রাস্তাঘাটে তীব্র যানজট : অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ১৫ ফাল্গুন ১৪১৮
পরিবহন ব্যবস্থার ওপর একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ অর্থনীতিতে পণ্য ও শ্রমিকের গতিময়তা যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যে রাস্তাঘাটের স্বল্পতা, পরিবহনের স্বল্পতা, রেল ব্যবস্থার অপ্রচলন। দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো যানজট। রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায়ই দেখা যায় ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লাগে ১ থেকে ২ ঘণ্টা। আগামীতে এর চেয়ে বেশি সময়ও লাগতে পারে। ঢাকার যানজটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন জেলাতে সংক্রামক ব্যাধির মতো এ সমস্যা ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে দেশের বড় অঙ্কের শ্রমঘণ্টা এবং জ্বালানিসহ বিভিন্ন ধরনের অপচয় হচ্ছে। তাছাড়া যানজটের কারণে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বা উত্পাদনক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
যানজট বিষয়ে বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ সমস্যার জন্য আমাদের দেশে বছরে প্রায় ১৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা নষ্ট হয়। প্রতিদিন ৮১ লাখ ৬০ হাজার কর্মঘণ্টা হারিয়ে যায়। এর মানে হলো, বছরে প্রায় ২০০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। বিনা কারণে বছরে ১.৭ মিলিয়ন টন জ্বালানির প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হচ্ছে। বিশেষত, ঢাকা শহরের দেড় কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি লোকের দৈনিক ৮০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যদি মনে করি আমাদের দৈনিক ন্যূনতম মাথাপিছু আয় ২০০ টাকা, তাহলে ১ কোটি লোকের বার্ষিক আয় কমে যায় ১৮২৫ কোটি টাকা।
অনেক দিনে ধরেই আমাদের অর্থনীতিতে যানজটের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ছে। বর্তমানে এ ক্ষতিকর প্রভাব বহুগুণে বেড়ে গেছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলাচলকারী যানবাহনগুলো সাড়ে সাত ঘণ্টা থেমে থাকে। তাছাড়া যানজটের কারণে ৪০ শতাংশ জ্বালানি নষ্ট হয়। বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ির কর্মঘণ্টা নষ্ট বাবদ ক্ষতি হয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। শিল্পপণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষতি হয় ৪ হাজার কোটি টাকা, অতিরিক্ত সিএনজি খরচ হয় ৫৭৫ কোটি টাকা, দুর্ঘটনা বাবদ ব্যয় ৫০ কোটি, পরিবেশগত ক্ষতি ২ হাজার ২শ’ কোটি এবং চিকিত্সা ব্যয় ৭৩০ কোটি টাকা। এগুলো হলো প্রত্যক্ষ ক্ষতি। পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব তো আরও বড়। ১৯৭৪ সালে ঢাকা শহরে লোক সংখ্যা ছিল ২ লাখ। বর্তমানে ২ কোটি। প্রতিদিন ২০৩টি প্রাইভেটকারের অনুমতি দিচ্ছে বিআরটিএ। অথচ জনসংখ্যা ও গাড়ির সংখ্যা অনুযায়ী রাস্তা বাড়েনি।
ঢাকা শহরে প্রায় ৩৭ ভাগ মানুষ হেঁটে চলাচল করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ফুটপাতের দিকে খেয়াল করে। অনেক সময় দেখা যায় রাস্তার চেয়ে ফুটপাতের আকার বড়। আমাদের দেশে এ ৩৭ ভাগ লোকের জন্য ১০০ ফুট রাস্তা হলে ৩৭ ফুট ফুটপাত থাকা উচিত। অথচ দেখা যায় যে, বড় রাস্তাগুলোর দু’পাশ যোগ করে ১০-১৫ ফুটের বেশি ফুটপাত নেই। তার ওপর এ ফুটপাতে বসে আছে বিভিন্ন ধরনের ছোট আকারে দোকান, বিভিন্ন গাড়ি এখানেই পার্ক করা হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ফুটপাত ভাঙা। দেশের অভিজাত এলাক বারিধারা, গুলশান, বনানীতেও এখন নিয়মিত যানজট দেখা যায়।
এ কারণে দেখা যায়, একজন সিএনজি চালকের প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা। মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা এবং বছরের ক্ষতি হচ্ছে ৭৩ হাজার টাকা। একটা বড় বাসেও এ ধরনের সময় নষ্ট হয় আর ব্যয় হয় দ্বিগুণ। দেখা যায় যে, বড় বাসের স্থলে দৈনিক ক্ষতি হয় ১৩ থেকে ১৫শ’ টাকা।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ চালকের দক্ষতা ও শিক্ষা দুটিই কম। তার ওপর দেখা যায়, বেশির ভাগ কন্ডাক্টর কম বয়সী। তারা ট্রাফিক আইন জানেও না, আবার মেনেও চলে না। যখন-তখন তারা যাত্রী নামায় ও ওঠায়। ইচ্ছা হলেই ওভারটেক করে। এ অবস্থা রিকশাচালকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশে বাস ট্রাকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এর মধ্যে লাইসেন্সধারী চালক ৯ লাখ এবং ভুয়া লাইসেন্স রয়েছে ৪ লাখের। গাড়ির সংখ্যা অনুযায়ী পার্কিং ব্যবস্থা নেই। নগরীতে প্রাইভেটকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও দেখা যায়, কোনো নতুন মডেলের গাড়ি আমদানি করার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। একটা প্রাইভেট কারে এক থেকে দুজনের জন্য ব্যবহার করা হয়। সেখানে একটি বাস ৪০-৫০ জন লোকের জন্য ব্যবহূত হয়।
দেখা যায়, ঢাকাতে একজন কর্মজীবী লোক কর্মস্থলে যাওয়ার আগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা হাতে রেখে রওনা দেন। আধাঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতে হয় তার। তারপর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পরে কর্মস্থলের কাছাকাছি আসে। তারপর আবার আধাঘণ্টা হাঁটতে হয়। অবশেষে কর্মস্থলে পৌঁছেন। ঠিক এভাবে আবার তারা বাসায় ফেরেন। এ যানজটের কারণে আজ আমাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ধারণ করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া যানজটের কারণে উত্পাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
লেখক : প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি