মানুষ যদি মানুষের পাশেই না যায়, তবে এতো সময় বাঁচিয়ে কি হবে বলো ??
বাবার সাথে প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে ব্যাংকে বসে আছি। বিরক্ত হচ্ছি খুব। যত না  নিজের উপর,  তার চেয়ে  বেশি বাবার উপর। অনেকটা রাগ করেই বললাম, বাবা,  কতবার বলেছি,অনলাইন  ব্যাঙ্কিংটা শিখো।
বাবা :  এটা শিখলে কি হবে?
ঘরে বসেই তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারতে।  শুধু ব্যাংকিং না। শপিংটাও তুমি অনলাইনে করতে পারো। ঘরে বসে ডেলিভারি পেতে পারো।  খুবই সহজ। কিন্তু এই সহজ জিনিসটাই করবে না।
বাবা :  করলে আমাকে ঘরের বাইরে বের হতে হতো না, তাই না?
হ্যাঁ, বাবা তাই।  এখানে এসে ঘন্টা খানেক অনর্থক বসে থাকতে হতো না। 
এরপর বাবা যা বললেন, তাতে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। 
বাবা বললেন: এতো সময় বাঁচিয়ে তোমরা কি করো।  ফোনেই তো সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকো। কবে শেষদিন তুমি তোমার খালা/ফুফুর সাথে কথা বলেছো? দশ হাত দূরে প্রতিবেশী বৃদ্ধ গফুর চাচার খবর নিয়েছো? অথচ, আপন জনের সাথে দেখা করতে দশ মাইল পথ হেঁটেছি। সময় বাঁচানোর চিন্তা করিনি। মানুষ যদি মানুষের পাশেই না যায়, তবে এতো সময় বাঁচিয়ে কি হবে বলো।
বাবার কথা পাশ থেকে মানুষেরা শুনছেন। আমি চুপচাপ বসে আছি।
বাবা বললেন:  ব্যাংকে প্রবেশের  পর থেকে চারজন বন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় করেছি। তুমি জানো,  আমি ঘরে একা। তাই ঘর থেকে বের হয়ে আসাটাই আমার আনন্দ। এইসব মানুষের সাহচর্যটাই আমার সঙ্গ। আমার তো এখন সময়ের কমতি নেই।  মানুষের সাহচর্যেরই কমতি আছে। ডিভাইস, হোম-ডেলিভারি, এনে দেবে...... মানুষের সাহচর্য তো আমায় এনে দেবে না।
মনে পড়ে, দু বছর আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যে দোকান থেকে আমি দৈনন্দিন কেনাকাটা করি, তিনিই আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আমার পাশে বসে থেকে মাথায় হাত রেখেছিলেন। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিলো।  তোমার ডিভাইস বড়জোড় একটা যান্ত্রিক ইমেইল পাঠাবে, কিন্তু আমার পাশে বসে থেকে চোখের অশ্রুতো মুছে দেবে না। চোখের অশ্রু মুছে দেয়ার মতো কোনো ডিভাইস কি তৈরি হয়েছে?
সকালে হাঁটতে গিয়ে তোমার মা পড়ে গিয়েছিলেন। কে তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলো? অনলাইন মানুষের একাউন্ট চেনে,  সে তো মানুষ  চেনে না! মানুষের ঠিকানা চেনে,  রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের ঘরতো চেনে না!
