করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ: মোবাইল গতিবিধি এবং নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ

Author Topic: করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ: মোবাইল গতিবিধি এবং নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ  (Read 958 times)

Offline Md. Abul Bashar

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 177
  • Test
    • View Profile

করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ: মোবাইল গতিবিধি এবং নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ


যাতায়াত তথ্যগুলো ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি নিখুঁতভাবে পাওয়া সম্ভব--মূলত টেলিকম সার্ভিসগুলোর কাছ থেকে। প্রতীকী ছবিযাতায়াত তথ্যগুলো ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি নিখুঁতভাবে পাওয়া সম্ভব--মূলত টেলিকম সার্ভিসগুলোর কাছ থেকে। প্রতীকী ছবিকরোনাভাইরাস কী করে ছড়াবে, কার মাধ্যমে ছড়াতে পারবে, সঠিকভাবে গণনা করার জন্য বিশ্বে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০টি করে পরিসংখ্যানের নতুন মডেল তৈরি হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, জনসাধারণের জানমালের রক্ষার নীতিমালা শুধু একটি কম্পিউটার সিমুলেশন দিয়ে সম্ভব নয়। দরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য, উপযুক্ত প্রমাণ এবং প্রয়োগকৌশলের স্বচ্ছতা। এত অল্প সময়ে আমরা এই উপকরণগুলো কী করে পাব?

উত্তরটি খুব সোজা। আমাদের মুঠোফোনের মধ্যেই আছে সবচেয়ে সহজ সমাধান। আমাদের মুঠোফোন কী করে কাজ করে? মোবাইল কোম্পানিগুলো সারা দেশের আনাচকানাচে হাজার হাজার টাওয়ার তৈরি করে রেখেছে। আপনি যখন সিম কার্ড ব্যবহার করে ফোন করেন, তখন কলটি নিকটস্থ টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্রমণ করার সময়ে কী হয়? তখন আপনার কলটি ফুটবলের পাস দেওয়ার মতো এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে স্থানান্তরিত হয়। প্রতিটি মোবাইল কোম্পানি প্রতি মুহূর্তে এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, মোবাইল কী করে কাজ করে, তার সঙ্গে করোনাভাইরাসের কী সম্পর্ক? কয়েক সপ্তাহ আগে যখন অফিস, আদালত, গার্মেন্টস ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সাধারণ মানুষের দেশের বাড়ি যাওয়ার ঢল নেমেছিল। আমরা জেনেছি যে ব্যাপারটা ক্ষতিকর। কারণ, তাদের মাঝে কারও যদি করোনাভাইরাস থেকে থাকে, তা এখন অনায়াসে ছড়িয়ে যাবে পুরো বাংলাদেশে। ঢাকা বহির্গামী মানুষগুলোর গতিবিধির মাত্রা কিন্তু খুব সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব তাদের মোবাইল ফোনের এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারে যাওয়ার নমুনায়।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য গতিবিধিও নির্ণয় করা সম্ভব। যেমন করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত দূর-দূরান্তে যাতায়াত করে থাকেন, তাহলে সেই এলাকাগুলোকে অনতিবিলম্বে শনাক্ত করে ঝুঁকিমুক্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দূরপাল্লার পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতালে বা ব্যাংকে যাতায়াতেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।

রোগ ছড়ানোতে বিভিন্ন দূরত্বের বা মাত্রার যাতায়াত যেমন সমান ভূমিকা রাখে না, তেমনি সব এলাকার গুরুত্ব এবং ভূমিকাও কিন্তু সমান নয়। বহু এলাকার সঙ্গে যাতায়াত যোগাযোগ আছে এমন এলাকাগুলো স্বভাবতই বেশি ঝুঁকিতে থাকবে, কারণ বিভিন্ন উৎস থেকে ভাইরাস সেখানে পৌঁছাতে পারে। এভাবে, বিভিন্ন এলাকার সংক্রমণ ও তাদের মধ্যকার যাতায়াত তথ্য কাজে লাগিয়ে ভাইরাস ছড়ানোর ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব। আর এই কাজে নেটওয়ার্ক সায়েন্স দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি কার বেশি, সেটাও নির্ণয় করা সম্ভব। ছোট্ট এক উদাহরণ দেখা যাক। ধরুন, আপনার পাড়ার মানুষজনের কাছে আপনি একটি তথ্য পৌঁছাতে চান। এলাকার একজন স্কুলশিক্ষক হয়তো সে ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন, কেননা ওই এলাকার প্রচুর মানুষের সঙ্গে হয়তো শিক্ষকের দেখা সাক্ষাৎ হয়ে থাকে, এবং তাতে আস্থার একটি সম্পর্ক আছে। আবার ধরুন, আপনি আপনার পণ্যের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিতে চান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়তো এমন কেউ বিজ্ঞাপনটি শেয়ার করলেন, যাঁকে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার মানুষ ফলো করেন। বিজ্ঞান বলছে, সে ক্ষেত্রে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। লক্ষ করুন, দ্বিতীয় ব্যক্তির ভূমিকা কিন্তু শিক্ষকের থেকে ভিন্ন। শিক্ষক যেখানে একই এলাকার অভ্যন্তরে ভূমিকা রাখছিলেন, দ্বিতীয়জন বিভিন্ন এলাকা/বয়স/পেশাগোষ্ঠীর মাঝে তথ্য ছড়াতে সাহায্য করছেন। কারও পেশা, শিক্ষা, লিঙ্গ, লেখালেখির মান বা অন্য কোনো তথ্য না জেনেই, কেবল কে কার সঙ্গে অনলাইনে বা অফলাইনে যোগাযোগ রাখেন, সেই ‘নেটওয়ার্ক’ তথ্য থেকে গাণিতিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব কোনো ব্যক্তি কী ধরনের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন।

নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি বা এলাকাগত তথ্যও খুব সহজেই বের করা সম্ভব। আমরা জানি যে সিলেটে ১৩টি উপজেলা আছে। ধরে নিই যে প্রতিটি উপজেলা কেবল সীমান্ত সংযোগ আছে, এমন প্রতিবেশী উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। শুধু এটুকু তথ্য থেকেই নির্ণয় করা সম্ভব যে সিলেট সদর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলাগুলোর একটি, কেননা সদরের সঙ্গে ছয়টি উপজেলার সীমান্ত সংযোগ আছে। চিত্রে সবুজ বৃত্ত দিয়ে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলাগুলো দেখানো হয়েছে। উপজেলাগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য যোগাযোগ বা রাস্তাঘাট কেমন আছে, সেই তথ্যও যদি আমাদের হাতে থাকে, এলাকাগুলোর আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং ভূমিকা আরও নিখুঁতরূপে নির্ণয় করা সম্ভব।

করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা সম্পূরক তথ্য পেতে পারি। যেমন, কোন এলাকায় প্রকোপ কী রকম, আদমশুমারি অনুযায়ী বয়সের বণ্টন কী রকম, বা আন্তঃএলাকা যোগাযোগ কী রকম। এই তথ্যগুলো একীভূত করে জরুরি নীতিমালা প্রণয়নে এ ধরনের নেটওয়ার্কভিত্তিক বিশ্লেষণ সহজ এবং দ্রুত সমাধান দিতে পারে। এটা কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কম্পিউটার সিমুলেশন নয়। বরং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সংগৃহীত তথ্যের সদ্ব্যবহার।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলো কোন এলাকায় কত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছেন তা ফোনকল/খুদে বার্তা/অ্যাপের মতো বিভিন্ন উপায়ে জনসাধারণের কাছ থেকে জেনে মানচিত্রে দেখানোর চেষ্টা করা। সঙ্গে আইইসিডিআরের সংক্রমণ তথ্য তো আছেই। মানচিত্রে তথ্যগুলোর দিকে একনজর তাকালেই যেন বোঝা যায়, কোন এলাকায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

তবে শনাক্তকৃত বা সন্দেহভাজন কয়জন একটি এলাকায় এখন আছেন, কেবল সেটুকু তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না ভাইরাস অন্যত্র ছড়ানোর গতিপ্রকৃতি ঠিক কী রকম হতে চলেছে। সে ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে পাওয়া তথ্য: যাতায়াত বা মবিলিটি।

