মাহে রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় পর্ব)

Author Topic: মাহে রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় পর্ব)  (Read 746 times)

Offline ashraful.diss

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 162
  • 'শীঘ্রই রব তোমাকে এত দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে'
    • View Profile
    • Daffodil Institute of Social Sciences - DISS

মাহে রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় পর্ব)

সিয়াম জান্নাতের পথ:

ইমাম নাসাঈ রহ. আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে এমন বিষয়ের নির্দেশ দেন যার মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে প্রতিদান দেবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি অসাল্লাম বলেন:

{ عليك بالصيام فإنه لا مثل له }.

তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর কোন তুলনা নেই।

জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। সেখান দিয়ে শুধু সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সাহল ইবনে সাআদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

{ إن في الجنة باباً يقال له: الريّان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة، لا يدخل منه أحد غيرهم، يقال: أين الصائمون، فيقومون، لا يدخل منه أحد غيرهم، فإذا دخلوا أغلق، فلم يدخل منه أحد } [أخرجه البخاري ومسلم].

জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামত দিবসে সেখান দিয়ে সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সে দরজা দিয়ে অন্য কেহ প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সিয়াম পলনকারী কোথায়? তারা দাঁড়াবে, তারা ছাড়া আর কেহ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেহ সে স্থান দিয়ে প্রবেশ করবে না। -বুখারী মুসলিম, ১৮৯৬

সিয়াম পালনকারীর জন্য সিয়াম সুপারিশ করবে:

ইমাম আহমদ রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন:

{ الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام: أي رب منعته الطعام والشهوات بالنهار فشفّعني فيه، ويقول القرآن: منعته النوم بالليل فشفّعني فيه، قال: فيشفعان }.

সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য কিয়ামত দিবসে সুপারিশকারী হবে, সিয়াম বলবে, হে প্রভু আমি তাকে দিনের বেলায় খাওয়া এবং প্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিবৃত্ত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তাআলা বলবেন: তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হল।

সিয়াম গুনাহের ক্ষমা এবং কাফফারা হিসাবে গৃহিত হয়:


কেননা ভাল কাজ অন্যায়কে মুছে দেয়। আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহ তাআ'লা আনহু রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

{ من صام رمضان إيماناً واحتساباً غفر له ما تقدم من ذنبه } [رواه البخاري ومسلم].

যে রমজানে ঈমান এবং এহতেসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেবেন। -বুখারী মুসলিম

সিয়াম ইহকাল এবং পরকালের সৌভাগ্যের কারণঃ

আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহ তাআ'লা আনহু রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

{للصائم فرحتان: فرحة حين يفطر، وفرحة حين يلقى ربه، ولخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك } [رواه البخاري ومسلم].

সিয়াম পালনকারীর দুটি খুশি, প্রথম খুশি যখন সে ইফতার করে, আর এক খুশি যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশক আম্বরের চেয়ে অধিক প্রিয়। -বুখারী মুসলিম

রমজানে সুযোগ কাজে লাগানো:

এ বছর রমজান মাস কি আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসার মৌসুম হবে, এবং নিজের হিসাব নিকাশের সুযোগ করে দেবে, আর আল্লাহর সামনে নিজের গোনাহের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ করে দেবে?

সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য সত্যিকারভাবে ইসলামী জীবন যাপন করার সুযোগ এনে দেবে কি এ মহান মাস?

দ্বীনের পথে দাওয়াতদানকারীগণ এ মাসকে তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। এ কথা চিন্তা করে যে, তারা সর্বোত্তম দাওয়াতের দায়িত্বপালনকারী এবং তারা অতি উত্তম উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন। তারা নিজের সত্তার চিন্তা এবং তার জন্য ঘোরাফেরা করা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু আল্লাহ তাআ'লার নিকট যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী মনে করে কাজ করবেন।

এ মাসটিকে প্রত্যেক মুসলমান তার মুসলমান ভাইকে সাহায্য করার মাস হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। হোক না সে অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত। অত্যাচারীকে তার অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করে, উৎসাহিত করে সর্বোপরি প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাহায্য করবে। আর অত্যাচারিতকে সাহায্য করবে সাহায্য, সহযোগিতা এবং দয়ার হাত তার প্রতি সম্প্রসারিত করে দেয়ার মাধ্যমে। ফলে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নির্দেশিত এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের স্বার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র তৈরি হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ জুলূম অত্যাচারবিহীন ভ্রাতৃত্বের কাঙ্খিত পরিবেশ।

