কৃষিই ভরসার জায়গা

Author Topic: কৃষিই ভরসার জায়গা  (Read 1497 times)

Offline Badshah Mamun

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 1997
    • View Profile
    • Daffodil International University
কৃষিই ভরসার জায়গা
« on: February 09, 2021, 10:51:22 AM »
কৃষিই ভরসার জায়গা

করোনাকালের ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন এ কথা আবারো প্রমাণ করল কৃষকরাই বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। কেননা, করোনাকালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ছাত্র-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন লকডাউনে ঘরবন্দী, তখনো মাঠে তৎপর ছিলেন বাংলার কৃষকরা। করোনার ঝুঁকি নিয়েও তারা দিনরাত খেটে ফলিয়েছেন সোনার ফসল। বলতে দ্বিধা নেই, কৃষকের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দী ১৭ কোটি মানুষের জীবন। করোনায় সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও কৃষকরাই সচল রেখেছেন দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ বলছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দী মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল কৃষিপণ্য। করোনাকালে লকডাউনে পরিবহন, হাটবাজার সবকিছু ছিল বন্ধ আর ক্রেতারা গৃহবন্দী থাকায় কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। করোনার ক্ষতির মধ্যে এসেছে বন্যার দীর্ঘস্থায়িত্ব। কিন্তু তারপরও কৃষকরা দমে যাননি। নিবিষ্ট মনে বাংলার কৃষকরা উৎপাদনে নেমেছেন ফসলের মাঠে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশের কৃষি খাতের এই অবদান আবারও মনে করিয়েছে, ‘কৃষিই আসল ভরসা’ ।


আসল ভরসা কৃষি

কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো, দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। আমরা জানি, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং রেমিটেন্সের ওপর। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও রেমিটেন্স ওঠানামা করে। তবে কৃষি অনেকটাই স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষি কোনো না কোনোভাবে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতার আগে দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, অথচ স্বাধীনতার চার দশক পর ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা। উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ডেভরেসোন্যান্সলির গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষকরা তাদের কৃষিজমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসলও ফলিয়ে থাকেন। জমিতে কোনো না কোনো সবজির চাষ করেন ৭৮ শতাংশ কৃষক। ২৬ শতাংশ কৃষক জমিতে পাট চাষ করেন। ১২ শতাংশ কৃষক জমিতে মাছের চাষ করেন, প্রায় সমসংখ্যক কৃষক সরিষা, ডাল এবং রসুন উৎপাদন করেন। বাদাম এবং সয়াবিন উৎপাদন করেন ১০ শতাংশ কৃষক। ভুট্টা চাষ করেন ৫ শতাংশ কৃষক। আম চাষ করেন ৪ শতাংশ কৃষক। পেঁয়াজ চাষ করেন ৪ শতাংশ কৃষক। তিল চাষ করেন ৩ শতাংশ কৃষক। পান উৎপাদন করেন ৩ শতাংশ কৃষক। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক কৃষক তাদের জমিতে অন্যান্য ফল ও ফুলেরও চাষ করেন। তবে ১২ শতাংশ কৃষক ধান ছাড়া অন্য কোনো কৃষিকাজে তাদের জমি ব্যবহার করেন না। করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে। এত দিন চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। খাদ্যশস্য উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী এখনো ধান চাষে গ্রামবাংলার ৪৮ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের যে অংশগ্রহণ, তার অর্ধেক এবং জাতীয় আয়ের ৬ ভাগের ১ ভাগ আসে ধান থেকে। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার প্রতিবছর ১ কোটি ৫ লাখ হেক্টর একর জমিতে ধান চাষ করছে।

কৃষিই চালিকাশক্তি

কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উত্পাদন বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশ-সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে কৃষি খাতের উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল। আশার খবরটি হচ্ছে, কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রেকর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বিশ্বে পথিকৃৎ বাংলাদেশ।

প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। বাংলাদেশ এখন চাল, আলু ও ভুট্টা রপ্তানি করছে।

করোনায় কৃষকের ক্ষতি

করোনার লকডাউনের ফলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও কৃষির অন্য ক্ষেত্র যেমন: সবজি, ফল, ফুল, মাছ, গবাদিপশু, পাখি ইত্যাদি চাষাবাদ বা পালনে করেনাকালের প্রভাব লক্ষণীয়। ডেভরেসোন্যান্সলির গবেষণায় ৯০ শতাংশ কৃষক বলেছেন, করোনার কারণে তাদের কৃষি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৭৮ শতাংশ কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজি, মাছ, দুধ, ডিম, এমনকি পোলট্রি বাজারজাত করতে সমস্যায় পড়েছেন। পরিবহন ও হাটবাজার সীমিত হওয়ায় খুব কমই বাজারে নিতে পারছেন। ৩৮ শতাংশ কৃষক বলেছেন, বাজারে যতটুকু কৃষিপণ্য যাচ্ছে, তার সঠিক দামও পাচ্ছেন না; এমনকি বিক্রিও হচ্ছে না। বেগুন, শসা, শিম ও আলুর মতো সবজি বিক্রিতে কৃষককে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। এ গবেষণায় করোনার কারণে কৃষকের পরিবারপ্রতি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৫৩ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ১০ দশমিক ৫ শতাংশ । এ ছাড়া সম্ভাব্য ক্ষতির ক্ষেত্রসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজার এবং পণ্য সরবরাহ বা যোগাযোগব্যবস্থা পূর্ণরূপে সচল হতে যদি আরো ৩-৪ মাস সময় লাগে, তাহলে শুধু কৃষি খাতে পরিবারপ্রতি সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে গড়ে ৭৩ হাজার ১০০ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ৩৯ শতাংশ ।

শীর্ষত্বের লড়াইয়ে বাংলাদেশের কৃষি


কৃষি খাতে আমাদের অকল্পনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। কৃষি এখন শুধু ফসলের মাঠে নয়; মৎস্য, গবাদিপশু পালন, সবজি ও ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে শুরু করে ব্যতিক্রম এবং নতুন নতুন কৃষিজ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও সাফল্য দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে। ছাদকৃষিতেও ব্যাপক সাফল্য, আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭০ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি), বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) কৃষিজ জাত উদ্ভাবনে ক্রমাগতভাবে সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে । বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তার সঙ্গে বিশেষ অবদান রয়েছে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিষ্ট গবেষণায় উচ্চফলনশীল, কম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন জাত ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদিপশু, পোলট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি।
 

লেখক: কৃষি ও শিল্প-অর্থনীতি বিশ্লেষক

Source: https://www.sarakhon.com/16320/%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%87-%E0%A6%AD%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%97%E0%A6%BE
Md. Abdullah-Al-Mamun (Badshah)
Senior Assistant Director
Daffodil International University
01811-458850
cmoffice@daffodilvarsity.edu.bd
www.daffodilvarsity.edu.bd

www.fb.com/badshahmamun.ju
www.linkedin.com/in/badshahmamun
www.twitter.com/badshahmamun