বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব: প্রকাশ্য ও গোপন জীবনের চালিকাশক্তি

Author Topic: বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব: প্রকাশ্য ও গোপন জীবনের চালিকাশক্তি  (Read 92 times)

Offline ashraful.diss

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 221
  • 'শীঘ্রই রব তোমাকে এত দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে'
    • View Profile
    • Daffodil Institute of Social Sciences - DISS

বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব: প্রকাশ্য ও গোপন জীবনের চালিকাশক্তি

আজ আমি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আলোকিত করতে পারে, আমাদের আমলগুলোকে অর্থবহ করে তুলতে পারে এবং আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে পারে। আর সেটি হলো - প্রত্যেক কাজ, কথা এবং প্রকাশ্য-গোপনীয় অবস্থায় নিয়তকে বিশুদ্ধ করা।

নিয়ত আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো সংকল্প, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় বা আকাঙ্ক্ষা। ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের প্রতিটি কাজের বাহ্যিক রূপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেই কাজের পেছনের উদ্দেশ্য বা নিয়তও আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى

"নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।" (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)

এই একটি হাদীসই নিয়তের গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কথা এবং এমনকি আমাদের গোপন চিন্তাভাবনারও একটি নিয়ত থাকে। এই নিয়ত যদি বিশুদ্ধ হয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয়, তাহলে সেই কাজ, কথা বা চিন্তাও ইবাদতে পরিণত হতে পারে এবং আল্লাহর কাছে পুরষ্কারের যোগ্য হতে পারে। পক্ষান্তরে, যদি নিয়তে ভেজাল থাকে, লোক দেখানো উদ্দেশ্য থাকে অথবা অন্য কোনো পার্থিব লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহলে সেই কাজের বাহ্যিক সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও তা আল্লাহর কাছে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে।

প্রকাশ্য জীবনে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব:

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা কিছু করি, যেমন - সালাত আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রোজা রাখা, হজ পালন করা, দান-সাদাকা করা, জ্ঞান অর্জন করা, পরিবার ও সমাজের জন্য কাজ করা - এই সমস্ত কাজের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। যদি আমাদের সালাত লোক দেখানোর জন্য হয়, যাকাত সুনাম অর্জনের জন্য হয়, অথবা দান-সাদাকা পার্থিব কোনো স্বার্থের জন্য হয়, তাহলে সেই আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ   

"তাদেরকে কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে এবং সালাত কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। এটাই সঠিক দ্বীন।" (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫)

অতএব, আমাদের প্রকাশ্য জীবনের প্রতিটি ইবাদত ও সৎকাজের নিয়ত হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কোনো প্রকার খ্যাতি, প্রশংসা বা পার্থিব লাভের উদ্দেশ্য যেন আমাদের আমলকে কলুষিত না করে।

গোপন জীবনে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব:

আমাদের গোপন জীবনও আমাদের ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা যখন একান্তে থাকি, তখন আমাদের অন্তরে যে চিন্তাগুলো আসে, আমাদের যে গোপন আকাঙ্ক্ষা থাকে, সেগুলোরও একটি নিয়ত থাকে। যদি আমাদের গোপন নিয়ত আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়, যেমন - কুচিন্তা করা, হারাম কাজের পরিকল্পনা করা, কারো ক্ষতি কামনা করা - তাহলে এর খারাপ প্রভাব আমাদের আত্মাকে কলুষিত করে।

অন্যদিকে, যদি আমাদের গোপন নিয়ত বিশুদ্ধ হয়, যেমন - একান্তে আল্লাহর যিকির করা, নিজের ভুলত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হওয়া, অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করা - তাহলে এর মাধ্যমে আমাদের ঈমান মজবুত হয় এবং আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়।

কথা বলার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব:

আমাদের প্রতিটি কথারও একটি নিয়ত থাকে। আমরা যখন কারো সাথে কথা বলি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য কী? কি উদ্দেশ্যে আমরা সেই কথা বলছি? যদি আমাদের কথা বলার উদ্দেশ্য হয় কাউকে কষ্ট দেওয়া, কারো সম্মানহানি করা, মিথ্যা প্রচার করা অথবা অনর্থক আলোচনা করা, তাহলে সেই কথা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।

পক্ষান্তরে, যদি আমাদের কথা বলার উদ্দেশ্য হয় সত্য বলা, ভালো উপদেশ দেওয়া, মানুষের মাঝে মীমাংসা করা অথবা আল্লাহর যিকির করা, তাহলে সেই কথা সদকাহ হিসেবে গণ্য হতে পারে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَٰلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا 

"তাদের অধিকাংশ গোপন আলোচনায় কোনো কল্যাণ নেই; তবে কল্যাণের কথা হলো যে দান-খয়রাত, সৎকাজ অথবা মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার নির্দেশ দেয়। আর যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তা করে, অচিরেই আমি তাকে মহা পুরস্কার দেব।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৪)

অতএব, আমাদের প্রতিটি কথার নিয়ত হতে হবে কল্যাণকর এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে।

নিয়ত বিশুদ্ধ করার উপায়:

নিয়তকে বিশুদ্ধ করা একটি Continuous process। এর জন্য আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং নিজেদের অন্তরের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিছু উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো:

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া: নিয়তকে বিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর কাছে নিয়মিত দু'আ করা।

আত্মপর্যালোচনা করা: প্রতিটি কাজ ও কথার আগে নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা।

ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা: কোরআন ও হাদীসে ইখলাসের ফজিলত এবং রিয়ার (লোক দেখানো) ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা।

সৎসঙ্গ অবলম্বন করা: এমন ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা যারা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ এবং যাদের সংস্পর্শে নিজের নিয়ত বিশুদ্ধ রাখার প্রেরণা পাওয়া যায়।

অহংকার ও আত্মম্ভরিতা পরিহার করা: নিজের আমল ও জ্ঞানের উপর গর্ব করা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।

গোপনে সৎকাজ করা: লোক দেখানোর প্রবণতা কমানোর জন্য মাঝে মাঝে গোপনে এমন কিছু সৎকাজ করা যা অন্য কেউ জানে না।

পরিশেষে, আসুন আমরা সকলে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে - প্রকাশ্য ও গোপনে, কথা ও কাজে - নিয়তকে বিশুদ্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। একমাত্র বিশুদ্ধ নিয়তই আমাদের আমলগুলোকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে এবং আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে শান্তি ও সফলতা এনে দিতে পারে।

আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Hafez Maulana Mufti. Mohammad Ashraful Islam
Sr. Ethics Education Teacher
Daffodil Institute of Social Sciences - DISS