কুরবানীর ফজিলত,করণীয় ও বর্জনীয়

Author Topic: কুরবানীর ফজিলত,করণীয় ও বর্জনীয়  (Read 690 times)

Offline ashraful.diss

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 162
  • 'শীঘ্রই রব তোমাকে এত দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে'
    • View Profile
    • Daffodil Institute of Social Sciences - DISS
কুরবানীর ফজিলত,করণীয় ও বর্জনীয়ঃ

আমরা যে কুরবানী করি তা হযরত ইবরাহীম (আ.) থেকে প্রাপ্ত প্রিয় জিনিস আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার নমূনা। এজন্য আল-হাদীসে কুরবানীকে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত আছে,

وعَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ؟ قَالَ سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ قَالُوا فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ! قَالَ بِكُلِّ شَعْرَةٍ حَسَنَةٌ قَالُوا فَالصُّوفُ يَا رَسُولَ اللَّهِ! قَالَ بِكُلِّ شَعْرَةٍ مِنْ الصُّوفِ حَسَنَةٌ”  رواه أحمد والترمذي وابن ماجه

“হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এর সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কুরবানী কী? উত্তরে নবীজি ইরশাদ করলেন, কুরবানী তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত, তারা বললেন এতে আমাদের কী ফজিলত? নবীজি বললেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। তারা বললেন, ছুফ এর জন্যও কি? নবীজি জবাব দিলেন, ছুফ (অধিক পশম বিশিষ্ট পশু) এর জন্য নেকী রয়েছে।” (সূনান ইবনে মাজাহ)

কুরবানীর ফযীলত:

(ক) কুরবানী দাতা নবী ইব্রাহীম (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)- এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

(খ) পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাববুল ‘আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :-

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ الحج: ٣٧

আল্লাহর নিকট পৌছায় না উহার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এ ভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়নদেরকে। [সূরা হজ্জ্ব:৩৭]।

কুরবানীর দিনে সবচেয়ে প্রিয় কাজ পশু কুরবানী করা। কুরবানীর পশুর রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

 عَنْ عَائِشَةَ ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ قَالَ : مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلاً أَحَبَّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ، مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ ، وَإِنَّهُ لَتَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، بِقُرُونِهَا ، وَأَظْلاَفِهَا ، وَأَشْعَارِهَا ، وَإِنَّ الدَّمَ ، لَيَقَعُ مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ، بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الأَرْضِ ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا.

“হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, কুরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশমসমূহ নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কুরবানীর রক্ত জমিনে পতিত হবার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কুরবানির দ্বারা নিজেদের নফসকে পবিত্র কর।” (সূনান ইবনে মাজাহ)

আল-কুরআনের এ আয়াত ও হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়, পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানীদাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করেন। এবং পশু কুরবানী করার বারাকা হিসেবে যে পশু যবেহ করা হয় তার গায়ের পশম সমপরিমান বা তার পাঁচগুন সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللهِ ؟ قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ ، حَسَنَةٌ قَالُوا : فَالصُّوفُ ؟ يَا رَسُولَ اللهِ ، قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ ، حَسَنَةٌ

“সাহাবীরা বললেন এতে আমাদের কী ফজিলত? নবীজি বললেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব। তারা বললেন, ছুফ এর জন্যও কি? নবীজি জবাব দিলেন, ছুফ (অধিক পশম বিশিষ্ট পশু) এর জন্য নেকী রয়েছে।” (সূনান ইবনে মাজাহ)

(গ) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কুরবাণীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানী না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না। কুরবানীর ফজীলত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলোর উপর আল্লাহ আমাদের  আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি:

কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন নেক আমল, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না; যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে ( যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দু‘টি শর্ত পূরণ হয়েছে:

প্রথমত: ‘ইখলাস’, অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন,

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ ٢٧المائ‍دة: ٢٧

অর্থাৎ ‘আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবূল করে থাকেন। [ সূরা মায়িদা (৫):২৭]।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ الحج: ٣٧

অর্থাৎ, ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ (২২):৩৭]

দ্বিতীয়ত : তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। [সূরা কাহফ:১১০]।

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়- তা বলাই বাহুল্য। গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বলেই লোকে একই মূল্যের একটি পূর্ণ পশু কুরবানী না করে একটি ভাগ দিয়ে থাকে। ফলে, একটি ছাগল দিলে দু‘দিনেই শেষ হয়ে যাবে। লোকেরা ছেলে-মেয়েরা খাবে, আর আমার ছেলে-মেয়েরা তাকিয়ে ও দেখবে? উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

তবে, বাহ্যিকভাবে কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে:

(১) এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেনী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আন‘আম।’ যেমন এরশাদ হয়েছে-

وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ الحج: ٣٤

আমি প্রত্যেক সম্প্রদাযের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ [সূরা হজ্জ্ব(২২):৩৪]

হাদিসে এসেছে-

عن جابر رضى الله عنه قال:قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : «لا تذبحوا إلا مسنة إلا أن تعسر عليكم فتذبحوا جذعة من الضأن

‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার।’ [মুসলিম, হাদীস নং ১৯৬৩]।

আর আল্লাহর রাসূল (সা.) উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য লোক জন্তু কুরবানী করেননি ও কুরবানী করতে বলেননি। তাই কুরবানী শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে কুরবানীর জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম (সা.) এ ধরনের দুম্বা কুরবানী করেছেন বলে সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানীর পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, ৫/৬৩৪)।

একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩১৮) অন্য এক বর্ণনামতে, উট কুরবানীতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার, ৮/১২৬)

 যেমন হাদিসে এসেছে-

عن جابر رضى الله عنه أنه قال: «نحرنا بالحديبية مع النبي صلى الله عليه وسلم البدنة عن سبعة والبقرة عن سبعة »

‘আমরা হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি।’ (ইবনে মাজা-৩১৩২, হাদিসটি সহীহ)।

কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগল যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। এ বিধানটি সফরের অবস্থায় প্রযোজ্য। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

(২) শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু‘বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায় । প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘দাতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৬৩)

কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছ‘মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ঐ হাদীসের আদেশকে ‘ইস্তিহবাব’ (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঐ হাদীসের মর্মার্থ এটা নয় যে, অন্য কুরবানীর পশু পাওয়া গেলে তবেই ছ‘মাস বয়সের মেষশাবকের কুরবানী বৈধ।যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ বয়সী মেষেরও কুরবানী বৈধ; প্রকাশ থাকে যে, যদিও কুরবানীদাতা অন্য দাতালো পশু পেয়ে থাকে। যেমন রাসূল (সা.) বলেন, ছ‘মাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কুরবানী। (মুসনাদে আহমাদ, ২/৪৪৫; তিরমিযী)

উক্ববা বিন আমের (রা.) বলেন, (একদা) নবী (সা.) কুরবানীর পশু বিতরণ করলেন। উক্ববার ভাগে পড়ল এক ছ‘মাসের মেষ। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভাগে ছ‘মাসের মেষ হলো?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘এটা দিয়েই তুমি কুরবানী কর।’ (সহীহ বুখারী , হাদীস নং ২১৭৮; সহীহ মুসলিম, ১৯৬৫)।

(৩) কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে-

عن البراء بن عازب رضى الله عليه وسلم قال: « قام فينا رسول الله صلى الله وسلم فقال:أربع لا تجوز في الأضاحي العوراء البين عورها والمريضة البين مرضها والعرجاء البين ضلعها والكسيرة التي لا تنقى »

সাহাবী বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন : চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। নাসাঈ‘র বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে। (তিরমিজি-১৫৪৬; নাসাঈ’-৪৩৭১; আবূদাউদ; হাদিসটি সহীহ)।

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।’ (মুগনী, ১৩/৩৬৯)

ত্রুটিগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হলো:

১. স্পষ্ট কানা (এক চক্ষু অন্ধ): যে পশুর একটি চক্ষু নষ্ট হয়ে গেছে অথবা বেরিয়ে আছে । দৃষ্টিহীন হলে তো অধিক ত্রুটি হবে। তবে যে পশুটির চক্ষু সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি, সেটির কুরবানী সিদ্ধ হবে। কারণ, তা স্পষ্ট কানা নয়।

