সাক্ষাৎকারঃ আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

Author Topic: সাক্ষাৎকারঃ আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত  (Read 1577 times)

Offline Al Mahmud Rumman

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 203
  • Test
    • View Profile
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাজু আলাউদ্দিন

কবিতা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ– সাহিত্যের এই তিনটি শাখায় তিনি কারুকার্যময় যে-সৌধ নির্মান করেছেন তার তুলনা বুদ্ধদেব বসু ছাড়া আর কারোর সঙ্গে হতে পারে না। যদিও ভাবুকতার মৌলিক দীপ্তিতে তার প্রবন্ধ অনেক বেশি গুরুত্ববহ। অনুবাদে–আমার বিবেচনায়–তিনি আদর্শতম জায়গায় অবস্থান করছেন। আর কবিতায় তিনি পৃথিবীর প্রধান কবিদের গোত্রভুক্ত।
তার গদ্য ও বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের স্বভাবের তুলনা করতে গিয়ে দুটো বাদ্যযন্ত্র থেকে নিসৃত ভিন্ন দুই সুরধ্বনির কল্পনা করবো তুলনার স্বার্থে। বুদ্ধদেবের গদ্য যদি হয় সেতারের কমনীয়তা, তাহলে অলোকরঞ্চনের গদ্যে রয়েছে সরোদের পৌরুষদীপ্তি। শুধু তাই-ই নয়, তার গদ্যে রয়েছে অনেক বেশি কারুকাজ। তার কবিতাকে ভিত্তি করে অনেকেই তার ভাবুকতার প্রাসাদে প্রবেশ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তার গদ্যে চিন্তা ও ভাবনার যে-অপ্রতিম সৌধ গড়ে উঠেছে সেদিকে আমরা তাকিয়েছি কম। নিবিড় পাঠক মাত্রই এটা লক্ষ্য না করে পারে না যে বহু ব্যবহারে জীর্ন মুমুর্ষ প্রচলপিষ্ট শব্দগুলো এড়িয়ে এমনসব শব্দ তিনি তৈরি করেছেন যা তার নতুন সংবেদনকে যথাযথভাবে প্রকাশের অনুকূল হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো শব্দকে তিনি সন্ধির মাধ্যমে নতুন অঙ্গ ও অর্থ দান করেছেন।
ভাষা এবং ভাষাশৈলীই শিল্পীর ব্যক্তিত্বের স্মারকচিত্র। এই অর্থে তার সৃজনী ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য ও তীব্রতা অনেক বেশি।
কখনো কখনো হয়তো ভুলভাবেই মনে হয় সুধীন দত্ত তার গদ্যের মেজাজের দূরবর্তী ভ্রুণ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় ওই সংযোগ ছিন্ন করে তিনি অন্য এক গোত্র রচনা করেছেন। তার গদ্যে তৎসম গাম্ভীর্য থাকলেও, তাতে আছে ঘরোয়া বুনন আর আছে সুরাশ্রিত বর্নময় স্ফূর্তি। গদ্য যেন ধ্রুপদাঙ্গের বিন্যাস হয়ে উঠেছে।
তার গদ্যের কাব্যিক সৌন্দর্য্যরে দিকে তাকালে হাইডেগারের সেই উক্তিতে আস্থা রাখা অনেক সহজ হয়ে যায় যখন তিনি বলেন The opposite of the poem is not prose; pure prose is as poetic as many poetry…. The speech of genuine thinking is by nature poetic. ঠিক এই কারণে তার গদ্য পড়ার পর মনে হয় , এই গদ্য কবির হাত থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। কাব্যবোধের সঙ্গে পরাগায়নের ফল এই সুভাষিত গদ্য।
নাটক, উপন্যাস এবং গল্প এগুলোর কোনটাই তিনি লেখেননি কিন্তু তবু তার কবিতায় এই তিনেরই সংক্রমন আছে, আছে তা মিতাচারী স্বভাবে, আছে মিতব্যয়িতার প্রস্বরে, আছে মহাসংকোচনের সংক্ষিপ্ততায়। যেমন যৌবন বাউল-এর ‘শেষের প্রহর’ কবিতায় রয়েছে সরাসরি নাট্য আঙ্গিক, এমনকি সরাসরি এমন কিছু কবিতাতেও রয়েছে এই নাট্যগুণের উপস্থিতি যেমন নিষিদ্ধ কোজাগরীতে ‘আচমকা আমাকে’ কবিতায় কিংবা রক্তাক্ত ঝরোখা গ্রন্থের ‘জেরা’ কবিতায়ও আছে নাট্যরাগের আভাস। এই রক্তাক্ত ঝরোখার নাম কবিতারই নবম পর্বে আছে ধানখেতে প্রেমিক প্রেমিকার গল্প। সাহিত্যের এই বিভিন্ন শাখার পারস্পরিক বিনিময় তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থেও আছে। পরস্পরের মধ্যে বিভাজনরেখা মুছে ফেলার এই তাগিদ তাকে সমকালীন অন্য কবিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাভাষার তিরিশোত্তর কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।
প্রবলতম ছন্দসিদ্ধ আর অন্তমিলের জাদুকরী কবি হয়েও ছৌ-কাবুকির মুখোশ-এর পর থেকেই বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন টানাগদ্যে। যদিও এর সূচনা ছৌ-কাবুকির অন্তর্ভুক্ত ‘অর্জিত নিয়তি’ থেকেই। আজও তিনি কবিতায় নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিজের কাব্যব্যক্তিত্বকে নবীনাচারে অনন্য করে রেখেছেন।

তার অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করেছি, তিনি ব্যক্তিত্ব ও কর্ম অনুযায়ী অনুবাদের ভাষাকেও মূলের উপযোগী করে নেন। যেমন, প্রাচ্য প্রতীচ্যের দিওয়ান-এ তিনি যে-ভাষায় অনুবাদ করেছেন, নিয়তি ও দেবযান(হোল্ডারলিন) তিনি সেই ভাষায় করেননি। কিংবা ধরা যাক, কোলরিজের এনসিয়েন্ট ম্যারিনার-এর অনুবাদে তিনি যে ভাষিক আবহ তৈরি করলেন, তার সাথে কোনই মিল নেই অন্য অনুবাদের। একই ব্যাপার আমরা লক্ষ করবো তার গদ্য অনুবাদের ক্ষেত্রেও, ক্রোৎস: পাঁচটি নাটক-এ তিনি ভাষাকে এক সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে গাহন করালেন কিন্তু আন্তিগোনে-এর ভাষায় তিনি নিয়ে এলেন ক্লাসিক গড়ন, ভাষা এখানে শীলাদৃঢ় মেজাজের অনুসারী।
অর্থাৎ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সাহিত্যের কোনো মাধ্যমেই প্রচলিত পথে হাঁটেন নি। তিনি আমাদের জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম, আর সবচেয়ে গহন-স্নাতক। আজ এই গুণী লেখকের ৮৭তম জন্মদিন। তার সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি। তবে কথা হয়েছে বহুবার, অবশ্যই ফোনে। তার সাথে প্রথম ফোনালাপের পূর্ণাঙ্গ শ্রুতিলিপি এই কথোপোকথন। ফোনে এই আলাপটি হয়েছিল ২০১৫ সালে ফেব্রয়ারি মাসে। তার সাথে এই আলাপচারিতাটি প্রকাশের মাধ্যমে তাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধার্ঘ।


অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: হ্যালো।
রাজু : জী, হ্যালো। অলোকদা কি আছেন?
অলোকরঞ্জন: আমি কথা বলছি।
রাজু: ও আচ্ছা। নমস্কার অলোকদা। কেমন আছেন আপনি?
অলোকরঞ্জন: আপনি কে বলছেন?
রাজু: আমার নাম রাজু আলাউ্দ্দিন। আমি ঢাকা থেকে বলছি অলোকদা।
অলোকরঞ্জন: ওওওও। হ্যাঁ, কালকে শুভ(রঞ্জন দাশগুপ্ত) ওরকম একটা আভাস দিয়েছিল। সংক্ষেপে এইটুকু বলতে পারি, মরবারও সময় নেই। একবার মরবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটা হলো হঠাৎ একটা সেমিনারে সিঁড়ি ভেঙে পরে যাই একেবারে শিরদাড়ার উপর। সেইটে পুনরাবৃত্ত হয় বার তিনেক। সেটার ফলে আমি একটু ব্যাহত আছি। তাই নিয়ে সমস্ত কাজগুলো চলছে আরকি। এবং এরই মধ্যে আপনার বই(দক্ষিণে সুর্যোদয়) পড়ছি, আস্তে আস্তে পড়ছি এবং খুব অাস্বাদন করছি। অনেক কিছুই আমার ঠিক প্রত্যক্ষ জানা ছিল না। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এ বইতো এক মুহূর্তে পড়ে ফেলার নয়। বিশেষ করে আপনার সম্পাদনায় ( নিচের মহল, (মারিয়ানো আসুয়েলা), খুব ভালো। কিন্তু এই বইটার (দক্ষিণে সূর্যোদয়) মধ্যে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। এবং আমার অত্যন্ত অত্যন্ত অত্যন্ত মনঃপুত হচ্ছে বইটা। এইটুকু আমি বলতে পারি।
রাজু : অনেক শুকরিয়া।
অলোকরঞ্জন: আর বিশেষ করে স্পেনে–আমি ল্যাটিন আমেরিকারই বলবো–রবীন্দ্র-পরিগ্রহণের মধ্যে যে দ্বিধা কাজ করছে সেটার জন্যে অনুবাদ কতটা দায়ী… নেরুদার মতো মানুষ, গ্যসেতের মতো মানুষ, তাদের যে-বিরোধাভাস… গ্যাসেততো রবীন্দ্রনাথের দিকে ঝুঁকছিলেন। এগুলো দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে। নিশ্চয়ই যোগাযোগ থাকবে।

বৈদেহী
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
প্রথম পাপ করার মতো বিবেক এলো মনে,
চক্ষু বুজে সেই নারীকে নিলাম আলিঙ্গনে;
সে কি হর্ষ, প্রাত্যহিক অপস্মারগুলি
পালিয়ে গেল পিলসুজের অঙ্গুলি হেলনে।

‘আমায় তুমি অভিজ্ঞতায় ভুক্তভোগী করো’
ব’লে আমি প্রথমে তার উরোগুঞ্জাহার
ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দিলাম জানালার বাহিরে :
কিন্তু তবু তার আনন্দ আকাশগঙ্গার।

‘নির্মঞ্ছন করো আমায় তোমার কালোচুলে’
বলতে গিয়ে অকস্মাৎ আমার স্বরলিপি
নিখাদ গুহায় অবরুদ্ধ; অনপির্ত তবু
বিস্ফারিত ইন্দুলেখা ব্যক্ত বাহুমূলে

‘আমার কাছে সূর্য আছে’ কৃত্রিম শপথে
কাছে এনে দিলাম তাকে অন্তর্বেদনা,
তবু অবাক, আঁখিপদ্মে ছিল না ভৎর্সনা,
অনুক্ত আকুতি ছিল রক্তকোকনদে।

‘তুমি আমায় এখনো কি নম্র কিশোর ভাবো ?’
এই ব’লে যেই অস্নাত মুখ বিকীর্ণ আঙুলে
স্নান করালাম, সে কি তৃপ্তি, অন্ধকারে হলো
সুবিনীত গৃহদাহ সিতকঞ্জনাভ।

‘কে তুমি ? কমলে কামিনী ? কার ঘরে বিদ্রোহ
সংঘটিত ক’রে এলে ?’ এই বলে ফুকারি;
আচম্বিতে চুম্বনের বৈশ্বানরে দেখি
আমায় রেখে গিয়েছে সেই স্বাবলম্বী নারী!

রাজু: জী জী,অবশ্যই।
অলোকরঞ্জন: আপনি কর্মক্ষেত্রে কোথায়?
রাজু: আমি আসলে কাজ করি একটা অনলাইন পত্রিকায়। পত্রিকাটির নাম হচ্ছে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম। এর বয়স হয়েছে ১০ বছর, আরও বেশি। বাংলাদেশে এটা প্রথম অনলাইন পত্রিকা। আপনার সঙ্গে এর আগেও একবার কথা হয়েছিল। সেটা হলো, আপনাকে একটু স্মরণ করিয়ে দিলে আপনি এখনই বুঝতে পারবেন। শহীদ কাদরী মারা যাওয়ার পরপর আপনাকে ঢাকা থেকে ফোন করে প্রতিক্রিয়া নিয়েছিলাম।
অলোকরঞ্জন: ঠিক ঠিক। আমি সেইটাই আপনাকে এখ্খুনি বলতে চাইছিলাম। সেটা একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বটে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে একজন অফলাইনার।
রাজু: আচ্ছা।
অলোকরঞ্জন: আমি অনলাইনার নই। সেটা আমার জন্য একটা অভিজ্ঞতা ছিল। আমি পৃথিবীর অন্যতম অফলাইনারদের একজন।
রাজু: আপনি অবশ্য সেই কথা আপনার এক লেখায় বলেছেনও। এই ফেসবুক, এই যে ইন্টারনেট, এই যে “সুবর্ণ প্রাদুর্ভাব”। আপনি এই সুবর্ণ প্রাদুর্ভাবের বাইরে। হা হা হা।
অলোকরঞ্জন: হা হা হা। আমার স্পষ্ট মনে আছে ফারুক ভাই এই যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিলেন।
রাজু: আপনার সেই উক্তিগুলো নিয়ে আমাদের এখানেতো প্রকাশিত হয়েছিলই। পরে বাংলা একাডেমি থেকে একটা বই বেরিয়েছিল শহীদ কাদরীকে নিয়ে, সেখানে আপনার এই লেখাটা ওরা নিয়েছে। আপনার কথাগুলো আপনারই কথিত একটা ভাষ্য বা প্রবন্ধ হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলাম। ওভাবেই গিয়েছে লেখাটা। আমার যেটা ভালো লেগেছে তাহলো আপনার অসাধারণ কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল ওখানে। এত তাৎক্ষণিকতার ভেতর দিয়ে আপনি যে-ভাবে শহীদ কাদরীর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করেছেন, তার চরিত্রের মৌলিক দিকগুলো চিহ্নিত করেছেন…
অলোকরঞ্জন: অনেক সময় নির্ভর করে যিনি গ্রহণ করছেন তার ক্ষমতার উপর। এটা অদ্ভুত রকমভাবে হয়। একটা ঘটনা বলি, আমার ছাত্রই বলবো, তিনি প্রথম সেমেস্টারে থাকা অবস্থায় শহীদ কাদরীকে নিয়ে আমার একটি কবিতা এক সেমিনারে পড়েওছেন বার কয়েক–অনলাইনে আমার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর। আমি জানি না আপনি সেটা জানেন কিনা। এসব কথা হয়তো অবান্তর। আমার তখন মনে হয়েছে, অনলাইনে কতগুলো কথা বলবার পর–যে-কথাগুলো ভেতরে সেন্সরড হচ্ছিল—সেন্সরড হচ্ছিল মানে, প্রকাশভঙ্গির কতদূর স্বচ্ছতা রইলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ইন্টারভিউর পর আত্মসমালোচনার তাগিদে আমি যেটা করলাম সেটা হলো শহীদের লেখার জগতে আরও ভিতরে ঢুকে গেলাম। এবং সেটা একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো, খুবই মজার অভিজ্ঞতা হলো। আপনার সাথে তো পরিচয় হয়েই গেছে সেই সূত্রে। শুভ(রঞ্জন দাশগুপ্ত)র বর্ণনা থেকে আমি ঠিক ধরতে পারিনি। আপতত বলছি যে এই বইটা (দক্ষিণে সূর্যোদয়) থাকবে, যে-বইটা আপনি লিখেছেন এ বইটা থাকবে, এবং নিশ্চয়ই কোনো কোনো জায়গায় বিতর্কের সুবর্ণ সুযোগ থাকবে। তা না হলে কোনো মানে হয় না। কারণ আমরা রবীন্দ্রপূজা করতে গিয়ে সে-সব কাণ্ড করেছি… ওদের যে-কার্টুন( বইয়ে ব্যবহৃত বিদেশি শিল্পীর আঁকা রবীন্দ্র-প্রতিকৃতির ইঙ্গিত করে) সেখানে ওই মজাগুলো রয়েছে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, ওকাম্পো; অসামান্য তার ভূমিকা, কোনো জায়গায় তবু যে-সংশয় তোলা হয়েছে যে তিনি ততটা পেরে উঠতে পেরেছিলেন কিনা—সেটা তো একটা প্রশ্নই। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে মানুষের এরকম অনেকগুলি অসঙ্গতি তো হয়েই যায়। এই হচ্ছে ব্যাপার। যাই হোক, পড়ছি বইটি।
রাজু : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ…
অলোকরঞ্জন: না, ‘ধন্যবাদ’টা খুব বৈঠকী শব্দ হলো। আমি বলছি, আমাদেরতো পরিচয় হয়েই আছে এবং এটা আমরা নিশ্চয়ই কখনো সখনো…এই বাঁধনটা অনেকটা প্রায় রাজা মিডাসের মতোন। রাজা যা-কিছু স্পর্শ করতেন সোনা হয়ে যেত, জল খেতে গিয়ে দেখলো জলটা সোনা হয়ে যেত। তিনি জল খেতে পারতেন না।এরকম একটা অভিজ্ঞতা হয় কিন্তু যারা অনলাইনের মধ্যে ডুবে থাকে। সেই জায়গায় আপনাকে আমি আপাতত একজন মিডাস বলে অভিহিত করলাম। বাড়িতে সব ভালো তো? বাচ্চারা সবাই ভালো তো?
রাজু: বাংলাদেশে কি আপনি এসেছিলেন কখনো? যদি এসে থাকেন তাহলে আমার অজ্ঞতাকে ক্ষমা করবেন।
অলোকরঞ্জন: বাংলাদেশে তো নিশ্চয়ই এসেছি, তখন কবি বাৎসায়ন বেঁচে ছিলেন। ওই পর্বে আমিও গেছি, বাংলাদেশতো আমার শেকড়ের দেশ, তবে প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানে যাইনি। গ্যেটে যখন ইতালিতে গিয়েছিলেন দেড় বছরের জন্য নাম হারিয়ে চলে গিয়েছিলেন। হয়েছি কি ভাই, এত প্রকাশ্য সভাসমিতি করে করে… আমার মনে হয় যেটা কলকাতা সেটাই তো ঢাকা–এই ব্যাপারটা বয়সের সুবাদে আমার কাছে উঠে এসছে। আমি জানি ঢাকায় যেতে পারছি, আমি জানি যে বাংলাদেশের আমি একটা অংশ। সেই জন্যে গিয়ে ঢাকায় প্রক্সি দেয়াটা আমার কম হয়ে ওঠে। যে-দুতিনবার