জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহের এ বছরের (১৭-২৩ মে) প্রতিপাদ্য ‘জীবনের জন্য সড়ক’। এটি সামনে রেখে বড় বড় শহর এবং পথচারীবহুল এলাকাগুলোয় যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। পথচারীবহুল বলতে মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার ও আবাসিক এলাকাসংলগ্ন সড়ককে বোঝানো হয়েছে। ৮০টির বেশি বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে যানজট ও বায়ুদূষণও কমে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন উচ্চ আয়ের দেশের পাশাপাশি আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার তুলনামূলক কম আয়ের অনেক দেশ যানবাহনের গতিসীমা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
বাণিজ্যকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সড়ক ও যানবাহন উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণত দ্রুতগতির প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয়। সাধারণত ব্যয়বহুল এসব প্রযুক্তি সড়ক যোগাযোগ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি সড়কে জীবনহানি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিও বাড়ে; পরিণতিতে যা দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের ওপর এবং দীর্ঘ মেয়াদে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এসব ঘটনায় প্রাণহানিকে কেন্দ্র করে একাধিক আন্দোলন হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন আগের সব আন্দোলনকে ছাড়িয়ে যায়। সে বছরের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিম এয়ারপোর্ট রোডে একটি বেপরোয়া গতির বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারায়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ। সড়কের অব্যবস্থাপনা নিরসনের দাবিতে অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
২০২০ সালে সুইডেনে সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক বৈঠকে জাতিসংঘ গৃহীত স্টকহোম ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের সড়কগুলোয় প্রতিবছর হাজার হাজার প্রাণহানি রোধে নিয়ামক ভূমিকা রাখতে পারে। ঘোষণাটিতে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে পথচারীবহুল এলাকাগুলোয় সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিলোমিটারে সীমিত রাখার আহ্বান বিশেষভাবে উল্লেখ্য। যেসব গবেষণা ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পাওয়া ফলাফল জাতিসংঘের এই আহ্বানের ভিত্তি, তার একটি সারাংশ নিচে দেওয়া হলো।
স্বল্প গতি জীবন বাঁচায়, কিন্তু মোট সময় বাড়ায় না
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিসীমায় তানজানিয়াতে ২৫ শতাংশ, কানাডার টরন্টোতে ২৮ শতাংশ, কলম্বিয়ার বোগোটায় ৩২ শতাংশ, ইংল্যান্ডের লন্ডনে ৪২ শতাংশ এবং ব্রিস্টলে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানবাহনের গতিসীমা ১ কিলোমিটার বাড়লে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দাও স্বল্প গতির পক্ষে। পরিমিত গতি যানজট কমাতে সহায়ক। ১১টি দেশে ইংল্যান্ডভিত্তিক চাইল্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ সংস্থার পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ মানুষ যানবাহনের গতি সীমিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী সড়কের ধরন, যান চলাচল এবং এলাকার ধরনের ওপর ভিত্তি করে কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনটির আওতায় বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবহন বিধিমালা প্রণয়ন পর্যায়ে রয়েছে। বিধিমালায় বিভিন্ন সড়কে বিভিন্ন গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে স্টকহোম ঘোষণা, বিশেষ করে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। ঢাকা মহানগরের মেয়রদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
সাধারণভাবে মনে করা হয়, কম গতি চলাচলের মোট সময় বাড়িয়ে দেয়। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, যান চলাচলে মোট কত সময় লাগবে, তা নির্ভর করে মূলত ট্রাফিক সিগন্যাল, যানজট ও মোড়গুলোয় কতক্ষণ সময় লাগছে, তার ওপর। তুলনামূলক কম গতিতে যান চলাচলের ভূমিকা এখানে নেই বললেই চলে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরে চলাচলের ক্ষেত্রে ৩০ কিলোমিটার ও ৫০ কিলোমিটার—এই দুই গতিসীমায় চলাচল করেও কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে কিন্তু প্রায় একই সময় লাগছে।
দূষণ কমায় ৩০ কিলোমিটার গতিসীমা
মোটরযানের গতি এবং তা থেকে নির্গত ধোঁয়া থেকে দূষণের সম্পর্ক বেশ জটিল। এটি নির্ভর করে যানের ধরন, তাপমাত্রা, রাস্তার নকশা ও বিন্যাস এবং নির্মাণ-বৈশিষ্ট্যের ওপর। বারবার ওঠানামা না করে গাড়ি একই গতিতে চললে কম দূষণ হয়। লন্ডনে ২০ কিলোমিটার গতিসীমা এলাকা এবং বেলজিয়ামে ৩০ কিলোমিটার গতিসীমা এলাকায় পরিচালিত সমীক্ষায় এ ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায়নি।
স্বল্পগতির স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উপকারিতার দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। স্বল্প গতিসীমার রাস্তায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম বলে গাড়িতে না চেপে মানুষ সাইকেল এবং হেঁটে চলাচল করতে উৎসাহী হয়। এতে কার্বন নিঃসরণ কমে, নিশ্চিত হয় সুস্বাস্থ্য।
২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী ঢাকা শহরে মোটরযান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার, এক দশক আগেও যা ছিল ২১ কিলোমিটার। ২০১৬ সালে ব্র্যাক ও কোপেনহেগেন কনসেনশাস সেন্টারের সহায়তায় পরিবহন বিশেষজ্ঞ রবার্ট গেলাহার ঢাকা শহরে একটি সমীক্ষা চালান। এতে দেখা যায়, মেট্রোরেলসহ বাংলাদেশ সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা মহানগরে যানবাহনের গড় গতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার হবে। কিন্তু মহানগরের যেখানে যানজট কম বা নেই, চালকদের মধ্যে সেখানে গতি বাড়ানোর মারাত্মক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অন্যান্য নগর বা মহাসড়কেও একই প্রবণতা বিদ্যমান। কাছেই স্কুল, হাসপাতাল বা ধর্মীয় স্থান আছে—এমন সতর্কতামূলক সাইনপোস্ট থাকলেও তা উপেক্ষা করে উচ্চগতিতে গাড়ি চালান তাঁরা।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী সড়কের ধরন, যান চলাচল এবং এলাকার ধরনের ওপর ভিত্তি করে কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনটির আওতায় বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবহন বিধিমালা প্রণয়ন পর্যায়ে রয়েছে। বিধিমালায় বিভিন্ন সড়কে বিভিন্ন গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে স্টকহোম ঘোষণা, বিশেষ করে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। ঢাকা মহানগরের মেয়রদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ কিলোমিটারের নিয়মটি তাঁরা রাজধানীর জন্য প্রয়োগ করতে পারেন। করা হলে বড় মাপের প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সেটি অবহিত করতে হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশকেও সক্রিয় হতে হবে। নিয়মটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা গেলে এ শহরে জীবনহানি, অঙ্গহানি এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পাবে বলে আমরা আশা রাখি।● আহমেদ নাজমুল হোসাইন ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক
Source:
https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9A-%E0%A6%97%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%95-%E0%A7%A9%E0%A7%A6-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0