২. স্পষ্ট রোগের রোগা : যে পশুর ওপর রোগের চি‎হ্ন প্রকাশিত। যেটি চলতে অথবা খেতে পারে না; যার দরুন দুর্বলতা ও মাংসবিকৃতি হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে, চর্মরোগও একটি ত্রুটি, যার কারণে চর্বি ও মাংস খারাপ হয়ে থাকে। তেমটি স্পষ্ট ক্ষত একটি ত্রুটি,যদি তার ফলে পশুর ওপর কোন প্রভাব পড়ে থাকে। তবে, গর্ভধারণ কোন ত্রুটি নয়। তবে গর্ভপাত বা প্রসবের টিকটবর্তী পশু একপ্রকার রোগ গ্রস্থতা এবং তা একটি ত্রুটি। যেহেতু গাভীন পশুর গোশত অনেকের নিকট অরুচিকর, সেহেতু জেনেশুনে তা ক্রয় করা উচিত নয়। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট বা ক্রয় করার পর গর্ভের কথা জানা গেলে তা কুরবানীরূপে যথেষ্ট হবে। বাচ্চা মৃত হলে যবেহ না করেই খাওয়া যাবে। কেননা, মায়ের যবে হতে সেও হালাল হয়ে যায়। (আহমাদ, আবু দাউদ , তিরিমযী, ইবনু মাজাহ, ইবনে হিববান, হাকেম, দাবা কুত্বনী, ত্বাবারীনী, সহীহুল জামে‘, হাদীস নং ৩৪৩১)।

৩. দুরারোগ্য ভগ্নপদ।

৪. দুর্বলতা ও বার্ধক্যের কারণে যার চর্বি ও মজ্জা নষ্ট অথবা শুষ্ক হয়ে গেছে।

উপরে উল্লেখিত হাদীসে মোট চারটি ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয় বলে বর্ণিত হয়েছে এবং বাকী অন্যান্য ত্রুটির কথা বর্ণনা করা হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে, যদি ঐ ত্রুটিসমূহের অনুরূপ বা ততোধিক মন্দ ত্রুটি কোন পশুতে পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কুরবানী সিদ্ধ হবে না; যেমন- দুই চক্ষু অন্ধ বা পা কাটা প্রভৃতি। (শরহুন নববী, ১৩/২৮)

খাত্ত্বাবী (রাহ.) বলেন, হাদীসে এ কথার দলীল রয়েছে যে, কুরবানীর পশুতে স্পষ্ট খঞ্জ।’ অতএব ঐ ত্রুটির সামান্য অংশ অস্পষ্ট হবে এবং তা মার্জনীয় ও অধর্তব্য হবে। (মাআলিমুস সুনান, ৪/১০৬)।

পক্ষান্তরে, এমন কতগুলো ত্রুটি আছে যা থাকলে কুরবানী আদায় হয় কিন্তু তা মাকরূহ বলে বিবেচিত হয়। তাই এ জাতীয় ত্রুটি থেকেও কুরবানীর পশুকে মুক্ত করা উত্তম।

যে ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী মাকরূহ হবে তা হলো:

• কান কাটা বা শিং ভাংগা :

এ ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী মাকরূহ। তবে আদায় হয়ে যাবে। কারণ, এতে মাংসের কোন ক্ষতি বা কম হয় না এবং সাধারণত এমন ত্রুটি পশুর মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে পশুর জন্ম থেকেই শিং বা কান নেই তার দ্বারা কুরবানী মাকরূহ নয়। যেহেতু ভাঙ্গা বা কাটাতে পশুর রক্তাক্ত ও ক্লিষ্ট হয়; যা এক প্রকার রোগের মতো। কিন্তু জন্ম থেকে না থাকাটা এ ধরনের কোন রোগ নয়। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ পশুই উত্তম।

• লেজ কাটা:

যে পশুর পূর্ণ অথবা কিছু অংশ লেজ কাটা গেছে তার কুরবানী মাকরূহ। ভেড়ার পুচ্ছে মাংসপিণ্ড কাটা থাকলে তার কুরবানী সিদ্ধ নয়। যেহেতু তা এক স্পষ্ট দাগ এবং সামান্য অংশ। অবশ্য এমন জাতের ভেড়া যার পশ্চাতে মাংসপিণ্ড হয় না তার দ্বারা কুরবানী শুদ্ধ।

• কান চিরা, দৈর্ঘ্যে চিরা, পশ্চাৎ থেকে চিরা, সম্মুখ থেকে প্রস্থে চিরা, কান ফাটা ইতাদি।

• লিঙ্গ কাটা। অবশ্য অণ্ডকোষ কাটা মাকরূহ নয়। যেহেতু খাসীর দেহ হৃষ্টপুষ্ট ও মাংস উৎকৃষ্ট হয়।

• দাঁত ভাঙ্গা ও চামড়ার কোন অংশ অগভীর কাটা বা চিরা ইত্যাদি।

(৪) যে পশুটি কুরবানী করা হবে তার উপর কুরবানী দাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব থাকতে হবে। অর্থাৎ কুরবানীদাতা যেন বৈধভাবে ঐ পশুর মালিক হয়। সুতরাং চুরিকৃত, আত্মসাৎ কৃত, বন্ধকী পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া, অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশু দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না। একই ভাবে অবৈধ মূল্য যেমন সুদ, ঘুষ, প্রবঞ্চনা, ধোঁকা প্রভৃতির অর্থ) দ্বারা ক্রীত পশুর কুরবানী জায়েয নয়। যেহেতু কুরবানী এক ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর কুরবানীর পশুর মালিক হওয়ার ঐ সকল পদ্ধতি হলো পাপপূর্ণ। আর পাপ করার মাধ্যমে কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৫)।

কুরবানীর পশু নির্ধারণে মুসলিম সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত, যাতে পশু সর্বগুণে সম্পূর্ণ হয়। যেহেতু এটা আল্লাহর নিদর্শন ও তা‘যীমযোগ্য দ্বীনি প্রতিক সমূহের অন্যতম যা আত্মসংযম ও তাক্বওয়ার পরিচায়ক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ الحج
٣٢
অর্থাৎ, ‘এটিই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সম্মান করলে এতে তার হৃদয়ের তাক্বওয়া সঞ্জাত। [সূরা হাজ্জ:৩২]।

এতো সাধারণ দ্বীনী প্রতীকসমূহের কথা। নির্দিষ্টভাবে কুরবানীর পশু যে এক দ্বীনী প্রতীক এবং তার যত্ন করা যে আল্লাহর সম্মান ও তা‘যীম করার শামীল, সে কথা অন্য এক আয়াত আমাদেরকে নির্দেশ করে। মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ (কুরবানীর)

وَٱلۡبُدۡنَ جَعَلۡنَٰهَا لَكُم مِّن شَعَٰٓئِرِ ٱللَّهِ لَكُمۡ الحج ٣٦

উটকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম করেছি। [সূরা হাজ্জ:৩৬]

এখানে কুরবানী পশুর তা‘যীম হবে তা উত্তম নির্বাচনের মাধ্যমে। ইবনে আববাস (রা.) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কুরবানী পশুর সম্মান করার অর্থ হলো, পুষ্ট, মাংস, সুন্দর ও বড় পশু নির্বাচন করা।’ (তাফসীরু ইবনু কাসীর, ৩৬/২২৯)

রাসূল (সা.) এর যুগে মুসলিমগণ দামী পশু কুরবানীর জন্য ক্রয় করতেন, মোটা-তাজা এবং উত্তম পশু বাছাই করতেন; যার দ্বারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর তা‘যীম ঘোষণা করতেন। যা একমাত্র তাদের তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি ভীতি ও ভালবাসা থেকে উদগত হতো। (ফতহুল বারী, ১০/০৯)

অবশ্য মুসলিমকে এ ক্ষেত্রে খেয়াল করা উচিত যে, মোটা-তাজা পশু কুরবানী করার উদ্দেশ্য কেবল উত্তম মাংস খাওয়া এবং আপোষে প্রতিযোগিতা করা না হয়। বরং উদ্দেশ্য আল্লাহর নিদর্শন ও ধর্মীয় এক প্রতীকের তা‘যীম এবং তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানী উত্তম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কালো রঙের দু‘টি কুরবানী অপেক্ষা ধূসর রঙের একটি কুরবানী আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়।’ (আহমাদ, হাকিম, সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদীস নং ১৮৬১)

সুতরাং কুরবানীর পশু ক্রয়ের সময় ত্রুটিমুক্ত দেখা ও তার বয়সের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। যেহেতু পশু যত নিখুত হবে তত আল্লাহর নিকট প্রিয় হবে, সওয়াবেও খুব বড় হবে এবং কুরবানীদাতার আন্তরিক তাক্বওয়ার পরিচায়ক হবে।

কারণ আল্লাহ বলেন:

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧الحج: ٣٧

অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ:৩৭]।

« Last Edit: September 15, 2021, 11:26:41 AM by ashraful.diss »
Hafez Maulana Mufti. Mohammad Ashraful Islam
Ethics Education Teacher, DISS
Khatib, Central Mosque, Daffodil Smart City
Ashuli , Savar, Dhaka