জ্ঞান-বিজ্ঞান কখনো সীমানার মাঝে স্থির থাকে না। জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে না চাইলেও কোনো না কোনোভাবে তা প্রবাহিত হয় নদীর মতো। জ্ঞান মূলত সময় বা ভৌগোলিক সীমানা, কোনোটিই মেনে চলে না। অনেক সময় শাসকেরা নিজেদের আহরিত জ্ঞান নিজেদের সীমানায় রুদ্ধ করতে চেয়েছেন কিংবা স্বীয় পছন্দের বিজ্ঞান চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। জ্ঞানের প্রবাহ রুদ্ধ হয়নি। তাই প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞান-বিজ্ঞান বাগদাদ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। আর মূলত জ্ঞান-বিজ্ঞানই সংস্কৃতিকে বদলে দেয় কিংবা ছাঁচে ফেলে রূপ দেয়।
একের পর এক রাজ্য জয় করার সময় আলেকজান্ডার ভেবেছিলেন বিজিত অংশগুলোর সংস্কৃতির মিল খুঁজে তিনি নতুন একটি সংস্কৃতির আদল তৈরি করবেন। আলেকজান্ডারের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছিল গ্রিস থেকে উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া মাইনর হয়ে পশ্চিম এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশ। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরও এ প্রভাব চলেছিল প্রায় ৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে গ্রিক নয় এমন অনেক জনপদের মানুষ গ্রিক ভাষা, দর্শন ও রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তা নিজেদের সংস্কৃতিতে গ্রহণ করে। এ অঞ্চল বা জনপদগুলোর মধ্যে মিসর, ইরান, ফিনিশিয়া, মধ্য এশিয়া ও বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশ প্রধান।
আলেকজান্ডার চেয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়াকে তিনি পৃথিবীর সব জ্ঞানের কেন্দ্র করে তুলবেন। তার মৃত্যুর পর বন্ধু ও সতীর্থ টলেমি সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টলেমি আলেকজান্দ্রিয়াকে একটি যথার্থ মহানগরী হিসেবে গড়ে তোলেন, যার গ্রন্থাগার আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। টলেমির হাত ধরে ২৮৮ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার এ গ্রন্থাগার তৈরি হয়ে পৃথিবীর সব প্রতিভাবান গবেষকের তীর্থে পরিণত হয়। আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষেরা সেখানে কেন পৌঁছতে চাইতেন? এমন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।
এর উত্তর আমরা পাই থিয়োডর ভ্রেট্টোসের ‘Alexandria : City of The Western mind’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘গ্রন্থাগারটি ঠিক কীভাবে কাজ করত বা গবেষকরা এর প্রাঙ্গণেই বসবাস করতেন কিনা তা জানা যায় না। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত তারা অবশ্যই নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করতেন, যার সঙ্গে গ্রন্থাগারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং প্রয়োজনীয় ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেসব বই ও প্যাপিরাসের ‘স্ক্রোল’ সংগ্রহ করে এখানে সংরক্ষণ করা হতো, যেগুলো মনোযোগের যোগ্য বলে মনে করা হতো। এ বই কিংবা স্ক্রোল কেবল গ্রিক ও রোমান লেখা দিয়ে ভরা ছিল না বরং প্রাচ্যের নানা গবেষণা অনুবাদ করে রাখা হতো। এর মাঝে ছিল মিসরীয় লেখা, হিব্রুতে লেখা গ্রন্থ এমনকি পার্সি পয়গম্বর জরথ্রুস্টকে নিয়ে লিখিত পাণ্ডুলিপি।’
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে প্রায় সত্তর হাজার প্যাপিরাস স্ক্রোল সংরক্ষিত ছিল। এমনকি এ সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে আগত জাহাজ থেকে বই, পাণ্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করে হলেও গ্রন্থাগারে রাখা হতো। গ্রন্থাগারে ঠিক কতসংখ্যক বই ছিল তার সঠিক পরিমাণ কেউই জানে না। পরবর্তী সময়ে দুই দফা অগ্নিকাণ্ডে গ্রন্থাগারটি ধ্বংস হয়। প্রথমটি ঘটে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার মিসরীয় বহরের কাছ থেকে পালানোর সময়। দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ডটি প্যাগানদের উপাসনা বন্ধ করার জন্য ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে থিয়োডসিয়াস সংঘটিত করেন। বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে একমত যে মিসরে মুসলিম শক্তি প্রবেশের তিন শতাব্দী আগে গ্রন্থাগারটি ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের হাতে পুরোপুরি ধ্বংস হয়।
রোমান সাম্রাজ্যে গ্রিক প্রভাব
রোমানদের হাতে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের পতন হলে রোমানরাই প্রথম গ্রিক জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শনের ‘উত্তরাধিকার’ লাভ করে। রোমানরা গ্রিকদের কেবল সংস্কৃতিই না, তাদের ধর্ম ও সভ্যতার জন্যও গ্রিকদের সম্মান করত। পশ্চিম ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিক সংস্কৃতি রোমান সংস্কৃতিতে গৃহীত এবং কিছুটা বিশেষায়িত হয়। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিক দেবতাদের আদলেই রোমান দেবতাদের অবতার তৈরি হয়েছিল। অ্যাপোলো গৃহীত হয়েছিলেন সরাসরি। জিউসের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় জুপিটারের মধ্যে। পোসাইডনের সঙ্গে নেপচুনের মিলও দৃষ্টিগ্রাহ্য।
কিন্তু চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে অর্থোডক্স খ্রিস্টান মতবাদের প্রসার হলে চিত্র অনেকটা বদলে যায়। গির্জার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তা তারা গ্রহণ করতে অসম্মত হন, কেননা তাদের মতে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হবে গির্জা ও বাইবেল। ৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজের চতুর্থ কাউন্সিলে বিশপরা সিদ্ধান্ত নেন, ধর্মবহির্ভূত কোনো ধরনের মতবাদ প্রচার করা যাবে না। সে সময়ের প্রধান প্রধান ব্যক্তি এসব ধারণা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলেও তা প্রচার করার অনুমতি ছিল না। সেন্ট জেরোম বলেন, ধর্মীয় জ্ঞান ব্যতীত কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, যদিও সেন্ট অগাস্টিন মনে করতেন দার্শনিক তত্ত্ব আসলে ধর্মতত্ত্বের পরিপূরক। অগাস্টিনের বিশ্বাস সম্পর্কে শিলা ডুন লিখেছেন, ‘সত্যিকারের দর্শন কখনো বিশ্বাস ও কারণ অনুসন্ধান ছাড়া সম্ভব নয় এবং দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ বহিরাগতদের দ্বারা ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময়ে বোইথিয়াসকে রোমান কনসাল নিযুক্ত করা হয় এবং ইতালিয়ান উপদ্বীপ অস্ট্রোগোথদের দ্বারা শাসিত হয়। সে সময়কালে অন্যান্য রোমান কর্তাব্যক্তির মতো বোইথিয়াসও একজন খ্রিস্টান ছিলেন কিন্তু আজও তাকে ‘রোমান দার্শনিকদের মধ্যে সর্বশেষ ও প্রথম পণ্ডিত ধর্মতাত্ত্বিক’ বলা হয়। কেননা তিনি কট্টর ছিলেন না। গ্রিক ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং অ্যারিস্টোটল ও প্লেটোর কাজগুলো তিনি লাতিনে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেন।
আয়ারল্যান্ডের কেল্টিক মঠগুলো পৌত্তলিক (প্যাগান) ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্মের বিষয়ে গ্রিক ও লাতিন ভাষার লেখাগুলো সংরক্ষণ করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই মঠ তাদের সন্তদের ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনে প্রেরণ করে যাদের কাজ ছিল নানা পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করে এগুলোর অনুলিপি তৈরি করে আনা। পরবর্তী সময়ে এসব পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ও পঠিত হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে এসে গ্রিক জ্ঞানের কোনো সরাসরি উৎস অবশিষ্ট ছিল না। কিছু লাতিন অনুবাদই অবশিষ্ট ছিল। এর পাশাপাশি এ সময়কালে পড়াশোনা মূলত মঠকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, ফলে তারা একটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে যেত। কিন্তু তবুও এসব মঠের চার দেয়ালের মাঝে পুরনো পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল, যার মধ্যে বেশির ভাগ ধর্মীয় হলেও অসাম্প্রদায়িক কিছু লেখাও রয়ে গিয়েছিল।
রোমের পূর্বাঞ্চল থেকে বাইজেন্টিয়াম
নাইসিয়া কাউন্সিলের মাধ্যমে খ্রিস্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার পাঁচ বছর পর সম্রাট প্রথম কনস্ট্যান্টাইন, রোমের রাজধানী বাইজেন্টিয়ামে স্থানান্তর করে একে কনস্ট্যান্টিনোপল (কনস্ট্যান্টিনের শহর) নামকরণ করেন। উল্লেখ্য, ভৌগোলিক কারণে রোমের পূর্বাংশ এর পশ্চিম অংশের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত ছিল। ফলে মধ্যযুগে ওই অঞ্চল তুলনামূলক উন্নত হতে পেরেছিল। এখানেই টিকে থাকা ছিটেফোঁটা হেলেনিজম, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
এ অঞ্চলে বিভিন্ন মঠ মন্দিরে নানা রকম পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। সেখান থেকে আরো অনুলিপি তৈরি ও চর্চা হয়। কিন্তু বহুদিন ধরে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি কেবল খ্রিস্টধর্মের প্রচারক ও পৃষ্ঠপোষক বলে সংরক্ষিত সব জ্ঞানের সঠিক চর্চা হতো না। রাষ্ট্রে এসব মতবাদ প্রচলিত থাকা আর চর্চা থাকা এক কথা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে প্লেটো, অ্যারিস্টোটলের লেখা অনুমোদিত ছিল কিন্তু সেখানে উল্লেখ করা হয় এ লেখাগুলো এমনভাবে প্রচার করতে হবে বা সেই সব অংশ আলোচিত হবে, যা খ্রিস্টধর্মের পক্ষে যায়।
পঞ্চম থেকে একাদশ শতাব্দী অবধি পুব ও পশ্চিমের মধ্যে এমন সহমর্মিতার অভাব খুব বেশি ছিল। পূর্ব-পশ্চিম বলতে আসলে ইউরোপের দুই অংশের কথাই বলা হচ্ছে। গ্রিক ও লাতিন চার্চের মধ্যে মতবাদের ভিন্নতার কারণে সহযোগিতা তৈরি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান গির্জা, গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে যা আজও ‘পূব-পশ্চিম বিদ্বেষ’ নামে পরিচিত। ইউরোপের জ্ঞান চর্চা এক হিসেবে এখানে থমকে যায়। আর নতুন করে সে চর্চা শুরু হয় বাগদাদে।
রোম থেকে বাগদাদ
রোম ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে মুসলিম বিজেতাদের আগমন ঘটে। সপ্তম শতকে উমাইয়া আমলে উত্তর আফ্রিকা মুসলিমদের অধীনে এসে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ ইসলামী শক্তিকে স্পেন পর্যন্ত নিয়ে যান। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের কাছাকাছি মুসলিম শক্তি পৌঁছলে চার্লস মার্টেল তাঁদের রুখতে সক্ষম হন। আল খলিলি তার ‘The House of Wisdom’ বইয়ে লেখেন, ‘এই সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের চেয়েও বেশি ছিল, এমনকি বিজিত ভূমির পরিমাণ আলেকজান্ডারের বিজিত ভূমির চেয়েও বেশি।’
আরব্য রজনীর কারণেই হোক কিংবা মুসলিম ইতিহাস—বাগদাদের নাম আমাদের মধ্যে শিহরণ আনে। মুসলিম বিজয়ের পর এক সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে বাগদাদ। মুসলিমরা কেবল রাজ্য বিস্তারেই মন দেননি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীন পর্যন্ত যাও’। তাই মিসর ও পারস্যের উর্বর অংশ আপন করায়ত্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তারা এ অংশের মতবাদ, দর্শন ও সঞ্চিত অন্যান্য জ্ঞানও আহরণ করেন। তাই গ্রিস, কনস্ট্যান্টিনোপল পেরিয়ে এতদিনের সঞ্চিত জ্ঞান এ সময়ে এসে জমা হয় মুসলিম বিশ্বে, বিশেষত বাগদাদে।
মুসলিম শাসকদের মাঝেও অনেক বংশ, পরিবার ছিল। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা হাতে নেয় আব্বাসীয় বংশ। বারো বছর পর তারা ইসলামী বিশ্বের রাজধানী দামেস্ক থেকে সরিয়ে বাগদাদে নিয়ে আসেন। এ সময়ের অন্যতম দুজন সফল খলিফা আল মনসুর এবং তার পুত্র হারুন আল-রশিদের সময়েই বাগদাদ এবং ইসলামী বিশ্বের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। খলিফা হারুন এত বেশি সফল ও জনপ্রিয় ছিলেন যে তাকে নিয়ে সত্যের পাশাপাশি কিংবদন্তি তৈরি হয়ে রচিত ‘আরব্য রজনী’ আজও দুনিয়ায় জনপ্রিয়।
ইতিহাস যা বলে, আরব্য রজনীতেও তার ছিটেফোঁটা পাওয়া যায়। অর্থাৎ অদ্ভুত সব গল্পের মাঝেও আরব্য রজনী মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে সে সময়ের বাগদাদে প্রচলিত ধারণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। ঐতিহাসিক তথ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি এ সময়ে মুসলিম শাসকদের অধীনে আগ্রহী পণ্ডিত ব্যক্তিরা সরাসরি গ্রিক থেকে তাদের দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, পৌরনীতির পাঠ নিয়েছেন। কখনো কখনো তা অনূদিত হয়েছে। হারুন আল-রশিদের ক্ষমতায় আসার আগেই কিছু গ্রিক বই, পাণ্ডুলিপি আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এর বাইরেও সিরিয়া, পারস্য, ব্যাক্ট্রিয়া, এমনকি ভারত থেকেও বই-পুস্তক আনার ব্যবস্থা করা হয়। কেননা গ্রিক সাম্রাজ্যের সব জ্ঞান কখনো খণ্ডিত, কখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
বলা চলে বাগদাদে যখন ইসলামী শাসনের স্বর্ণযুগ, সেই সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসব খণ্ডিত জ্ঞান একত্র করার চেষ্টা করা হয়। কেবল গ্রিক নয়, পার্সি ও সংস্কৃত নানা গ্রন্থও সংগ্রহ করা হয়। বলা হয়ে থাকে হারুন রশিদের সময়কাল বাগদাদ ও ইসলামী শাসনের স্বর্ণযুগ। কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, জ্ঞানের জন্যও। সেটা সম্ভব হলো কী করে?
গির্জার শাসনের সঙ্গে মুসলিম শাসনের পার্থক্য ছিল সহনীয়তায়। গির্জা যেখানে ধর্মবহির্ভূত জ্ঞান চর্চায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, মুসলিম বিশ্বে সেখানে বরং এসব জ্ঞান কেবল আহরণ করে সংরক্ষণই করা হয়নি বরং গবেষকরা গ্রিক, পার্সি, ভারতীয় দর্শন-বিজ্ঞানের নিরিখে কাজ করে সেগুলোকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। এখানেই অন্যান্য সাম্রাজ্য শাসনামলের সঙ্গে মুসলিম শাসনকালে বাগদাদের চরিত্রের পার্থক্য। জ্ঞানকে তারা গণ্ডিবদ্ধ করেননি, বরং উন্নত করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বাগদাদে ক্লাসিক্যাল জ্ঞানের পুনরুত্থান, অনুবাদ এবং অন্যান্য
জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় লিখিত বই যখন বাগদাদে এসে পৌঁছল, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেখানে অনুবাদের প্রয়োজন দেখা দেয়। খলিফা হারুন আল-রশিদের সময়ে গড়ে ওঠা জ্ঞানের বাতিঘর ‘বায়ত আল-হিকমা’ এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় ওঠে। খলিফার তত্ত্বাবধানে গ্রিক, ফার্সি থেকে আরবিতে এসব বইয়ের অনুবাদ শুরু হয়। অনেককেই কেন্দ্রীয় নির্দেশে এ কাজে বহাল করা হয় কিন্তু অনুবাদের আগে প্রয়োজন ছিল পাণ্ডুলপি সংগ্রহ। উভয় কাজেই পারদর্শী ছিলেন হুনাইন ইবনে ইসহাক নামে একজন দ্বিভাষী খ্রিস্টান। সিরীয় ও আরবি ভাষায় পারদর্শী এ ব্যক্তি প্রচুর পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও অনুবাদ করেন।
হুনাইন প্রথম জীবনে বিদ্যা লাভে উৎসাহী ছিলেন। বাগদাদ থেকে বেরিয়ে তিনি জ্ঞানের অন্বেষণে বইপুস্তক খুঁজতে থাকেন, এমনকি একসময়ে বাইজেন্টাইনে পৌঁছে যান। সেখানে তিনি গ্রিক শেখেন এবং যখন বাগদাদে ফিরে আসেন হোমার তখন হুনাইনের কণ্ঠস্থ। স্বাভাবিক কারণেই বাগদাদে তিনি দ্রুত খ্যাতি লাভ করেন। হুনাইন চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন বলে খলিফা তাকে চিকিৎসক ও অনুবাদক উভয় পদে বহাল করেন। তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন অনেক বই, যা পরবর্তী সময়ে অনূদিত হয়। অনুবাদের ক্ষেত্রে হুনাইন ছিলেন অদ্বিতীয় কেননা তিনি গ্রিক, সিরীয় ও আরবি তিনটি ভাষা জানতেন। গ্রিক শিখেছিলেন খোদ গ্রিস দেশে, ফলে যেকোনো বইয়ের মূল তিনি অনুধাবন করতে পারতেন এবং আরবি ভাষায় তা প্রকাশ করতেও সমস্যা হতো না।
পাশাপাশি হুনাইনের আরেকটি বিশেষ দিক হলো তিনি একটি বইয়ের যতগুলো সম্ভব সংস্করণ সংগ্রহ করতেন। এমনকি মূল বইয়ের অনুবাদও তিনি বিবেচনায় রাখতেন। এরপর তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুবাদে হাত দিতেন। অর্থাৎ হুনাইন নিছক কোনো অনুবাদক ছিলেন না, বরং ছিলেন গবেষক। তিনি গ্যালেন ও হিপোক্রিটাস অনুবাদ করেন, যা পরবর্তী সময়ে মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়ার (৮৫৪-৯২৫) সময়ে বিকশিত হয়ে ‘মনোবিজ্ঞান’ ও ‘শিশুরোগ চিকিৎসা’র উন্নতি সাধিত হয়। কেবল অনুবাদক হিসেবে পরিচিত হলেও হুনাইন নিজে বেশকিছু বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে চক্ষুবিদ্যা সম্পর্কে একটি বই রয়েছে, যেখানে প্রথম মানুষের চোখসম্পর্কিত বিস্তারিত সঠিক চিত্র ও আলোচনা উপস্থিত।
এতকিছু সম্ভব হয়েছিল নানা কারণে। প্রথমত বাগদাদের সেই সময়ের জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ, খলিফার প্রণোদনা এবং হুনাইনের নিজের অধ্যবসায়। হুনাইনের চেষ্টা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তারই বয়ান থেকে। গ্যালেনের ‘Treatise of sects’-এর ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘আমি ভুলে ভরা একটি গ্রিক পাণ্ডুলিপি থেকে জুন্দিসপুরের একজন চিকিৎসকের জন্য এটি অনুবাদ করি। এর মধ্যে আমার হাতে আরো অনেক সংস্করণ আসে এবং সেখান থেকে আমি একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। এরপর আমি এর সিরিয়ান সংস্করণ খুঁজে বের করে একে সংশোধন করি। আমার সব কাজই এভাবে করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’
হুনাইনের মতো এমন আরো অনেক নিবেদিত কর্মী এবং জ্ঞানপিপাসু ছিলেন বাগদাদে। মুসা আল খাওয়ারিজমি, ইয়াকুব ইসাক আল কিন্দি, হাসান ইবনে হাইসাম, আল ফারাবি এরা অবশ্য পরবর্তীকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেন, তবে এ জ্ঞান সংগ্রহ-সংকলনের পেছনে কাজ করেছিলেন নেস্তোরিয়ার হুনাইনের মতো মানুষ। যেমন হুনাইনের পর তার ছেলে এবং ভাগ্নে পরবর্তী সময়ে ‘বায়ত আল-হিকমা’ এবং বাগদাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হুনাইনের পদ্ধতি অনুসরণ করেই তারা কাজ করতেন।
আলেকজান্ডারের অভিজান থেকে জ্ঞান ও সংস্কৃতির যে প্রবাহ শুরু হয়েছিল, তা একসময় এভাবেই সীমানা পেরিয়ে বাগদাদে এসে স্থির হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার যেমন একসময় হয়েছিল জ্ঞানপিয়াসীদের তীর্থ, তেমনি প্রায় হাজার বছর পর বাগদাদ মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, প্যাগান, জরথ্রুস্টীয়—সব বিশ্বাসের জ্ঞানপিয়াসীদের তীর্থ হয়ে ওঠে। আলেকজান্দ্রিয়ার সংস্কৃতি বাগদাদের সংস্কৃতিতে মিলেমিশে যায়, বেঁচে থাকে।
মাহমুদুর রহমান: লেখক
লিংকঃ
https://bonikbarta.net/megazine_details/3137