« on: October 21, 2021, 01:36:59 PM »
চোরাবালি
জীবন সুখদুঃখের পালাবদলের গল্প। জীবনে কখনো কখনো আমাদের যেতে হয় কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।কোন না কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের সবার পরীক্ষা পার হয়ে যাবার পর হিসেবে মিলাতে গেলে দেখা এসব সময়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার হক্বগুলো আমরা আদায় করিনি। নাফরমানী করেছি। তখন আমাদের অনুশোচনা হয়। সত্যিকারের তাওবাহ এবং নেক আমলের জন্য বান্দাকে উদবুদ্ধ করার জন্য এই অনুশোচনার অনুভূতি থাকা জরুরী।
তবে অনুশোচনার এ অনুভুতি হতে হবে সাময়িক। যাতে আমরা ভুলগুলো শুধরে নিতে পারি। অনুশোচনার অনুভূতির পাশাপাশি অন্তরে এ আশাও থাকতে হবে যে আল্লাহ্ আমাদের তাওবাহ কবুল করে নেবেন, আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেবেন এবং আমাদের পরিবর্তনের জন্য সুযোগ দেবেন। আমরা আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখবো।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর ব্যাপার সুধারণা রাখা এবং আশাবাদী হবার বদলে অনেকে আটকা পড়ে যায় অনুশোচনা আর হতাশার এক চক্রে। বারবার ঘুরেফিরে রোমন্থন করে নিজের ভুলগুলো, দোষারোপ করে নিজেকে, ঘৃণা করে। অন্তর হয়ে পড়ে যন্ত্রনাগ্রস্থ, অসুস্থ, কলুষিত।
এক সময় সে বিশ্বাস করতে শুরু করে এই পরীক্ষা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নির্মম শাস্তি। এর উদ্দেশ্য হল তাকে ধ্বংস করে দেয়া। সে মনে করতে শুরু করে যে আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল তাকে ঘৃণা করেন এবং তার ওপর রাগ হয়ে এ শাস্তি চাপিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু সে আগে অনেকবার সুযোগ পেয়ে, তাওবাহ করে আবার গুনাহে ফেরত গেছে, তাই আল্লাহ্ তাকে আর কোন সুযোগ দেবেন না।
তারপর, ধীরে ধীরে তার অন্তরে শেকড় গাড়ে আল্লাহর প্রতি বিদ্বেষের অনুভূতি। সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তার জন্য তাওবাহর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তার দুআর কোন উত্তর আর আসবে না। দুনিয়াতে যতোদিন আছে, এ হতভাগ্য, অভিশপ্ত অবস্থাতেই তাকে থাকতে হবে।
সাবধান! এটা শয়তানের চক্রান্ত। এটা তার সবচেয়ে ভয়ংকর চক্রান্তগুলোর একটি। সে প্রথমে মানুষকে বিশ্বাস করায় যে ক্রমাগত নিজেকে দোষারোপ করে যাওয়াই হল সংশোধনের উপায়। কিন্তু এর মাধ্যমে সে আসলে মানুষকে আটকে ফেলে হতাশা, অনুশোচনা আর আত্মঘৃণার চক্রে। সে মানুষকে দিয়ে সীমালঙ্ঘন করায় যা তাকে নিয়ে যায় বিপদজনক এক পথে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আল্লাহর ফায়সালা নিষ্ঠুর। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার অন্তরে তৈরি হয় প্রচন্ড ভয় আর হতাশা।
যখন কোন দরজা, কোন রাস্তা খোলা থাকে না, যখন যাবার কোন জায়গা থাকে না, তখনো আল্লাহ্ থাকেন। তাঁর দরজা সবসময় তার বান্দাদের জন্য খোলা। প্রশান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া যায় তাঁরই কাছে। তিনিই আশ্রয়হীনের আশ্রয়, দুর্বলের সহায়। যতোক্ষন আল্লাহর ব্যাপারে বান্দা এই বিশ্বাস রাখে, এই আশা রাখে ততোক্ষন সে তাওবাহর কথা চিন্তা করে।
কিন্তু শয়তান আল্লাহর রাহমাহর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে হতাশা। সে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তাকে বোঝায় যে এ পরীক্ষা হল আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি। তাঁর ক্রোধ ও ঘৃণার ফল। শয়তান মানুষকে বোঝায় যে আল্লাহর রাহমাহর দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। অনুভূতিটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন দয়া করে। যদি আল্লাহর রাহমাহর দরজা আপনার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আপনি কোথায় যাবেন? কোথায় পালাবেন? কার কাছে যাবেন? কার কাছে আশ্রয় চাইবেন? কার কাছে সাহায্য চাইবেন?