এই যে মানুষ আমার শয্যাপাশে ছিলো, তোমার মাকে ঘরে পৌঁছে দিলো, কারণ  দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে একজন আরেকজনকে চিনেছি। 
সবকিছু অনলাইন হয়ে গেলে  মানুষ "হিউম্যান টাচটা"  কোথায় পাবে বলো?  আর পায় না বলেই  পাশের ঘরে মানুষ মরে গিয়ে লাশ হয়ে থাকে,  দূর্গন্ধ না আসা পর্যন্ত কেউ কারো খবরও আর রাখেনা।  বড় বড় এ্যাপার্টম্যান্টগুলো আমাদের এ্যাপার্টই করে দিয়েছে।  পুরো পাড়ায় একটা টেলিভিশনে কোনো অনুষ্ঠান একসাথে দেখে সবার আনন্দ,  আমরা একসাথে জড়ো করতাম। এখন আমরা রুমে রুমে নানা ডিভাইস জড়ো করেছি।  আনন্দ আর জড়ো করতে পারিনা।  
এই যে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার দেখছো। তুমি ওনাকে ক্যাশিয়ার হিসাবেই দেখছো।  সেলস ম্যানকে সেলসম্যান হিসাবেই দেখছো।  কিন্তু আমি সুখ দুঃখের অনুভূতির একজন মানুষকেই দেখছি।  তার চোখ দেখছি।  মুখের ভাষা দেখছি। হৃদয়ের কান্না দেখছি। ঘরে ফেরার  আকুতি দেখছি । এই যে মানুষ মানুষকে দেখা, এটা  একটা বন্ধন তৈরি করে। অনলাইন শুধু সার্ভিস দিতে পারে, এই বন্ধন দিতে পারে না। পণ্য দিতে পারে, পূণ্য দিতে পারে না।  এই যে মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা,  কুশলাদি জিগ্যেস করা।  এখানে শুধু পণ্যের সম্পর্ক নেই, পূণ্যের সম্পর্কও আছে।
বাবা, তাহলে টেকনোলজি কি খারাপ?
বাবা বললেন: টেকনোলজি খারাপ না।  অনেক কিছু সহজ করেছে নিঃসন্দেহে সত্য।  ভিডিও কলের মাধ্যমে লাখে লাখে ছেলেমেয়েরা পড়ছে, শিখছে, এটা তো টেকনোলজিরই উপহার।  তবে,  টেকনোলজির নেশাটাই খারাপ। স্ক্রিন এ্যাডিকশান ড্রাগ এ্যাডিকশানের চেয়ে কোনো অংশে কম না। দেখতে হবে, ডিভাইস যেন  আমাদের মানবিক সত্ত্বার মৃত্যু না ঘটায়। আমরা যেন টেকনোলজির দাসে পরিণত না হই।  মানুষ ডিভাইস ব্যবহার করবে।  মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করবে। কিন্ত ভয়ঙ্কর সত্য হলো, এখন আমরা মানুষকে ব্যবহার করি, আর ডিভাইসের সাথে সম্পর্ক তৈরি করি।  মানুষ ঘুম থেকে ওঠে আপন সন্তানের মুখ দেখার আগে স্ক্রিন দেখে,  সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইন্সটিউট এটাকে ভয়ঙ্কর মানসিক অসুখ বলে ঘোষনা করেছে। 
কিছুদিন আগে আশা ভোঁসলে একটা ছবি পোস্ট করে ক্যাপশান লিখেছেন-  "আমার চারপাশে মানুষ বসে আছে। কিন্তু কথা বলার মানুষ নেই। কারণ সবার হাতে ডিভাইস।" 
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন : জানিনা ভুল বলছি কিনা, তবে আমার মনে হয়, তোমরা পণ্যের  লোগো যতো চেনো, স্বজনের চেহারা তত চেনো না।  তাই, যত পারো মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করো, ডিভাইসের সাথে না। টেকনোলজি জীবন না। স্পেন্ড টাইম উইথ পিপল, নট উইথ ভিডাইস।বাবাকে 'চাচা' বলে কে একজন ডাক দিলো । বাবা কাউন্টারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।  এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। বাবা ক্যাশিয়ারের দিকে যাচ্ছেন না। একজন মানুষ মানুষের কাছেই যাচ্ছেন। বাবাকে আমি অনলাইন শেখাতে চেয়েছিলাম,  বাবা আমাকে লাইফলাইন শিখিয়ে দিয়ে গেলেন।
সংগৃহীত