দেশে এখন লকডাউন চলছে, যোগাযোগ স্বাভাবিকের চেয়ে সীমিত। তবু মানুষকে ব্যাংকে বা বাজারে যেতে হতে পারে, জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে যেতে হতে পারে, ফলে কিছু যাতায়াত থাকা অস্বাভাবিক নয়। দুজন মানুষ কাছাকাছি বা সংস্পর্শে এলে তাদের মাঝে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা এলাকাভিত্তিক যোগাযোগ সামনে রেখে তেমনভাবে বলতে পারি, দুটি এলাকার মাঝে দৈনিক যত বেশি মানুষ যাওয়া-আসা করবে, এক এলাকা থেকে অন্যটিতে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কাও তত বেশি হবে। সেই ‘এলাকা’ হতে পারে থানা বা গ্রাম, হতে পারে মোবাইল সেবাদাতার একটি টাওয়ারের কভারেজ এলাকা।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, সরকারি সংক্রমণ হিসাব এবং জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত লক্ষণমাত্রার তথ্য থেকে আমরা জানলাম, A ও B এলাকায় সংক্রমণ বেশি ঘটেছে। প্রথম চিত্রে সেটি লাল রঙে দেখানো হয়েছে। বাকি এলাকাগুলো থেকে সে রকম কোনো তথ্য জানা গেল না, ফলে সেগুলোর আপাত কম ঝুঁকি সবুজ রঙে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে, আন্তঃএলাকা যাতায়াত তথ্য আমাদের জানাতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে A, B ও C এলাকাগুলোর মাঝে বেশ যাতায়াত ঘটেছে (দ্বিতীয় চিত্রে গাঢ় দাগে দেখানো হয়েছে)। এই তথ্য থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি, C এলাকায় ভবিষ্যৎ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে C এলাকাকে দ্রুত সাবধান করে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সেখানে আদৌ কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়ার আগেই।

আর এই যাতায়াত তথ্যগুলো ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি নিখুঁতভাবে পাওয়া সম্ভব—মূলত টেলিকম সার্ভিসগুলোর কাছ থেকে। ওপরে যেমনটা বলা হলো, ঠিক কোন কোন সিম কার্ড একটি টাওয়ার থেকে সেবা নিচ্ছে এবং সেই ফোনগুলো ঠিক কোথায় আছে, সে তথ্য দারুণ দক্ষতার সঙ্গে মনিটর করা হয়, উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করার স্বার্থে। ধরুন, আমার এলাকা থেকে আজ সর্বমোট ২০ জন মানুষ পাশের এলাকায় গেলেন এবং দিন শেষে ফিরে এলেন। মোবাইল ফোন সেবাদাতারা সেই তথ্য অতি দ্রুত জানাতে সক্ষম।

এভাবে পুরো দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যকার যাতায়াত তথ্য একত্রে নিলে আমরা পেয়ে যাব একটি ‘নেটওয়ার্ক’। সেই নেটওয়ার্ক থেকে আমরা সহজেই হিসাব করতে পারি, কোন এলাকা ভাইরাস ছড়ানোতে ঠিক কতটুকু শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম, শনাক্তের মাত্রানির্বিশেষে কোন এলাকায় ঝুঁকি কী রকম এবং কোথায় পদক্ষেপ নেওয়া কেমন জরুরি। এর সঙ্গে শনাক্তকৃত/সন্দেহভাজন রোগীর তথ্য একীভূত করে ভাইরাসের ভবিষ্যৎ বিস্তার নির্ণয় করা সম্ভব। একই সঙ্গে সম্ভব তথ্যের শুদ্ধতা যাচাই করা, এমনকি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকেও জ্ঞান আহরণ করা। যাতায়াতের তথ্য ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নতুন নয়। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার নির্ণয়ে এই তথ্য কাজে লাগানো হয়ে না থাকলে জরুরি ভিত্তিতে তা আমলে নেওয়া যেতে পারে।

অতি–আধুনিক কিছু উদ্ভাবন, যেমন গ্রাফ সিগন্যাল প্রসেসিং, গ্রাফ নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং স্ট্যাটিস্টিকাল নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিসের মতো প্রযুক্তিগুলো এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যাতায়াত এবং লক্ষণমাত্রার তথ্য ব্যবহার করে এই প্রযুক্তিগুলো দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য জ্ঞান তৈরি করতে সক্ষম। ফলে এই জরুরি সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এগুলো দারুণ কাজে আসতে পারে। উপরোক্ত প্রযুক্তিগুলোর সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি অপব্যবহারও সম্ভব। তাই দরকার যাতায়াত তথ্যের বিশ্লেষণ যথাযথ নীতিমালা দিয়ে নির্ধারণ করা। না হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়াসহ নানা অপব্যবহার ঘটতে পারে, যা সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

এহসান হক: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার, যুক্তরাষ্ট্র
রাইয়্যান আবদুল বাতেন: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার, যুক্তরাষ্ট্র