
শুরুতেই সকল শিক্ষার্থীদেরকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। চলমান এই বৈশ্বিক ক্রান্তিকালে হাজারো বাধা বিপত্তি স্বত্ত্বেও পড়ালেখা তথা ভবিষ্যৎ কে চলমান রাখার জন্য একটা ধন্যবাদ তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ নামক করোনা ভাইরাস আগমনের পঞ্চম মাস পেড়িয়ে ছষ্ঠতম মাস চলছে। বিশ্বব্যাপি সবকিছু এখনও অনেকটাই অস্বাভাবিক, বাংলাদেশেও তেমনটাই চিত্র। অনেক কিছুই বাধ্য হয়ে আসতে আসতে সীমিত থেকে বৃহৎ পরিসরে খুলছে বা খুব শিগগিরই খুলবে বলে মনে হচ্ছে। আসছে কোরবানি ঈদের পর অফিস-আদালত, শপিংমল, কল-কারখানা অনেকটাই পুরোদমে খুলে যাবে মনে হচ্ছে। চারপাশের আবভাব তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে উল্লিখিত সবকিছু খুলে যাওয়া মানে কিন্তু এটা নয় যে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে বা কমতে শুরু করেছে। জীবিকার তাগিদে হয়ত আমরা অনেকেই বের হতে বাধ্য হব। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে জীবন বাঁচলে তবেই জীবিকা। যাহোক, কথা না বাড়িয়ে কাজের কথায় আসি। সবকিছু খুললেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়তো এখনি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আসবে না। এই সিদ্ধান্ত নেয়াটাও বেশ কঠিন। কেন কঠিন তা নিজেরা বুঝতে না পারলেও তোমাদের মা বাবা, বিশেষ করে মা’রা বলতে পারবেন। আর এ জন্যই আরো কিছু দিন হয়ত অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রথম দিকে অনেক বাধা বিপত্তি থাকলেও আসতে আসতে এই প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমরা নিজেকে অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছি, হোক সেটা বাধ্য হয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস নিয়ে অনেক ট্রল দেখি। সেসব দেখতে, সত্যি বলতে আমার নিজের ও ভাল লাগে, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটু হলেও হাসতে পারি মন খুলে। ট্রল গুলোতে দেখানো হয় শিক্ষক সুন্দর টাই-শার্ট পরিহিত। শেষের দিকে দেখানো হচ্ছে স্যার লুঙ্গি পড়ে আছেন। ট্রল হলেও এটা কিন্তু অনেকটাই বাস্তব। অনেকের কথা বলতে পারব না, তবে আমি লুঙ্গি পরেই ক্লাস নেই এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিয়েল এস্টেট বিভাগে সেমিনার ও দিয়েছিলাম লুঙ্গি পরেই। কতটুকু পেরেছি জানি না তবে এতটুকু বলতে পারি অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সময় নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে কোন গড়িমসি করি নাই। আর পড়ালেখার গুনগত মান নিশ্চিত করার জন্য পোশাক নয় বরং শিক্ষকদের আন্তরিকতাই বেশি গুরুত্বপুর্ন। শিক্ষকতার মত মহান পেশায় যারা নিজেকে নিয়োজিত করেন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর ব্যাপারে তাঁদের আন্তরিকতার ঘাটতি কোনভাবেই কাম্য নয়। অনলাইন ক্লাস সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ সফলতা দাবি করছে। আর একটু গর্ব করেই বলতে পারি অনলাইন ক্লাসের গুনগত মানের ক্ষেত্রে আমার ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই সবচেয়ে ভাল না হলেও অনেকের চেয়ে ভাল করে আসছে। বাংলাদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয় ই প্রথম অনলাইনে সফল কার্যক্রম শুরু করে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণন করার জন্য বলছি না, এটা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি। এ তো গেল অনলাইনে ক্লাস নিয়ে কথা। এখন আসি অনলাইনে পরীক্ষা ব্যাবস্থা নিয়ে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এই পরীক্ষাই শিক্ষার্থীদের মান বা যোগ্যতার নির্নায়ক। আর পরীক্ষার সাথে নীতি বা নৈতিকতার আছে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যেটাকে ইংরেজীতে আমরা ethics বলি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন পর্যন্ত দেখছি পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে কতটা অবিশ্বাস করে। এখন শিক্ষক হিসেবে নিজেও তাই করি। এই অবিশ্বাস কিন্তু প্রকৃত পক্ষে শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্যই। তাঁদের পড়ালেখা তথা পরীক্ষার ফলাফলের গুনগত মান উন্নয়ন করার জন্যই, যা অন্যের কাছে তাঁদের গ্রনহনযোগ্যতা বাড়াবে। বাস্তবতা হচ্ছে, একটু সুযোগ পেলেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে একে অন্যের কাছ থেকে দেখা দেখির মহা উৎসবে মেতে ওঠে এটা অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা। সে জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পরীক্ষার হলে শিক্ষকের উপস্থীতির পাশাপাশি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করেছে। তাঁর মানে পরীক্ষার হলে কঠোর থেকে কঠোরতর নজরদারি রাখা হয় যাতে করে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সাথে দেখাদেখি করতে না পারে। এ গেল হল কেন্দ্রিক পরীক্ষার কথা। কিন্তু বর্তমান যে অনলাইনে পরীক্ষা হচ্ছে সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সময় শিক্ষকেরা কিভাবে নজরদারি নিশ্চিত করছেন বা করবেন? কেউ কেউ বলতে পারেন অনলাইনে তো শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাসা বাড়িতে থেকে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করছে, সবাই সবার কাছ থেকে দুরে, তাহলে নজরদারির কথা আসছে কেন? এটা এজন্যই আসছে যে প্রযুক্তির শুধু যে ভাল দিক আছে তা নয়, খারাপ দিক ও আছে। এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে উন্নত তথ্য প্রযুক্তি না থাকলে আমরা এই করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে শিক্ষা ব্যাবস্থাকে চালিয়ে নিতে পারতাম না। হয়ে যেত অন্তত এক বছরের সেশন-জট। এদিক থেকে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা অসামান্য। আবার অনলাইনে পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই তথ্যপ্রযুক্তিই একটা ভাবনার বিষয়। যদিও অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্রের ধরনে অনেক পরিবর্তন এসেছে তবু সচেতন অসচেতন অনেকেই অনলাইন পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমার বাসায় ইন্টারকমের লাইন লাগানো হয়েছে সেদিন। আমি ক্লাস নিচ্ছিলাম অনলাইনে আর পাশেই ওরা ইন্টারকমের লাইনের কাজ করছে। হঠাৎ করে ইন্টারকমের কাজ করতে আসা ভদ্রলোক আমাকে বলে বসলেন উনি নাকি ওনার পরিচিত জনের বাসায় কোন এক শিক্ষার্থীকে আরেকজনের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা দিতে দেখেছেন। কথাটাকে তখন খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও কোন এক বিশেষ কারনে কথাটা আজ অনেক ভাবিয়ে তুলছে আমাকে এবং সেই দুর্ভাবনাই আজকের এই লেখনির উৎস। গেল সপ্তাহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডটার্ম পরীক্ষা শেষ হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই খাতা মুল্যায়ন করা হয়ে গেছে। সেদিন ছিল আমাদের অনুষদের শিক্ষকদের ভার্চুয়াল মিটিং। আলোচনা হয়েছিল অনলাইন পরীক্ষা ব্যাবস্থায় প্রশ্নের মান ও ছাত্র ছাত্রীদের সম্ভাব্য বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন নিয়ে। প্রশ্নের মান নিয়ে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হয়েছিল যা কাটিয়ে উঠার জন্য অনুষদের ডীন মহোদয় আন্তরিক ভাবে দিকনির্দেশনা দিলেন। আমার বিশ্বাস এই সমস্যা হয়তো থাকবে না, নিশ্চই প্রশ্নের মান আরো উন্নত হবে। অন্যদিকে লোডশেডিং, ইন্টার্নেট সমস্যা সহ বিভিন্য যৌক্তিক কারনে অনলাইনে পরীক্ষায় একটু সময় বেশি দেয়া হয়। আমার লেখনির পেছনের বিশেষ কারনের একটি হচ্ছে এই বর্ধিত সময়ের অপব্যভার নিয়ে সন্দেহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সুবিধা অপব্যাবহার করে অনেক অসৎ উপায় অবলম্বন করা সম্ভব। সবাই করে এটা আমি কোনভাবেই মানতে রাজী না। কেউ কেউ হয়তো এই সময়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর দ্রুত যোগাযোগ ব্যাবস্থার সুবাদে একজনের উত্তরপত্র আরেকজনের সাথে বিনিময় করার চেষ্টা করছে! আমার সন্দেহ যদি অমুলক হয় তাহলে তো খুব ই ভাল কথা। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে? এই সন্দেহকে ম্ল্যান করে দিতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা থেকে আর সেটা পারে শিক্ষার্থীরা তাঁদের নৈতিক মুল্যবোধের মাধ্যমে। শিক্ষকেরা নিশ্চই চেষ্টা করবে অসৎ উপায় বন্ধের কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারনে তা হবে অনেক কঠিন। এই কাজটা তখনি করা যাবে যদি শিক্ষার্থীরা তাঁদের নিজেদের কথা চিন্তা করে অনৈতিকতাকে না বলে। তোমাদেরকে বুঝতে হবে পরীক্ষার বর্ধিত সময়ের অপব্যাবহার করে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হলে আর কেউ না দেখলেও সৃষ্টিকর্তার বাইরে অন্তত তোমরা নিজে তা দেখতেছ। সাময়ীকভাবে এর মাধ্যমে ভাল নম্বর পাওয়া গেলেও ভবিষ্যতে নিজেকে অপরাধি মনে হবে। এই পরম সত্য কথাটি এখন বুঝতে না পারলেও কর্মজীবনে তোমরা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারবে আমি নিশ্চিত। তাই এই নৈতিকতার পরীক্ষায় তোমাদেরকে উত্তীর্ন হতেই হবে। অতিসহজ এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে না পারলে ভবিষ্যতে এর খেসারত তোমাদেরকেই দিতে হবে এবং তা হবে আজকের কয়েকটি নম্বরের তুলনায় লক্ষকোটি গুন বেশি। একটু ভেবে দেখ ,করোনার ভুয়া পরীক্ষার খেসারত আমাদেরকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে দিতে হচ্ছে। সাহেদ- সাবরিনা দের অর্থলোভ আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের ভাবমুর্তী কতটা বিনাশ করছে! ইতালিতে আমাদেরকে বিমান থেকে নামতেই দিল না। বিশ্বের নামি দামি প্রায় সব দেশ তাঁদের দেশে আমাদের অবতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, অনেকটা আন্তর্জাতিক ভাবে বয়কটের মত। নীতি নৈতিকতার গুরুত্ব বুঝার জন্য এর থেকে তাজা উদাহরণ দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাই অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থার নৈতিকতার বিষয়টিকে হেসে খেলে উড়ে না দিয়ে গুরুত্তের সাথে দেখতে হবে। প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমাদের সফলতা কিন্তু অনেক, তোমাদের মাঝে সম্ভাবনা আরো বেশি। আর তোমাদেরকে নিয়ে আমার স্বপ্ন তাঁর থেকেও বেশি। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সবথেকে বড় কার্যকরি উপাদান কোনটি, আমি নির্দিধায় বলব শিক্ষার্থীরা। কারণ শিক্ষার্থীরা যদি অংশগ্রহণ না করত তাহলে কোন ভাবেই অনলাইন শিক্ষাব্যাবস্থা আজকের অবস্থায় অবস্থান করত না। আর এই নৈতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার মাধ্যমে তোমরা এই আপদকালীন অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে এনে দিতে পারো স্বার্থকতার সার্টিফিকেট। আমাদের, বিশেষ করে আমার অকৃত্রিম বিশ্বাস তোমরা সেটা পারবে। অনলাইন পরীক্ষার সময় তোমার নৈতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার জন্য মা, বাবা, দাদু বা দাদী, চাচা বা চাচী অথবা পরিবারের অন্য কাউকে সামনে রেখে পরীক্ষা দিলে পাশ করাটা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে। পরিশেষে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল-আমীনের কাছে দোয়া করি সকল শিক্ষার্থী সহ আমাদের সবার মঙ্গল করুন। আমীন।
মোঃ রাইহানুল ইসলাম লাজুলেখক,
গবেষক ও শিক্ষক, রিয়েল এস্টেট বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
Source:
https://www.sheershakhobor.com/exclusive/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%AA/?fbclid=IwAR1HQNvpqzvopXji8UNoH2gHP9-zg6wsoqgwbRipV66Vtz13696G90rRlqY