Entertainment & Discussions > Story, Article & Poetry

মাদক পাচারে ইন্ধন জোগাচ্ছে রোহিঙ্গারা (যুগান্তর, ২০ নভেম্বর ২০২২; পৃষ্ঠা: ৪)

(1/1)

kekbabu:
মাদক পাচারে ইন্ধন জোগাচ্ছে রোহিঙ্গারা
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

(যুগান্তর, ২০ নভেম্বর ২০২২; পৃষ্ঠা: ৪)

মানবিক কারণে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশে। এতে করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বটে; কিন্তু এখন এসব রোহিঙ্গারাই যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশ পড়েছে চরম অস্বস্তিতে। রোহিঙ্গারা প্রায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব অপরাধের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মাদক চোরাচালান। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১১টি এলাকা দিয়ে মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে এসব রোহিঙ্গা।

আর মাদক কেনাবেচার জন্য তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে গড়ে তুলেছে প্রায় পাঁচশ আস্তানা। মাদক চোরাচালানে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। ওই দেশটির সঙ্গে বারবার বৈঠক করেও যেন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ইয়াবার মতো বাংলাদেশে আইসও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি। শুধু তা-ই নয়, আইসের পর ডিওবির মতো ভয়ংকর মাদকও শিক্ষার্থীসহ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের চৌত্রিশটি শিবিরে এখন বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শরণার্থী শিবিরে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ইয়াবার কারবার। উখিয়া ও টেকনাফের এগারোটি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের মংডুতে যাতায়াত করছে রোহিঙ্গারা।

সেখান থেকে ড্রামে ভরে নাফ নদী দিয়ে লাখ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসছে তারা। পরে তা চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরের আস্তানাগুলোতে এবং সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অনেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা ইয়াবা ব্যবসায়ী।

পুলিশ বলছে, সীমিত জনবল দিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার গতিবিধি নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। পুরোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে নতুন মাদক আইস নিয়ে আসছে দেশে। এ মাদকে যুক্ত হচ্ছে বিত্তশালীরা। শুধু বিত্তশালীরাই নয়, দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আজ মাদক নেই। মাদকের ছোবলে যেন দেশ আজ ডুবতে বসেছে।

দুঃখজনক বিষয়, সমাজে মাদক ব্যবসায়ীরা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তাদের হাত ‘লম্বা’ হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আবার মাদক নির্মূলের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও পুলিশের কিছু অসাধু কর্তাব্যক্তি মাদক গ্রহণ ও ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আবার মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার কর্তৃক মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

কিন্তু এ অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই ঘুস খেয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে সহযোগিতা করেন। এ যেন সরষের মধ্যে ভূত। অবস্থা এমন যে, দেশে মাদক নির্মূলের জন্য আলাদা বাহিনী, আলাদা বিপুল সংখ্যক পুলিশ দেওয়াসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হলেও দেশ থেকে যেন কিছুতেই মাদক বন্ধ করা যাচ্ছে না।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি লোক মাদকাসক্ত। সমাজের প্রতিটি স্থান যেন আজ মাদকের অভয়ারণ্য। মাদক গ্রহণ থেকে বাদ যান না পুলিশ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী, রিকশাচালক, দিনমজুর কেউ-ই। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে মাদক এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ কারণে সমাজে দিন দিন বেড়ে চলেছে চুরি, ছিনতাই, খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ। আর কোনো সংসারে যদি মাদকাসক্ত কোনো ব্যক্তি থাকেন, তাহলে ওই সংসারে চির অশান্তি বিরাজ করে। মাদকের সর্বনাশা ছোবলে অনেক সুখের সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। সর্বোপরি, মাদকের কারণে সমাজে ঘটছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়; যা জাতির জন্য এক অশনিসংকেত।

পঞ্চাশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র মাদক চোরাচালানের উপযুক্ত ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী থাইল্যান্ড, লাওস, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, নেপাল, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ।

ফলে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা এ দেশকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশকে টার্গেট করে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে ওঠা কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল আর ইয়াবা ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের দেশে। এ ক্ষেত্রে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হয়ে সত্যিকার অর্থেই দেশের স্বার্থে, দেশের জনগণের স্বার্থে মাদক পাচার রোধে কাজ করেন, তাহলে দেশের মধ্যে মাদক প্রবেশ করা কি সম্ভব? দেশে মাদকাসক্তদের ৭০ ভাগ হেরোইন বা এডিন সুগারে আসক্ত।

আর ৩০ ভাগ ফেনসিডিলে আসক্ত। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবা আসক্তের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। কারণ, দিন দিন ইয়াবার চাহিদা বাড়ছে ঝড়ের বেগে। শুধু ঢাকাতেই ইয়াবার দৈনিক চাহিদা ১৪ লাখ। চট্টগ্রামে ১০ লাখ আর কক্সবাজারে ৫ লাখ। বিভিন্ন তথ্যানুসারে, মাদকাসক্তদের মধ্যে আশিভাগই দেশের যুবসমাজ। এ যুব সমাজেরই আগামীতে দেশ-জাতি গঠনের কথা; দেশ বিনির্মাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অথচ আজ তারা মাদকাসক্ত হয়ে রানীক্ষেত রোগে আক্রান্ত মুরগির মতো ঝিমাচ্ছে। প্রতিদিন নেশাদ্রব্যের পেছনে জাতীয় অপচয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ২.২ শতাংশেরও বেশি। মিয়ানমারের মংডু এলাকায় ৪-৫টি ইয়াবা কারখানা শুধু বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের তিনটি সীমান্ত দিয়ে এদেশে অনবরত আসছে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদকের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাদকাসক্তরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবহারজনিত সব কর্মতৎপরতায় জড়িত লোকজন ধরা পড়ছে প্রতিনিয়ত। এদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলাও হয়; কিন্তু দুঃখজনক হলো-কিছুদিন পর এসব মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্ত আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মাদক ব্যবসা ও মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কখনো মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকাসক্তরা সমাজ, দেশ, জাতি ও পরিবারের শত্রু। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদের শক্তির উৎসগুলো শনাক্ত করার পর অবৈধ শক্তির উৎসগুলো চিরতরে বন্ধ করা আবশ্যক। দেশ থেকে মাদক নির্মূলে কঠোর থেকে কঠোরতর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

মাদক একটি অভিশাপ। মাদক মানুষের মূল্যবান জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। নীরব ঘাতকের মতো মাদকাসক্তি প্রসার লাভ করছে সমাজে। মাদকাসক্তি কর্মশক্তির বড় একটি অংশ গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজের সম্ভাবনাময় শক্তি। মাদকাসক্তদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক বিকৃতিও ঘটে। মাদকের ফলে জাতি হাঁটছে অন্ধকারের দিকে, মৃত্যুর দিকে হাঁটছে নৈতিক মূল্যবোধ এবং জন্ম নিচ্ছে ঐশীর মতো পিতা-মাতা হত্যাকারী সন্তানরা। তাই সমাজ ও জাতির স্বার্থে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। প্রয়োজন মাদক গ্রহণকারীদের সংশোধন কেন্দ্রের মাধ্যমে সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মাদক নামক মরণনেশা প্রতিরোধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যাপকহারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। মাদককে না বলুন-এ বার্তাটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করাও অতীব জরুরি। যে যুবসমাজের ওপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি-অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, তারাই যদি মাদকের কুফলজনিত কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মাদকের এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে জাতিকে বাঁচাতে সরকারসহ সবাইকে আন্তরিকভাবে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/617395/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%95-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%A8-%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE

Navigation

[0] Message Index

Go to full version