Entertainment & Discussions > Story, Article & Poetry

চামড়া ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙা কি অসম্ভব? (The daily Jugantor, 28 July 2020)

(1/1)

kekbabu:
চামড়া ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙা কি অসম্ভব?
 ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ২৮ জুলাই ২০২০,

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ঈদুল আজহা। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ এবং প্রতিবছর এ দেশে ঈদুল আজহায় ত্যাগের মহিমায় লাখ লাখ পশু তথা গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া কোরবানি করা হয়। ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক, কোরবানিকৃত এসব পশুর চামড়ার টাকা গরিব, এতিম, অসহায়, দুস্থ কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য। সহজভাবে বলতে গেলে কোরবানির পশুর চামড়ার টাকা গরিবের হক। অথচ কয়েক বছর ধরে এ দেশে কোরবানির সময় পশুর চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি না হওয়ায় গরিব-দুঃখী, অসহায় ও দুস্থরা তাদের প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা দুঃখজনক। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৬০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহার সময়; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সময়টাতেই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি শুরু করে।

অসাধু ও ‘শক্তিশালী’ সিন্ডিকেটের বেড়াজালে দেশে কয়েক বছর ধরে ঈদের আগেই কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে আসছে। গত বছর স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার। তারল্য সংকটের অজুহাত তুলে চামড়ার বাজার বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হয়।

গত বছর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার ন্যায্য দাম না পেয়ে লক্ষাধিক পিস পশুর চামড়া ফেলে দেয়, যার অধিকাংশই মাটির নিচে চাপা দেয়া হয়। আবার কিছু ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে। আর রাস্তায় ফেলে যাওয়া চামড়ার পচা-দুর্গন্ধ এখনও জনগণ ভোলেনি। চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ‘চামড়া সিন্ডিকেট’কে দায়ী করে তখন এ বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ নিয়ে খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।

বলা বাহুল্য, চামড়া শিল্পের এ অবস্থার কারণে এ খাতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কমে গেছে। দুই-তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না। গ্রামাঞ্চলে ক্রেতার অভাবে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। গত বছরের মতো এ বছরও যদি চামড়া নিয়ে ওই অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এ খাতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কমে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। সর্বোপরি, দেশের বিপুলসংখ্যক অসহায়, দরিদ্র, দুস্থ ও এতিমরা তাদের ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত হবেন, যা কাম্য নয়।

একটা সময় ৭০-৮০ হাজার টাকা মূল্যের একটি গরুর চামড়া ৪-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে; কিন্তু বিগত বছর এবং তার আগের বছরে চামড়ার দাম এতটাই নিুমুখী ছিল যে, ওই ধরনের গরুর চামড়া ৪-৫শ’ টাকাতেও বিক্রি হয়নি। গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫ টাকা, খাসি ১৮ টাকা ছিল, যা ২০১৭ সালের চেয়ে ৫ টাকা কম। অন্যদিকে, কাঁচা চামড়ার দাম অত্যন্ত কম হওয়া সত্ত্বেও দেশে চামড়ার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র তথা মানিব্যাগ, জুতা, স্যান্ডেলসহ চামড়াজাত অন্যান্য পণ্যের বাজারমূল্য বেশ চড়া।

দেশে চামড়া বাজারে অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বিক্রেতাদের অনেকেই ৩০ শতাংশ কম মূল্যে পশুর চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে ট্যানারি মালিকসহ এ শিল্পসংশ্লিষ্টরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দেশের গরিব, এতিম ও অসহায় মানুষ তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। চলতি বছর করোনা মহামারীর মধ্যে পালিত হতে যাচ্ছে ঈদুল আজহা।

করোনার প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই দেশের গরিব, দুঃখীদের অবস্থা আগের তুলনায় অনেকাংশে খারাপ। এর মধ্যে তারা যদি কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা হক হিসেবে একটু বেশি পরিমাণে পান, তাহলে তাদের জন্য সুবিধা হয়। কিন্তু চামড়ার মূল্য গত বছরের মতো হলে ওইসব গরিব-দুঃখীর কষ্ট লাঘব হবে না। সার্বিক দিক বিচেনায় দেশের চামড়া বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কয়েক বছর ধরে ঈদ মৌসুমে চামড়ার দাম কেন প্রবল মাত্রায় কমে যাচ্ছে? কারা রয়েছে ‘নেপথ্যের কারিগর’ হিসেবে? এদের খুঁজে বের করা কি অসম্ভব? দেখা গেছে, কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়ে দুটি সিন্ডিকেট সর্বদা সক্রিয়। একটি হচ্ছে ট্যানারি মালিকপক্ষ। আরেকটি হচ্ছে আড়তদার পক্ষ। চামড়ার বাজারে করুণ অবস্থার পেছনে অবশ্যই এসব সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কোরবানিদাতা থেকে শুরু করে সবাই কথিত এ ‘সিন্ডিকেট’কে দোষারোপ করে আসছেন।

