বহুমুখী রফতানিযোগ্য পণ্য
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ১৬ জানুয়ারী ২০১২, ৩ মাঘ ১৪১৮
দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে রফতানিশিল্প ও রেমিট্যান্স। এ রফতানিশিল্প অনেকটাই নির্ভরশীল পোশাক খাতের ওপর। তৈরি পোশাকের মোট রফতানির ৯০ শতাংশই হয় আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইউরোপের ঋণ সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের পোশাকশিল্পে। বাংলাদেশে রফতানিযোগ্য বহু পণ্য রয়েছে। যেমন— ইলেকট্রনিক্স পণ্য, প্লাস্টিক, জাহাজ, ওষুধ, ফুল, সিরামিক, পাট, চামড়া, চিংড়ি ইত্যাদি বহু দ্রব্য রয়েছে এ দেশে। সরকারের সুনজর ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা এসব দ্রব্য রফতানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারি। এর মধ্যে প্রধান পাঁচটি রফতানিমুখী পণ্য হলো— জাহাজ, ইলেকট্রনিক্স, পাট, ওষুধ ও ভেষজ উদ্ভিদ এবং চামড়া।
জাহাজ নির্মাণশিল্প হতে পারে সবচেয়ে বড় রফতানির খাত। বর্তমানে ১৫০টির মতো জাহাজ নির্মাণশিল্প রয়েছে। এখানে প্রায় ২ লাখ লোক কাজ করে। জাহাজ নির্মাণশিল্পে বাংলাদেশের আগমন বেশি দিনের নয়। তার ওপর রয়েছে উপযুক্ত পরিবেশ এবং সরকারের সহায়তার অভাব। এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমাদের তৈরি জাহাজের চাহিদা ডেনমার্ক-জার্মানি থেকেও বেশি। এছাড়া সুইডেন, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক আগ্রহী ক্রেতা তৈরি হয়েছে। অথচ সরকার যদি অল্প কিছু পদক্ষেপ নেয় তাহলে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নামকরা জাহাজ প্রস্তুতকারী দেশের পাশে দাঁড়াতে পারবে। জাহাজ নির্মাণশিল্পকে বিশ্বের অন্যতম রফতানিকারক শিল্পে নিতে হলে সরকারকে অল্প কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, সরকারকে চলতি বাজেটের মতো রফতানি ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা না দিয়ে ভারতের মতো বাংলাদেশেও ৩০ শতাংশ রফতানি সহায়তা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের শর্ত শিথিল করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য রাখতে হবে, স্থানীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি আবার বিদেশি ব্যাংক দিয়ে রি-ইস্যু না করে বাংলাদেশই যাতে কম হারে গ্যারান্টি ইস্যু কমিশন নেয়।
তৃতীয়ত, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য বিনা শুল্কে মেরিন ইঞ্জিন ও ডিজেল ইঞ্জিন, মেরিন জেনারেটর প্লেট, পার্টস ইত্যাদি আমদানি করতে পারে।
বেসরকারি খাত অনেক আগেই এ শিল্পে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সরকারি সহায়তা না পেলে জাহাজ নির্মাণশিল্প কতদূর যেতে পারবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বর্তমানে রফতানি বহুমুখীকরণে ইলেকট্রনিক্স শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিক্স পণ্য মানেই আমাদের তা আমদানি করতে হবে— এরূপ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান আরবি গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ওয়ালটন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে শেষে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তারা আশাবাদী। চীন ও থাইল্যান্ডের উত্পাদিত পণ্যের চেয়ে বিদেশে ওয়ালটনের চাহিদা বেশি। ফিলিপস, সনি, দাইয়ু, সিঙ্গার, স্যামসাংয়ের সঙ্গে আমাদের দেশের ওয়ালটন প্রতিযোগিতা করছে। বিদেশি আমদানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করলে তাদের আগামী অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, এয়ারকন্ডিশনার ইত্যাদি পণ্য রফতানি হচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও আমেরিকাতে।
পাট রফতানির সোনালি ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এক সময় বাংলাদেশ পাট রফতানিতে প্রথম ছিল। তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বর্তমান সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সিনথেটিকের দাম বেড়েছে। তার ওপর সিনথেটিকের ক্ষতিকর দিকের কারণে ভারত, চীন, ব্রাজিল, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও পাটের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমাদের দেশেও পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা শুরু করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে ৪১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানি আয় পেয়েছে ৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পাট রফতানি করছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ থাকা ১০টি পাটকল আবার চালু হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আমাদের তৈরি পাটের চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার, কুশন, মেয়েদের ওড়না, জুতা, শপিং ব্যাগ, রুমাল, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের খেলনা, পাপোশ ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। ২০০৮ সালে এ শিল্পে মোট ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। প্রতি বছর এ আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ফার্মা শিল্প প্রবেশ করেছে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশ। তারা রফতানি করছে মেডিকেল প্র্যাকটিসনারস, উচ্চ কারিগরি সম্পন্ন HFA INHALERS, CFC INHALERS, NASAL SPRAY ইত্যাদি বহুমুখী দ্রব্য। এ শিল্প সাফল্যের সঙ্গে APIS রফতানি করছে। বিশ্বের ৭১টি দেশের প্রধান চিকিত্সামূলক ডোজ, ট্যাবলেট, সিরাপ ও ক্যাপসুলের চাহিদা পূরণ করছে। বাংলাদেশের বেশ কিছু কোম্পানি UKMHAR, EU, TGA, AUSTRALIA এবং GCC সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রক্রিয়াধীন।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে থেকে ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করতে হলে আমাদের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ জন্য ঔষধি উদ্ভিদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সমপ্রসারণের জন্য ৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব মেডিসিন অ্যান্ড অ্যারোমেটিক প্লান্টস স্থাপন করা হচ্ছে। সে সঙ্গে ব্যাংকিং সুবিধা, অল্প সুদে ঋণ প্রদান, পণ্য পরিবহন সুবিধা, বাজারজাত করার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে এর চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিলে আমরাও প্রচুর পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করতে পারব। এদেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৬টি রফতানিযোগ্য উদ্ভিদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ চামড়া উত্পাদিত হয়। প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ গরু-ছাগল ও ভেড়ার চামড়া পাওয়া যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, এ সম্ভাবনাময় রফতানিমুখী শিল্পের অবদান আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অতি সামান্য। বাংলাদেশে উত্পাদিত চামড়ার ১৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং বাকি ৮৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং প্রতি বছর কুরবানির সময় একটা চক্র পানির দরে চামড়া কিনে প্রচুর টাকা লাভ করে। আবার বেশ কিছু চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যায়। সরকার যদি চামড়াশিল্পে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য, ঋণ দান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, প্রশিক্ষণ এবং পাচার রোধে সচেষ্ট হয়, তাহলে বাংলাদেশও প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারবে চামড়া রফতানি করে। এর ফলে একদিকে যেমন নতুন নতুন চামড়াশিল্প স্থাপিত হতো এবং এর ফলে বেকারত্ব হ্রাস হবে, তেমনিভাবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে।
লেখক : প্রভাষক ( অর্থনীতি) ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি