'ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না কেন' (জনকন্ঠ, ৪ অক্টোবর, পৃ.৪)

Author Topic: 'ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না কেন' (জনকন্ঠ, ৪ অক্টোবর, পৃ.৪)  (Read 887 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না কেন
প্রকাশিতঃ অক্টোবর ০৪, ২০২০

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে দেশের সচেতন জনগণ এবং ফেসবুক থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমগুলো। এ ঘটনার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। সিলেটের ওই ঘটনায় ধর্ষকদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে দুজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শুধু দেশেই আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলছে ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন। এ দেশে ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে দুই-তিন বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত কেউ-ই রেহাই পাচ্ছে না। অনেক সময় অনেক হুজুর দ্বারাও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণ বা বলাৎকারের ঘটনা ঘটে। আর এ সমাজে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েও ধর্ষণ করার ঘটনাতো অহরহই ঘটে চলেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান-সম্মানের ভয়ে ধর্ষণের বিষয় কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অনেক সময় এ-ও দেখা যায়, ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে। একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ’সমাজ’-ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি যে, একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে। সর্বোপরি, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিকভাবে এমন অশান্তি এবং যন্ত্রণাময় জীবন অতিবাহিত করেন যে, তিনি যেন জীবিত থেকেও মৃত। আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারী অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার অনেক সময় ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পান না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে?

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২জন। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ, যা প্রকৃত পক্ষেই ভয়াবহ একটি বিষয়। ওই সংস্থার হিসাব মতে, ২০১৭ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। অপর এক হিসেবে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়ানারীর শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশব্যাপী ধর্ষণ, হত্যা এবং নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় সচেতন দেশবাসী ও অভিভাবক মহল আজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং অশনিসংকেতই বটে। আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাসমূহ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। বলাবাহুল্য, কোন সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই শুভ কোন বিষয় নয়। এমতাবস্থায় সমাজ থেকে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরও ভয়ানক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় : ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকেরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায় এবং ধর্ষণ করে। সুতরাং, সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি, সেসব দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। ৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোন দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোন অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কারণে ধর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক, যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সম্মতি ব্যতিরেকে, সম্মতিক্রমে-যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়, তার সম্মতিক্রমে-যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত: তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে-যেক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে, ধর্ষণের ফলে কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎবৎ. ধর্ষণের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরী। ধর্ষকরা অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তীকালে তারা আবারও বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদেরকে দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। দেশ পরিণত হবে মগের মুল্লুকে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সকলের একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যে কোন মূল্যে প্রতিহত করা। এ দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই ধর্ষণকে কঠোর হস্তে প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি এবং তা অপরিহার্য একটি বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/527895/%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%B9%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd