Entertainment & Discussions > Story, Article & Poetry

মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি (যুগান্তর, ১৯ জুন ২০২০; পৃষ্ঠা ৪)

(1/1)

kekbabu:
মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ১৯ জুন ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, শিশু শ্রমিক, সংখ্যালঘু এবং বেআইনি অভিবাসীরা প্রচণ্ডভাবে শোষিত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। আর আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, মানব পাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা উদ্বেগজনক। অভাবের তাড়নায় বা অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে বা উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হচ্ছে। উন্নত জীবন আর ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থলোভী, অসৎ লোক এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবে অনেক মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

২৭ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। লিবিয়ার মানব পাচারকারী এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা ওই ৩০ অভিবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ওই মানব পাচারকারী আগেই মারা যায়। সেই মৃত্যুর দায় তার আত্মীয়স্বজন এসব অভিবাসীর ওপর চাপায়। আর প্রতিশোধ নিতেই এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার পর মানব পাচারের বিষয়টি এখন আলোচনায় এসেছে। এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। এরপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। আর ওইসব গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশির লাশ; যাদের অধিকাংশই মানব পাচারের শিকার। খবরে প্রকাশ, ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে শুধু কক্সবাজার জেলা থেকেই পাচার হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষ। এমনও দেখা গেছে, ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে নির্যাতনের কারণে আর খাদ্যের অভাবে সাগরেই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে। আর এভাবেই উন্নত জীবনের আশায় অনেকের বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন ভেসে গেছে সাগরে, আবার কখনো বা সেই স্বপ্নের কবর রচিত হয়েছে গহিন বনে, গণকবরে আর পতিতা পল্লীতে।

বাস্তবতা হচ্ছে, মানব পাচার সংক্রান্ত ঘটনায় অনেক মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব মামলার তদন্ত ও বিচার এগোয় না। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১২ সালে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত প্রায় ৬ হাজার মামলা করা হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এসব মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৫৪ জনের। আর মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির হারই খুব কম, যা দুঃখজনক। মূলত পাচারের শিকার অধিকাংশ পরিবারই ভোগান্তি ও সমস্যার মধ্যে দিন যাপন করে এবং মানব পাচারকারী ও দালালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্দার আড়ালে বা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ফলে মানব পাচার বন্ধ হয় না। আবার মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্তে ঘাটতি থাকায় অনেক আসামি খালাস পেয়ে যায়। মানবাধিকারকর্মীরা প্রায়ই অভিযোগ করে বলেন, দেশে আইনের শাসন থাকলে এত মানুষ পাচারের শিকার হতো না। মানব পাচারকারীরা অনেককেই টাকার ভাগ দেন। তাই এটি বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে দেশে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কক্সবাজার জেলা। এ জেলায় এ পর্যন্ত মানব পাচারের ৬৩৭টি মামলা হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। অর্ধেক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে আর খারিজ হয়ে গেছে ১৬টি মামলা। আগে দেশে মানব পাচারবিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানব পাচার সংক্রান্ত অপরাধের বিচার করা হতো। ২০১২ সালে দেশে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ নামক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারায় মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটির ৭ ধারায় সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইনের অধীনে কৃত অপরাধগুলো কগনিজেবল বা আমলযোগ্য অপরাধ, আপস ও জামিনের অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর গত আট বছরে এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৭১৬। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৪ শতাংশ। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মানব পাচার সংক্রান্ত বিচারের জন্য আলাদা করে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান ছিল। অথচ আইন পাসের ৮ বছর পর সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আদেশ হয়েছে। অনেক বিচার এখনও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই হচ্ছে। মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। তবে এর চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে, মানব পাচার মামলায় আদালতে পুলিশ কর্তৃক সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়া। মানব পাচার মামলায় সাধারণত নিয়মিতভাবে সাক্ষী পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগীরা সহায়তা না করলে এ ধরনের মামলা প্রমাণ করা শেষ পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। মানব পাচার আইন ২০১২-এর সঠিক প্রয়োগসহ সরকারিভাবে দেশে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে এবং জনগণ দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার মনমানসিকতা পরিহার করলে মানব পাচারের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। যেহেতু দেশে মানব পাচারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে, তাই মানব পাচার রোধে এ আইনের সঠিক প্রয়োগের বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এ বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই তৎপর হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ হবে না এবং মানব পাচারকারীরাও শাস্তি পাবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/317300/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%AC-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF

Navigation

[0] Message Index

Go to full version