হয়েছিল–হয়তো জবাবদিহির মতোই শুনাবে–যে দুতিনবারই হয়েছিল তা হয়েছিল গ্যেটে ইনস্টিট্যুটের মাধ্যমে আমাদের উপমহাদেশতো খুব শান্ত থাকবার জন্য তৈরি থাকে না। মানে খুবই খুবই গোলমেলে পরিস্থিতি হয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, আমি তখন বন-এ, বন ছিল তখন জার্মানির রাজধানী। দুটো সেমিনারের মাঝখানে আমি ভিসা নিয়ে তৈরি ছিলাম। হয়তো শারীরিকভাবে যাওয়া হবে, হয়তো হবে না। কিন্তু এখন যে-জায়গাটায় আমি চলে এসেছি, সেই জায়গাটায় হয়তো প্রামাণ্যতার কোনো দলিল থাকবে না, কিন্তু বেঁচে থাকবে গোপন প্রেমের মতো।
রাজু: হ্যাঁ, খুব ভালো বলেছেন । হা হা হা।
অলোকরঞ্জন: হা হা হা । হ্যাঁ, এই হচ্ছে ব্যাপার। আরেকটা আমাকে খুব চকিত করে দিয়েছিল তাহলো আমি যখন শহীদ সম্পর্কে বলছি তখন তো প্রথম কান্নার ব্যাপারটা তো কাজ করেছেই। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটার একটা দলিল তৈরি হয়ে গেলে। আমার এক ছাত্র হানস…
রাজু: হান্স হার্ডার?
অলোকরঞ্জন: হ্যাঁ, হান্স হার্ডার। আমার খুব প্রিয় ছাত্র। ওর সঙ্গে আপনার যেন যোগাযোগ হয়।
রাজু: আসলে যোগাযোগ একবার হয়েছিল, সৌজন্য বিনিময় , পরিচয় হয়েছিল মাত্র। তার বাংলা বলা শুনে আমি রীতিমত মুগ্ধ। এত সুন্দর বাংলা বলেন তিনি। আপনার ছাত্র হিসেবে সোনার টুকরো বলবো প্রচলিত ভাষায়।
অলোকরঞ্জন: ও এবার একটা পেপার পড়ছে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার উপর। ওকে কাছে টেনে নেবেন। ২৩ তারিখে যাচ্ছে, ওকে কাছে টেনে নিয়ে ও যেসব কাজ করছে তাতে আপনার মাঙ্গলিক হাত বাড়িয়ে দেবেন—আমি এটা দাবী করছি।
রাজু: অবশ্যই, অবশ্যই। আমি বলছিলাম শুভদাকে যে বাংলাদেশে আপনার গুণগ্রাহী অনেক, আপনি হয়তো তা জানেন না। প্রবন্ধে ও কবিতায় আপনার অনন্যসাধারণ কাজ। আমি রসিকতা করেই বলেছিলাম যে আমরা সবাই অলোকরঞ্জিতা।
অলোকরঞ্জন: হা হা হা।
রাজু: আমি এটাও বলেছিলাম যে মারিও বার্গাস যোসা ফকনারের লেখা পড়ার সময় হাতে কাগজ কলম নিয়ে পড়তেন। অর্থাৎ বিভিন্ন বিষয়ে টুকে নিচ্ছেন। আপনার প্রবন্ধ পড়তে গিয়েও আমার ঠিক এরকমই অভিজ্ঞতা। আমি অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করি।
অলোকরঞ্জন: এই ভালোবাসাটা যেন অক্ষত থাকে।
রাজু: অবশ্যই অক্ষত থাকবে।
অলোকরঞ্জন: এই রণনটা আমি জানি। আজকে কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া নেই? কর্মস্থল তো বাড়িতেই অনেকটা, তাই না?
রাজু : জ্বী জ্বী। হ্যাঁ, মোটামুটি বাড়িতেই, এটা একটা সুবিধা। আরেকটা জিনিস দেখে আমি একটু অবাক হলাম, বিষয়টা আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম যে অক্তাবিও পাস কলকাতায় এসছিলেন কিন্ত বাংলা ভাষার কোন কোন লেখকের সঙ্গে…
অলোকরঞ্জন: না না, আসতে পারেননি শেষ মুহূর্তে।
রাজু: তাহলে আপনার সাথে দেখা হলো যে?
অলোকরঞ্জন: আমার সাথে দেখা হয়েছে উনি যখন জার্মানিতে। ওরঁ প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল আমি যেন সঙ্গে থাকি কলকাতার বইমেলায়। সেখানে তখনও কিছু সরকারী চাপ ছিল, সব মিলিয়ে … কবিদের প্রতিশ্রুতি অনেক সময় নির্ভর করে …কবিরা তো মোটামুটি শহীদ হয়েই জন্মায় .. এবং শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তিনি চেয়েছিলেন আসতে। শেষ মুহূর্তে, ওর স্বভাব ছিল, ওই যে উনি যে-কথাটা দেন সেই কথাটা যদি না-রাখতে পারেনও, কিন্তু সেই কথা দেয়ার অঙ্গীকারে উনি এমন জড়িয়ে যেতেন যে সেটা না-হয়ে উঠতে পারলে তখন তিনি নিজেকে–উনি ইহুদি ছিলেন তো–নিজেকেও বিদ্ধ করে।এই ব্যাপারটা ছিল। আরেকজনের সাথে যোগাযোগ হলে– প্রাত্যহিক যোগাযোগের চেয়েও অনেক ফলপ্রসূ হয়–ভালো হয়। এক যুবককে আমি আবিস্কার করেছি, সেও আমাকে আবিস্কার করেছে, তার নাম মারুফ হোসেন। মারুফ হচ্ছে প্রকাশক। ওর নাম শুনেছেন?
রাজু: বাংলাদেশের?
অলোকরঞ্জন: অভিযান প্রকাশনীর। সে একই সঙ্গে প্রায় ধানসিড়িতে যেমন, তেমনি ভলগাতেও অসম্ভব চনমনে এক পুরুষ। আমি চাইবো যে তার সাথে যাতে আপনার যোগাযোগটা থাকে। আমি যেখানেই থাকি–যেটা আপনার ভাষায় বলবো ‘দৈবের বশে’—এই প্রসঙ্গে একটু ছোট্ট কথা বলি: আপনার লেখার মধ্যে যে-সন্তর্পন ভঙ্গিটা আছে, যেটার মধ্যে একটা সৌজন্যেরই আভিজাত্য আছে সেটাকে বজায় রাখবেন।
রাজু : জ্বী অবশ্যই । অনেক ধন্যবাদ।
অলোকরঞ্জন: কখনো কোনো যৌথ উত্তেজনা যাকে বলে, পাবলিক ওপিনিয়ন যাকে বলে–তার সামিল হবেন না।
রাজু: আমি অবশ্যই আপনার পরামর্শ অনুসরণ করবো।
অলোকরঞ্জন: তাহলে ভাই, এখান থেকে ফিরে (জার্মানিতে ) গিয়ে কথা হবে। আর যোগাযোগটা আবহমান থাকবে। বাড়িতে সবার জন্য আমার শুভকামনা।
রাজু: আপনার জন্যও শুভকামনা অলোকদা। আমি হয়তো কালকে বা পরশুদিন আপনাকে কল দেবো আপনি যদি ফোনে একটু সময় দেন, আমি আপনার সাথে কথা বলবো। আপনার লেখা নিয়ে দুএকটা প্রশ্ন বা কৌতূহল রয়েছে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে এই কৌতূহল মেটান তাহলে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করবো।


মূল সাক্ষাতকারঃ https://arts.bdnews24.com/?p=16652