আধিক্যঃ মায়ের দুধ কম খাওয়া অথবা ভুলভাবে বানানো কৃত্রিম দুধের কারণে এটি হতে পারে।
    পাইরিডক্সিনের স্বল্প মাত্রাঃ এরা মাতৃগর্ভেই খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণ খিঁচুনির ওষুধ দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
    সংক্রমণঃ মেনিনজাইটিস রোগ হওয়া।
    মায়ের ওষুধঃ মা যদি হেরোইন, মিথাডোন সেকোবারবিটাল বা অ্যালকোহলে আসক্ত থাকেন, তাহলে এগুলো বাদ দিলেই শিশু খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতে পারে। নবজাতকের অপরিণত মস্তিষ্কের কারণে বিভিন্ন রকম খিঁচুনি হতে পারে।
    মৃদু খিঁচুনিঃ অপরিণত নবজাতকের এটি বেশি হয়। বড়দের খিঁচুনির সঙ্গে এর মিল নেই। চোখ ডানে বা বাঁয়ে ঘোরে। চোখের পাতা ঘন ঘন নড়ে। চোখ-মুখ কোঁচকানো বা লালা পড়ার ভঙ্গি করে। সাঁতার, বৈঠা বাওয়া বা সাইকেল চালানোর ভঙ্গি করে। কখনো কখনো শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
    স্পষ্ট খিঁচুনিঃ এখানে মাংসপেশির ঝাঁকুনির মতো হতে পারে। আবার মাংসপেশি টানটান হয়ে যেতে পারে।

এখানে বলা ভালো, যেকোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধরলে যদি খিঁচুনি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এটি প্রকৃত খিঁচুনি নয়।

খিঁচুনিতে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে কিছু তথ্য জানা অবশ্যই দরকার; সেগুলো হচ্ছে-

    বংশে অন্য কোনো শিশুর খিঁচুনির ইতিহাস আছে কি না।
    মা কোনো ওষুধ নিয়েছেন কি না।
    জন্মকালীন এবং জন্মের আগে ও পরের সমস্যা; কীভাবে, কোথায় জন্ম হয়। মায়ের গর্ভাবস্থায় কোনো সংক্রমণ ছিল কি না, যা শিশু পেতে পারে।

শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশেষভাবে জানতে হয়-

    গর্ভাবস্থার সময়।
    রক্তচাপ।
    ত্বকে কোনো অস্বাভাবিকতা।
    যকৃৎ ও প্লীহার আকার।

স্মায়ুতন্ত্রের পরীক্ষাঃ স্মায়বিক কোনো সমস্যা আছে কি না।
খিঁচুনির ধরনঃ পুরো শরীর, না অংশবিশেষে খিঁচুনি হয়। এর সঙ্গে অজ্ঞান হয় কি না।
খিঁচুনির কারণ বোঝার জন্য রক্তের গ্লুকোজ, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদির মাত্রা জানা দরকার।
দরকার মেরুমজ্জার রসের পরীক্ষা।
বিশেষ ক্ষেত্রে আরও জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয়।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ সন্দেহ করলে ব্রেইনের আলট্রাসনোগ্রাম ও সিটি স্ক্যান করা যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলট্রাসনোগ্রামই যথেষ্ট।
ভবিষ্যৎ পরিণতি বোঝার জন্য ইইজি পরীক্ষাও করা যেতে পারে।

কারণ যা-ই হোক, ঘন ঘন খিঁচুনি মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে। এ জন্য দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্লুকোজ বা ক্যালসিয়ামের অভাব হলে এগুলো সাবধানে শিরাপথে দিতে হবে।
বিশেষভাবে দরকার খিঁচুনি-প্রতিরোধক ফেনোবারবিটন বা ফিনাইটয়েন-জাতীয় ওষুধ। বিশেষ এক ধরনের খিঁচুনি এর কোনোটা দিয়েই নিরোধ করা যায় না; সেখানে দরকার হয় পাইরিডক্সিন।
কত দিন চলবে খিঁচুনি-প্রতিরোধক ওষুধ-এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। তবে অনেকেই মনে করেন, খিঁচুনি বন্ধ হয়ে গেলে দুই সপ্তাহ পর ওষুধ বন্ধ করা যায়।
প্রসব-ব্যবস্থাপনা ও নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যার উন্নতির ফলে খিঁচুনি চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। মৃত্যুহার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। তার পরও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি নবজাতকের খিঁচুনির পর স্মায়ুতন্ত্রের স্থায়ী বৈকল্য থেকে যেতে পারে। বিশেষ করে মস্তিষ্কের জ্নগত ত্রুটি থাকলে ভবিষ্যতে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই নবজাতকের খিঁচুনি দ্রুত নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০০৮।
ডা· মাহবুব মোতানাব্বি