ধনী দরিদ্র সকলের জন্যই রমজান উপকারলাভের মাধ্যমঃ


এ মাস ধনী এবং আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনকারীদের জন্যও সাওয়াব অর্জনের মহাবরকতময় সুযোগ। তাদের অনুভূতিকে সজাগ করে তুলতে রমজানের বাস্তব প্রায়োগিক শিক্ষার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তারা দরিদ্রদের প্রয়োজন ও ব্যাথা মরমে অনুভব করতে পারেন। পারেন নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও। আল্লাহ তাআ'লা যে পথে ব্যয় করতে সম্পদ দান করেছেন সে পথে তারা সম্পদ ব্যয় করার প্রকৃত প্রেরণালাভ করতে পারেন। উম্মাহর ক্ষুধার্তদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারেন তারা। তারা যদি তাদের ক্ষুধার্তদেরকে না খাওয়ায়, বস্ত্রহীনদেরকে বস্ত্র না দেয় আর দুর্বলদেরকে সাহায্য না করে- তাহলে মনে করতে হবে, তাদের ঈমান বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। হাদিসের মর্মানুযায়ী, ঈমানের প্রকৃত পরিপূর্ণতা তো নিজের জন্য যা কল্যানকর বা পছন্দনীয় মনে করা হয়, অপরের জন্যও তাকে কল্যানকর বা পছন্দনীয় ভাবার শিক্ষার মধ্যে। সেই মহান শিক্ষা রমজানের বাস্তব প্রয়োগের ভেতরেই নিহিত রয়েছে।

রমজান আমাদের নিজেদের জন্য এমন একটি পদ্ধতি অবলম্বনের সুযোগ এনে দেয় যার মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি। রোজার প্রকৃত শিক্ষা শুধু সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপোস থাকা নয়; বরং, রোজাদারের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গও রোজার বাস্তবিকতায় ধন্য হবে। রোজাদারের হাত, পা, চোখ, কান, জিহবাসহ প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরও রোজা রয়েছে। যখনই এ সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ নড়া-চড়া করবে, ব্যবহার করবে- রোযাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তিনি একজন রোযাদার। মহান সৃস্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশায় নিষিক্ত থাকবে রোযাদারের প্রতিটি আমল। মহান মালিকের ইচ্ছানুযায়ী তিনি ব্যবহার করবেন তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন:

{ وما يزال عبدي يتقرّب إليّ بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها } [رواه البخاري].

আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, আমি তাকে ভালবাসি। যখন আমি তাকে ভালবাসি সে আমার কান হয়ে যায়, যা দিয়ে সে শোনে। আমার চক্ষু হয়ে যায়, যা দিয়ে সে দেখে। হাত হয়ে যায়, যা দিয়ে সে ধরে। পা হয়ে যায়, যা দিয় সে চলে। -বুখারী

এই হাদিস যদিও নফল আমলের ফজিলত বিষয়ক, কিন্তু এসব নফল আমল শেখার উত্তম শিক্ষালয়ও রমজান। ইবাদাতের বসন্ত খ্যাত সেই মাহে রমজানের পাঠশালায় এ সমস্ত কিছুই অর্জন করা সম্ভব, যে রমজান আমাদেরকে দৃঢ়তা অবলম্বন ও সত্য গ্রহণের শিক্ষা দেয়। যার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তির সমস্ত দেয়াল ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। খারাবির সমস্ত ইচ্ছের জলাঞ্জলির মাধ্যমে কল্যানের ফল্গুধারা বইতে থাকে মনে ও মননে।

রোযাদার ঝগড়া করবে নাঃ


সে দৃঢ়তা এবং সুক্ষ্ম নিয়ম কি? যার মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীর মুমিনদেরকে দেখা যায় যে, তারা নির্দিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত হচ্ছেন, আবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে পানাহার করছেন। অত:পর নিজের নফসকে কুপ্রবৃত্তির মধ্যে পতিত হওয়া অথবা পথভ্রষ্টতার বাতাসে ভেসে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারছেন। রোযাদার ব্যক্তি তো তিনিই, যিনি কুপ্রবৃত্তি এবং কামনার উদ্রেককারী প্রত্যেক বিষয়কে 'না' বলে দিবেন। আর তার এই 'না' বলা হতে হবে আল্লাহ তাআ'লার সন্তুষ্টি অনুযায়ী, তাঁর সন্তোষলাভের উদ্দেশ্যে। রোযাদার অশ্লীল কাজ করবেন না। ঝগড়া করবেন না। এমনকি, উচু স্বরে কথাও বলবেন না। কোন মূর্খ যদি তার অনুভূতিকে আহত করে ও তার ভেতরের খারাপ জিনিসকে জাগিয়ে তোলে, প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে তবুও তিনি বলবেন, 'আমি সিয়াম পালনকারী'।

আর মানুষতো নিজের অভ্যাসের গোলাম। যতই সে চেষ্টা করে ফিরে আসতে পারে না নফসের গোলামী থেকে। কেননা, অভ্যাসের বিরাট প্রভাব রয়েছে অন্তর ও নফসের উপর। আমাদের অনেকের পানাহার, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে অনেক রকম অভ্যাস রয়েছে তার থেকে সে বিরত হতে পারে না। সিয়াম এই সমস্ত অভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিরাট উপকারী। মুসলমান ইচ্ছা করলে এর মাধ্যমে অনেক অভ্যাস থেকে নাজাত পেতে পারে কোন কষ্ট এবং ক্ষতি ছাড়াই। অত:পর যে সমস্ত অভ্যাস তার ক্ষতি করে সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। যেমন, রাত্রি জেগে অনুষ্ঠান উপভোগ করা, গোনাহ হয় এমন অনুষ্ঠানে যাওয়া, কারো সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদির অভ্যাস করা। অর্থাৎ এ জাতীয় যত ধরণের নেশা জাতীয় অভ্যাস আছে তা পরিত্যাগ করা। মূলত এ সমস্ত কিছু হয় দুর্বল মানসিকতার কারণে, অথবা এগুলোর নিকট আত্মসমর্পনের কারণে। সুস্থ, ভদ্র ও বিবেকবানরা কখনও এমন কাজ করতে পারে না। যদি সিয়াম পালন করতে চাও তবে হিংসা, গোনাহ এবং অন্যায় থেকে বিরত থেকে সিয়াম পালন কর। সিয়াম অবস্থায় জিহবাকে অহেতুক কথা থেকে, দৃষ্টিকে হারাম থেকে বিরত রাখ। অনেক সিয়াম পালনকারী আছেন তার সিয়াম উপবাস এবং পিপাসিত থাকা ছাড়া আর কোন উপকারে আসে না। সে ঐ ব্যাক্তি যে আহার বাদ দিল, কিন্তু গীবতের মাধ্যমে নিজের ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া থেকে বিরত হতে পারল না। পান করা থেকে বিরত থাকল কিন্তু মিথ্যা, ধোকা, মানুষের উপর অত্যাচার থেকে বিরত হল না।

সিয়াম পালনকারীর জন্য নসিহতঃ


প্রিয় রোযাদার ভাই বোন, রমজান আমাদের কি শেখায়? রমজানের প্রকৃত শিক্ষা এবং আদর্শ কি? আসুন, শপথ নিই। আগত রমজানে আমরা আমাদের মনকে প্রশস্ত করি, জিহবাকে খাটো করি, অন্যায় এবং ঝগড়া থেকে দুরে থাকি। যদি বিচ্যুতির পথ সামনে এসে যায়, তবে নিজেকে সামলে নিই। ভাইদের থেকে যদি কষ্ট পাই তাহলে ধৈর্য ধারণ করি। কেউ যদি আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে, তবে আমি তার মত করবো না। বরং আমি বলবো, 'আমি সিয়াম অবস্থায় আছি।'


চলবে......
Hafez Maulana Mufti. Mohammad Ashraful Islam
Ethics Education Teacher, DISS
Khatib, Central Mosque, Daffodil Smart City
Ashuli , Savar, Dhaka