বিগত বছরগুলোয় চামড়ার দাম কমে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা, পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা পরস্পরকে দায়ী করতে দেখা গেছে। কাঁচা চামড়ার দাম কমানোর নেপথ্যে একদিকে আড়তদারদের দায়ী করে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ, আড়তদারদের ‘সিন্ডিকেট’ চামড়ার দাম কমাতে ভূমিকা রেখেছে। তাদের অভিযোগ, আড়তদাররাই ‘সিন্ডিকেট’ করে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের ঠকাচ্ছে।

ট্যানারি ও আড়তদার ছাড়াও এর সঙ্গে সম্প্রতি নতুন একটি ‘সিন্ডিকেট’ যোগ হয়েছে। সেটি হচ্ছে লবণ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট। ঈদের রাতে বা তার আগের রাতে ৬০ কেজির এক বস্তা লবণের দাম এক হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করা হয়েছে। অথচ, এক সপ্তাহ আগে ওই লবণের দাম ছিল তার অর্ধেক। ত্বরিত গতিতে লবণের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই সংরক্ষণের জন্য চামড়া কিনতে সাহস পায়নি।

চামড়ার বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য এটিও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। চামড়া বাজারের নেপথ্যে থাকা এসব ‘সিন্ডিকেট’-এর সঙ্গে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এদের খুঁজে বের করতে প্রয়োজন শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা।

সরকার কর্তৃক দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও ঈদের দু’দিন আগে থেকেই বেশি দামে চামড়া না কেনার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একের পর এক পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য দিতে দেখা গেছে চামড়া খাতের নেতাদের। ওই সময় ‘বেশি দামে চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে’, ‘আড়তদারদের হাতে চামড়া কেনার মতো নগদ টাকা নেই’, ‘আড়তদাররা এবার সব চামড়া কিনতে পারবেন না’, ‘কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করতে হতে পারে’, ‘লবণ ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে থেকেই লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই কাঁচা চামড়া কম দামে কিনতে হবে’- এমন সব মন্তব্য তারা আগে থেকেই করেছেন।

ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনার ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাবান্বিত হন। অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে তারা ৮০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়ার দাম ২০০ টাকার বেশি বলেননি। কিন্তু এত কম দামে চামড়া কিনেও তা আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে তারাই উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, তখন দেশের অনেক জায়গায় আড়তদাররা চামড়াই কিনতে চাননি।

আবার কেউ কেউ চামড়া কিনলেও যা দাম বলেছিল, তা দিয়ে অধিকাংশ মৌসুমি চামড়া ক্রেতাদের গাড়ি ভাড়ার খরচও ওঠেনি। ফলে যারা সংরক্ষণের কথা ভেবেছিলেন, তারা উল্টো পথে গাড়ি ভাড়ার খরচসহ লবণ কেনা ও মাখিয়ে সংরক্ষণ করার খরচ, এরপর আবারও গাড়ি ভাড়া দিয়ে পরে এর চেয়ে বেশি দাম পাবেন কি-না বা সেই দামে পোষাবে কিনা ইত্যাদি বিষয় ভেবে অনেকে রাস্তাতেই কাঁচা চামড়া ফেলে চলে যান। অনেকে চামড়ার দামের কথা শুনে মাটিতে পুঁতে ফেলেন।

বিগত কয়েক বছর দেশব্যাপী চামড়া নিয়ে যে অসন্তোষ দেখা গেছে, তা যেন এ বছর কোনোভাবেই দেখা না যায়, সেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবশ্যই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা প্রতিবছরই একে অপরকে দোষারোপ করে পার পেয়ে যায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয় মৌসুমি ব্যবসায়ী আর বঞ্চিত হয় কোরবানিদাতা এবং গরিব ও এতিমরা। তাই অবিলম্বে এ অবস্থার অবসান ঘটাতে সরকারের পাশাপাশি দেশের সচেতন জনগণ, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিতভাবে দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/window/330182/%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%9F-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%AC

Navigation

[0] Message Index

Go to full version