কেইস স্টাডি ১
নামঃ মোঃ আহাদ
বয়সঃ ১১
স্থানঃ গ্রাম উবাহাটা, উপজেলাঃ চুনারঘাট, জেলাঃ হবিগঞ্জ, সিলেট
পিতাঃ মোঃ আনোয়ার মিয়া (মৃত)
মাতার নামঃ মোছাঃ রুকিয়া বেগম (মৃত)
আহাদরা এক ভাই , দুইবোন। পড়াশোনা করতে মন চায়?? জিজ্ঞাসা করতেই সরল উত্তর, “মনে তো চায়ই স্যার কিন্তু, টাকার অভাবে পড়তে পারি না”। পরিবার বলতে আহাদের দুই বোন, এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে সে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ভাইয়ের দায়িত্ব নেবার মত অবস্থা তার নেই। স্বামী গার্মেন্টস এ স্বল্প বেতন এ চাকরি করে। পুরো পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই সুমন মিয়ার খুব কষ্ট হয় তাই নিজের সংসারে স্ত্রীর ছোট ভাই এর জায়গা হয়না।
কথা বলে জানা গেল বাবা মা মারা যাবার পর পরিবারটিতে অভিভাবক বলে আর কেউ নেই। আহাদের আরেকটি ছোট বোন আছে। সে সারাদিন গার্মেন্টস এ কাজ করে যা পায় তাতে কোন মতে দুইবেলার খাবার যোগার করা যায়। খুপড়ি মতন ছোট ঘরটির ভাড়া দিতেই যেখানে হিমসিম খেতে হয়, সেখানে ভাইয়ের লেখাপড়া, একটু ভালো খাওয়া পরা তাদের কাছে ভীষণ রকম বিলাসিতা যা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাই ভাইকে পড়াশোনা করানোর মত অর্থের সংকুলান হয়ে উঠে না কিছুতেই। পড়া লেখা চালিয়ে নিতে হলে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হবে।
বাবা মারা গেছে প্রায় ৪ বছর আগে। আর ৯ মাস পরেই তাদের মা ও মারা গিয়েছে। বাবার শ্বাসকষ্ট ছিল। মায়ের লিভারের সমস্যার কারনে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। ভাইবোন গুলি এতিম হয়ে যায়। বড় বোন জেসমিন গার্মেন্টস এর সহকর্মী সুমন মিয়াকে বিয়ে করে নিজের মত থাকে। ভাইয়ের খবর নেবার যথেষ্ঠ ইচ্ছ থাকলেও সম্ভব নয়।
আর এ কারণেই দোকানদার সেলিম ভাইয়ের কাছ থেকে যখন ই ডিআইএসএস এর কথা শুনেছেন, আর এক মুহুর্ত দেরী করেননি। সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চাইলে, ভাইটা যদি এখানে ভর্তির সুযোগ পায়, তাহলে হয়তো ভাই এর একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ এর জন্য আর ভাবতে হবে না।
ছেলেটার সাথেও কথা বলছিলাম, নির্লিপ্ত চেহারা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কখনো একা লাগলে পালিয়ে যাবে? সহজ ভাবেই উত্তর দিয়েছে, যাবে না। এই শিশুগুলো যেহেতু পারিবারিক পরিবেশ এবং বাবা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত, তাই আমরা বিশ্বাস করি, ভাল পরিবেশ এবং স্নেহ পেলে এরা জীবনে বড় হবেই। এরা যেহেতু কষ্ট বঞ্চনাকে জীবনে খুব কাছে থেকে দেখেছে, তাই জীবনে মানুষ হবার সুযোগ পেলে তারা চেষ্ঠার কোন ত্রুটি করবে না।
লিখছিলাম, সিলেটের হবিগঞ্জ এর এক অসহায় শিশুর গল্প যে এই বয়সে বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছে। অভাবের তারনায় কিছুদিন একটা চায়ের দোকানেও কাজ করেছে সে। অথচ এই বয়সে শিশুরা বাবা-মার আদর পেয়ে বেড়ে উঠে কিংবা স্কুলে যায় পড়ালেখা করার জন্য। এই শহরে কারো জন্য কারো একটু সমবেদনা নেই। কেউ ভুল করেও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেনা, সহমর্মিতার হাত ও কেউ বাড়ায় না। এখানে আছে শুধু কঠিন বাস্তবতা আর টিকে থাকার লড়াই। প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
আহাদের এর জীবনে কোন আনন্দের ঈদ আসেনি। তাদের জানাই নেই ঈদের আনন্দ কি জিনিস । কখনো একটুকরো কাপড়ের ব্যবস্থা হলে হয়নি খাওয়া । আবার কখনো দু 'বেলা ভাতের ব্যবস্থা হলে জোটেনি ভাল একটু কাপড়। তাদের মনে অনেক কষ্ট। পাহাড়সম বললেও ভুল হবেনা। ছোট বোনের বিয়ের বয়স যাচ্ছে। কিন্তু অর্থের অভাবে তাও হচ্ছে না। মানুষ পরিবার খোঁজে, অবস্থা দেখে। তাদের তো সহায় সম্বল বলেই কিছু নেই। যা সামান্য ছিল, সেটা বাবা মায়ের চিকিতসাতেই শেষ। তবুও বাবা মা কেউ রইলেন না এই দুনিয়াতে।
অন্যান্য শিশুদের মতো আহাদেরও ভাল লাগে ক্রিকেট খেলা দেখতে। তার প্রিয় খেলোয়ার নাকি সাকিব আল হাসান। সর্বশেষ আহাদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “ধর যদি সেই রকম সুযোগ তোমাকে দেওয়া হয় যে তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য সব রকম সুবিধা পাবে। শুধু এগিয়ে যাও। তুমি কি করবে?? উত্তরে বলেছিল, করব আমি অবশ্যই সব নিয়ম মানব, যা করতে হয় করবো”
স্বপ্ন ছাড়াও অসংখ্য মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকে কেবল শুধুই বেঁচে থাকার জন্য। যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ সিলেটের হবিগঞ্জের আহাদ।