নিঃসন্দেহে এক প্রচন্ড ভয় তখন গ্রাস করবে আপনাকে। আর শয়তান সেটাই চায়। সে নিজে ঠিক এ অবস্থাটাতেই আছে। আল্লাহর রাহমাহ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অন্য কেউ আল্লাহর রাহমাহ পাক, সেটা সে সহ্য করে পারে না। তাই সে আপনাকেও নামিয়ে আনতে চায় তার কাতারে। কিন্তু শয়তানের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না।তার চক্রান্তে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।
মনে রাখবেন, শয়তান কিন্তু প্রথমেই আল্লাহর রাহমাহর ব্যাপারে আপনার মনে সন্দেহ তৈরি করবে না। সে বলবে না যে- আল্লাহ্ তো করুণাময় নন, ক্ষমাশীল নন। সে জানে, এভাবে বলে লাভ নেই। এভাবে আগালে সে নিশ্চিত ব্যর্থ হবে। সে আক্রমণ করবে অন্যদিক থেকে।
সে বলবে – 'হ্যা আল্লাহ্ পরম করুণাময়, ক্ষমাশীল। কিন্তু তুমি তাঁর করুণার উপযুক্ত না। তিনি বার বার তোমাকে সুযোগ দিয়েছেন কিন্তু বারবার তুমি নাফরমানী করেছো। আল্লাহ্ গাফুরুর রাহীম, কিন্তু তোমার এই ব্যর্থতা, তোমার এই পাপ এতোই জঘন্য যে তুমি আর তাঁর ক্ষমার যোগ্য না।'
এসব বলে শয়তান আসলে কী চায়? সে চায় আপনি হতাশার চোরাবালিতে আটকা পড়ুন। এমন হতাশা যা আপনাকে পঙ্গু করে দেবে। কেড়ে নেবে নিজেকে সংশোধন করে রবের অভিমুখী হবার সব ইচ্ছে,সব শক্তি।
জানেন ডিপ্রেশনের (বিষণ্ণতা) ডাক্তারি সংজ্ঞা কী? এর উপসর্গগুলো কী?
গভীর বিষাদ, নিজেকে মূল্যহীনভাবা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, উৎসাহহীনতা, অপরাধবোধ, হতাশা, নেতিবাচক মনোভাব এবং নিজের কোন ভবিষ্যৎ নেই ভাবা।
অর্থাৎ ডিপ্রেশন এমন এক অপরাধবোধ তৈরি করে যা মানুষকে সংশোধনের দিকে চালিত করে না। বরং তাকে নিয়ে যায় আত্মঘৃণা, হতাশা আর নেতিবাচকতার চোরাবালিতে।
শয়তান মানুষকে অপরাধবোধের ধাপে আটকে ফেলে। সে মানুষকে বোঝায় যে তার অবস্থা সংশোধনের অযোগ্য। সে অন্তর আর ইচ্ছাশক্তিকে পঙ্গু করে ফেলে। যাতে করে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য করার শক্তি না পায়, নিজেকে সংশোধনের চেষ্টাই না করে এবং আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কে নষ্ট হয়ে যায়।
শয়তান মানুষের মনে আল্লাহর ব্যাপারে ভুল ধারণা তৈরি করে-
মালিক সবসময় তাঁর বান্দার গুনাহর অপেক্ষায় থাকে। বান্দা গুনাহ করা মাত্র তার ওপর শাস্তি চাপিয়ে দেন। আর বন্ধ করে দেন সংশোধনের সব পথ। ছিন্ন করে ফেলেন তার সাথে সব সম্পর্ক।'
শয়তান চায় রাব্বুল আলামীন এর ব্যাপারে আমরা এমন ধারণা করি।
আমাদের রব কী এমন?
না! কক্ষনো না। তিনি মহামান্বিত এবং এ মিথ্যাচার থেকে পবিত্র।
আমার আল্লাহ্র রাহমাহ, তাঁর ক্ষমাশীলতা এতোই ব্যাপক যে এর ব্যাপ্তি বুঝে ওঠাও আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আর-রাহমানের দরজা সবসময় তাঁর বান্দাদের জন খোলা।
মনে রাখবেন, শাস্তি পাবার পরও সন্তান তার পিতাকে ভালোবাসবে যদি সে জানে যে পিতা তাকে ভালোবাসে। সে মনে করবে বাবা শাস্তি দিয়েছেন ভালোর জন্যই। সন্তান যখন কোন ভুল করে, বাবা তার কান টেনে ধরেন। আর সন্তান যখন টলটলো চোখে মাটির দিকে তাকায় বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু সন্তান যদি মনে করে বাবা তাকে ঘৃণা করে তাহলে তার মন বিষিয়ে যাবে। আর মহান আল্লাহর রাহমাহ, তাঁর পবিত্র বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং বান্দার প্রতি তাঁর ভালোবাসার সাথে তো সৃষ্টির কোন তুলনাই হয় না।
কাজেই শয়তান যখন আপনাকে কুমন্ত্রনা দেবে, ‘তুমি আল্লাহর রাহমাহর যোগ্য না’,
তখন বলুন – হ্যা আমি আল্লাহর রাহমাহর উপযুক্ত না। কিন্তু তবুও তিনি আমার মতো বান্দাদের ওপর রহমত করবেন, আমাদের ক্ষমা করবেন। কারণ তিনি তাঁর বান্দাদের তাদের প্রাপ্য অনুযায়ী তাদের বিচার করেন না। তিনি আরো অনেক, অনেক বেশি উদার। তিনি বান্দাদের বিচার করেন তাঁর রাহমাহ অনুযায়ী।
যদি শয়তান বলে, ‘আল্লাহ্ তোমাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন কারণ তিনি তোমাকে ঘৃণা করেন’, তখন বলুন,
‘না, বরং পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি আমাকে বিশুদ্ধ করছেন’
যদি শয়তান বলে, তোমার মতো জঘন্য বান্দা কিভাবে আল্লাহর রাহমাহ পাবে?
তখন বলুন – আমার রবের রাহমাহ বিস্তৃত, আমার মতো বান্দাকে বঞ্চিত করার মতো সংকীর্ণ তা নয়।
কখনো শয়তানের এসব কুমন্ত্রনাকে অন্তরে শেকড় গাড়ার সুযোগ দেবেন না। কখনো মনে করবেন না কষ্ট, পরীক্ষা এগুলো শুধুই শাস্তি। আল্লাহর রাহমাহর ব্যাপারে হতাশ হবেন না। শয়তানকে সুযোগ দেবেন না আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট করার।
আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হবেন না। হতাশ হবেন না। আমাদের রব আর-রাহমান, আর-রাহীম, আল-গাফফার। যখন সবাই আমাদের ছেড়ে যায় তখনো তিনি থাকেন। মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে কবরের একাকীত্বে, সব অবস্থায় তিনি আমাদের কাছে। যখন সব তাঁর দরজা বন্ধ, তখনো তাঁর দরজা খোলা। তিনিই আশ্রয়হীনের আশ্রয়, দুর্বলের সহায়। প্রশান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া যায় তাঁরই কাছে। তিনি আল্লাহ্, তিনিই আমাদের রব।
Logged
Hafez Maulana Mufti. Mohammad Ashraful Islam
Ethics Education Teacher, DISS
Khatib, Central Mosque, Daffodil Smart City
Ashuli , Savar, Dhaka