দেশে এত বেশি লঞ্চ দুর্ঘটনা কেন? (The daily Janakantha, 26 July 2020)

Author Topic: দেশে এত বেশি লঞ্চ দুর্ঘটনা কেন? (The daily Janakantha, 26 July 2020)  (Read 1483 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
দেশে এত বেশি লঞ্চ দুর্ঘটনা কেন?
প্রকাশিতঃ জুলাই ২৬, ২০২০         

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির ঘটনা এদেশে নতুন কোন বিষয় নয়। প্রায় প্রতিবছরই লঞ্চডুবিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আহত, নিহত ও নিখোঁজ হন। তখন চোখে পড়ে স্বজন হারানো ব্যক্তিদের আহাজারির দৃশ্য। এ নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়। গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে এ সংক্রান্ত খবরা-খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। আর যথারীতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তখন চিরায়িত প্রথা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর কিছুদিন পরেই দেশে ঘটল অন্য একটি বড় ঘটনা। তখন চাপা পড়ে গেল লঞ্চডুবি বা নৌদুর্ঘটনার ঘটনা। যখন অন্য একটি ঘটনার রেশে লঞ্চডুবি বা নৌদুর্ঘটনার ঘটনা চাপা পড়ে গেল, তখন আর কেউ জানতে পারে না ওই লঞ্চডুবির পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আদৌ নেয়া হয়েছে কি না। কিংবা লঞ্চডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ আলোর মুখ দেখেছে কি না। এই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। দেশে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে লঞ্চডুবির ন্যায় মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত লঞ্চ বা নৌ-দুর্ঘটনা রোধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও দেশবাসী লঞ্চডুবির ঘটনা প্রত্যক্ষ করল গত ৩০ জুন। ওই দিন ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড নামক একটি লঞ্চকে ময়ূর-২ নামের অপর একটি লঞ্চ ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড নামের ওই লঞ্চটি নদীতে ডুবে যায়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এতে প্রাণ হারান ৩৪জন। ইংরেজীতে ‘ডযধঃ রং ষড়ঃঃবফ পধহহড়ঃ নব নষড়ঃঃবফ’ নামক একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ, কপালের লিখন না যায় খ-ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নৌ-পথগুলোতে প্রায় প্রতি বছরই ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি এদেশের জনগণের কপালের লিখন? আবার এসব দুর্ঘটনাগুলোকে যদি এদেশের প্রেক্ষিতে না দেখে যদি উন্নত দেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে উন্নত দেশে লঞ্চডুবি বা নৌ-দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম; যা আমি জার্মানি, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে থাকাকালীন ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ-খবর নিয়েও দেখেছি। তাহলে কপালের লিখন কি দেশ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে? নিশ্চয় না। এ ক্ষেত্রে মূলত যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে; সার্বিক নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন, চালকদের অদক্ষতা, লঞ্চের ফিটসেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, লঞ্চ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, সঠিকভাবে নৌ-আইন না মানা প্রভৃতি। যেমন: মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড নামের যে লঞ্চটি সদরঘাটে ডুবে গেল, সেই লঞ্চের চালকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ওই লঞ্চে থাকা রিফাত আহমেদ নামক এক যাত্রী যিনি গণমাধ্যমের কাছে স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে চালক মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি চালিয়েছেন, আদৌ তার লঞ্চ চালানোর সনদ আছে কি না? কারণ মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসার পর মাঝপথে লঞ্চটি আরেকটি বালুবাহী জাহাজকে (বাল্কহেড) ধাক্কা দিয়েছিল। তখন সবাই ভয় পেলেও ভাগ্যক্রমে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আবার সদর ঘাটের কাছাকাছি আসার পর মর্নিং বার্ড নামক লঞ্চের চালক যদি সতর্ক থাকতেন, তাহলে কিন্তু এই দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত না।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে ৬৬০টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ, আহত হয়েছেন অসংখ্য আর নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৬শ’ জন। ২০১৫ সাল পরবর্তী সময়গুলোতেও দেশে থেমে থাকেনি লঞ্চডুবির ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ আহত-নিহত হওয়া ছাড়াও নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে, যাদের লাশ আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে অসংখ্য পরিবার। আবার লঞ্চডুবিতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে অসংখ্য পরিবার। দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার নৌপথ রয়েছে, যার বেশিরভাগই অরক্ষিত। এসব নৌপথে বৈধভাবে প্রায় ৩ হাজার ছোট-বড় লঞ্চ, জাহাজ চললেও অনুমোদনহীনভাবে চলছে কয়েকগুণ নৌযান। তাছাড়া নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যতসংখ্যক নৌ-পুলিশ থাকা প্রয়োজন তা নেই। এসব নৌ-পুলিশকে বিআইডব্লিউটিএ’র কিছু সার্ভে জাহাজ ও স্পিডবোট দেয়া হলেও এসব নৌযানে নৌপথের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন আধুনিক যান। প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনাসহ হতাহতের ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা রোধে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়। এরপর রহস্যজনক কারণে বিষয়টি আর সামনের দিকে ঠিক ওইভাবে এগোয় না। দেশের কোথাও যখন বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কয়েকদিন ধরে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে আর তেমন কিছু একটা হয় না। অনেক সময় দুর্ঘটনায় জন্য দায়ী ব্যক্তিরা আটক হলেও শেষ পর্যন্ত আইনের ফাকফোকরে বা রাজনৈতিক প্রভাবে কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ছাড় পেয়ে যায়। লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চ মালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে। বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির খুবই কম। তাছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউ-ই শেষ পর্যন্ত তেমন কোন শাস্তি পায় না। বিদ্যমান আইনে লঞ্চমালিক ও চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা খুবই কঠিন। তাছাড়া এই আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। ফলে আইটির সংশোধন হওয়াটা জরুরী।

দেশের নৌপথসমূহে লঞ্চ দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌদুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচারসহ নদী বন্দর টার্মিনালে মেগাফোনের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো জরুরী। অতিরিক্ত যাত্রীবহন রোধ করা, লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদিসহ সার্ভে সনদ অনুযায়ী মাস্টার ও ড্রাইভার যথাযথভাবে আছে কি না নিশ্চিত করাও জরুরী। কোন লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে এবং ওই লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জামাদি না থাকলে ওই লঞ্চের যাত্রা স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট নৌ-আদালতে মামলা দায়ের করা আবশ্যক। আর নৌ-দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযানের ফিসনেট পরীক্ষাপূর্বক ফিসনেস সংবলিত নৌযানগুলোতে দক্ষ, ও দায়িত্ববান চালক নিযুক্ত করা অতি জরুরী। সেই সঙ্গে নৌপথে চলাচলকারী নৌযানে কর্মরত মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানি ও আনসারদের জন্য নিয়মিতভাবে নদী বন্দরগুলোতে নৌনিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মশালার আয়োজন করাও আবশ্যক। দেশের বিভিন্ন নৌপথে নিরাপদে চলাচলের স্বার্থে পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক নৌসহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা দরকার। পাশাপাশি নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক সৎ, মেধাবী ও দক্ষ নৌপুলিশ নিয়োগ দেয়া। এসবের পাশাপাশি ঈদসহ বিভিন্ন ছুটি ও উৎসবের সময়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন পরিহারের লক্ষ্যে স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিসের সুব্যবস্থা করাও আবশ্যক। কোথাও লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধারাভিযানের লক্ষ্যে প্রয়োজন আধুনিক জাহাজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার ও সিপ্লেন। তাছাড়া দেশের বিশাল নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, লঞ্চের ফিটনেস ঠিক আছে কি না নিয়মিতভাবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তদারকি করা আবশ্যক। সর্বোপরি, যাত্রীদেরকেও এক্ষেত্রে হতে হবে আরও বেশি সতর্ক। তারা যেন কখনোই লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে লঞ্চে না ওঠেন। উপরোক্ত বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, গণমাধ্যম ও জনগণ কর্তৃক সুনিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশে লঞ্চডুবি তথা লঞ্চ দুর্ঘটনা নিশ্চয় অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com
Link: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/513760/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%B2%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd