আশি কিংবা নব্বই দশকের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া যে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কোন কলমে লেখা শুরু করছেন? তবে নিশ্চিত থাকুন উত্তরটা আসবে, ইকোনো। ইকোনো, বাংলাদেশের প্রথম বলপয়েন্ট কলম। ইকোনো, আশি-নব্বইয়ের দশকের সবার কাছে শুধুমাত্র বলপেনই নয় বরঞ্চ নস্টালজিয়ার নাম।
১৮৮৮ সালে দেশের প্রথম প্লাস্টিক কলম ইকোনো বাজারজাত করে জিকিউ কোম্পানি। ৩ টাকা দামের কলমটি অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় দেশজুড়ে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের কাছে থেকে এর জনপ্রিয়তা পৌঁছে যায় অফিসেও। শহরতো বটেই গ্রামেও বাড়তে থাকে চাহিদা। সেসময় ৭ টাকা দামের রেডলিফ কলম পাওয়া গেলেও, সাশ্রয়ী মূল্যই দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে ইকোনোকে।
নস্টালজিয়া ভরা ইকোনো যুগ
৩ টাকার ইকোনো যুগে হঠাৎ আগমন ঘটে সাড়ে ৩ টাকার ইকোনো ডিএক্স’র। কালোর সাথে যুক্ত হয় লাল ও নীল রঙ। শৈশবের আনন্দে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। বইয়ের সাদা-কালো ছবিগুলোতে, শিউলিফুল ঘসে-ঘসে কমলা রঙের সাথে এঁকে দেওয়া যায় নীল আকাশে। যে আকাশে নেই কোনো কালো মেঘ, শৈশবের দুরন্তপনার সাথে হাতছানি দেয় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। ঘোমটা টানা বউটার কপালে টুক করে লাল টিপ পড়িয়ে দেয়া, মাঠে গরু নিয়ে যাওয়া রাখাল ছেলেটির খালি গাঁয়ে নীল রঙের গেঞ্জি পড়িয়ে দেওয়া। লাল-নীলে ভরা নতুন এক অনুভূতি।
এই কালিতে স্কুলের শার্ট প্যান্টের পকেট ভরায়নি এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। এই ঘটনার প্রচলিত শব্দ হল, ‘কলম হেগে দিয়েছে’!
তাই বলে কি সবাই আর এই অনুভূতি পায়? পঞ্চাশ পয়সা বেশি দামের এই অনুভূতি কিনতে মায়ের কড়া নিষেধ। ক্লাসে শুধু আড় চোখে বন্ধুর কলম দেখা ছাড়া কি আর করার! তাতে কি টিফিন প্রিয়ড কিংবা ক্লাসের ফাকে ‘কলম খেলা’ কিংবা ‘পেন ফাইটিং’ সব আফসোস ভুলিয়ে দেয়। কলম ফাইটকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে শিক্ষকদের ভয়। স্যার-ম্যাডাম যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়ে যায় পিঠের বেতের ঘা ফরজ হয়ে যাবে।
সাদা-কালো রঙের ষড়ভূজ আকৃতির কলমের সাথে কালো একটা মুটকি, মুটকির সাথে চিকন একটা ডান্ডা। কলম কেনার দিনই কামড়িয়ে বাঁকা করিয়ে ফেলা ডান্ডাটি। কিংবা চিবিয়ে চিবিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলা। সে চিবানোর মধ্যেও অন্যরকম অনুভূতি। লেখার সাথে কালির তীব্র ঘ্রান। কলমের মুখের দিকটা আগুনে গলিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে ফু দিলেই গলে যাওয়া অংশ থেকে অবিকল বেলুনের মত ফুলে যাওয়া স্বচ্ছ গোলাকার বল বের হত! আহা! কি দারুণ সে শৈশব!
লিখতে লিখতে হঠাৎ শেষ কলমের কালি, মায়ের কাছে যেয়ে, কলম কেনার জন্য ৩ টাকা চাইতেই, মা কটমট করে তাকিয়ে বলেন, ‘সেদিনইতো কলম কিনলি, যা নিয়ে আয় দেখি কলমটা’। কলমের পিছনের ছিদ্র দিয়ে মা তাকিয়ে দেখেন কালি জমে।আছে কি। চুলো কিংবা ল্যাম্পোর আগুনে তাপ দিয়ে গলিয়ে ফেলেন জমাট কালি। চলে যায় আর কয়েকদিন।
প্রায়ই কলমের পিছন দিয়ে কালির বের হয়ে নষ্ট করে দেয় জামা-প্যান্ট। বিশেষ করে এই কালিতে স্কুলের শার্ট প্যান্টের পকেট ভরায়নি এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। এই ঘটনার প্রচলিত শব্দ হল, ‘কলম হেগে দিয়েছে’! শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটিই ছিলো বাস্তবতা।
সাদাকালো যুগের বিটিভিতে ইকোনো কলমের শিহরণ জাগানো বিজ্ঞাপন। একটা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ছিলো, ‘আব্বুর জন্য ইকোনো, আম্মুর জন্য ইকোনো, সবার জন্য ইকোনো।’ অন্য একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যেতো, একটা কলম একটানা দাগ দিয়ে চলেছে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বলতো, ‘এক কলমে মাইল পার!’ এই বিজ্ঞাপনটি দেখে মাথায় একটায় চিন্তা আসতো, কিভাবে এক মাইল লেখা যায়! এক মাইল লম্বা কাগজ কি আদৌ আছে?
যেভাবে হারিয়ে গেলো ইকোনো যুগ
ঘড়ির কাঁটা থমকে গেলেও, অপেক্ষা করেনি সময়। শৈশব গড়িয়ে, কৈশোর, যৌবন পেড়িয়েব,জীবন অনেকের প্রান্ত বেলায়। শৈশবের আনন্দমাখা দিনগুলোর সাথে আজ হারিয়ে গেছে ইকোনো। বর্তমান প্রজন্মতো নাম শুনলে চিন্তেই পারবে না। কিন্তু এক প্রজন্মের হাসি-কান্না, উচ্ছাস ভরা জীবনের সাক্ষী কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে?
১৯৮৮ সালে ইকোনো বাজারে আসার পরপরই, এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়, ৫ বছরে এর রেভিনিউ দাঁড়ায় ২ গুণ। ১৯৯৩ সালে এর রেভিনিউ ছিলো ২৫ কোটি টাকা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁড়তে থাকে ইকোনোর নির্ভরশীলতা।১৯৯৭ সালে রেভিনিউ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪০ কোটি টাকা।
জনপ্রিয়তা আর বিক্রি বাঁড়লেও ইকোনো ডিএক্সের পর নতুন কোনো ডিজাইন আসেনি বাজারে। ১৯৯৮ সালে বাজরে আসে ম্যাটাডোর। সম্পূর্ণ ভিন্নতা নিয়ে বাজারে ম্যাটাডোর। রাবার গ্রিপ বডি সাথে সূক্ষ নিপ, আকর্ষণীয় ডিজাইন। রাবার গ্রিপের বডি হওয়ায় ধরতে আরামদায়ক, সূক্ষ্ম নিপে লেখা হয় স্মুথলি। সাথে আকর্ষণীয় রঙ আর ডিজাইন ফলে অল্প সময়েই ক্রেতাদের নজর কারে ম্যাটাডোর।
ম্যাটাডোরের উত্থানের সাথে-সাথে মার্কেট হাঁরাতে থাকে ইকোন। ম্যাটাডোর ২ টাকা বেশি হলেও, এর ব্যবহার উপযোগিতা সবার ভরসা গ্রহণ করে। পাশাপাশি ম্যাটাডোরের উপযোগিতা সামনে নিয়ে আসে ইকোনোর ত্রুটিগুলো। ইকোনোর নিপ মোটা, স্মুথলি লেখা যেতো না। লেখার সময় কালি ছড়িয়ে যাওয়া। ইকোনোর ডিজাইনে পেছনে ছিদ্র ছিলো, ফলে কালি পকেটে ছড়িয়ে যেতো। কিন্তু কালি ছড়িয়ে যাওয়া বন্ধে ম্যাটাডোর কলমের পিছনে যুক্ত করে পিন। ইকোনোর প্লাস্টিক বডি, রাবার গ্রিপ নেই, তারউপর ষড়ভুজ আকৃতি ধরতে কষ্ট দীর্ঘক্ষণ লিখতে কষ্ট। সবশেষ ডিজাইনের অল্প কয়টি।
২০০২ সালে ইকোনোর রেভিনিউ ৪০ কোটি থেকে একাবের অর্ধেকে এসে থামে ২২.৫কোটিতে। ২০০৪ সালে মার্কেটে টিকে থাকতে ০.৫ মিমি নিপের কলম আনে ইকোনো। কিন্তু ততদিনে মার্কেটের রাজত্ব নিয়েছে ম্যাটাডোর। ২০০৭ রেভিনিউ নেমে আসে ১৭ কোটি টাকায়। ২০০৮ সালে বেশ কিছু মডেলের কলম বাজারে ছাড়লেও। পর্যাপ্ত মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপনের অভাব, সেই সাথে ম্যাটাডোরের পাশাপাশি মেরিট ও অলেম্পিক কোম্পানির কলমের ভিড়ে জায়গা করতে পারেনি ইকোনো।
ইকোনোর কলম এখন বাজারে পাওয়া গেলেও, সেই ইকোনো বা ইকোনো ডিএক্স আর বাজারে নেই। ফলে সময়ের সাথে হারিয়ে গিয়েছে এক প্রজন্মের নস্টালজিয়া। যা আজ শুধুই স্মৃতি।
Source:
https://obboymedia.com/%E0%A6%87%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%AE/