খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষির দিকে নজর দিতে হবে
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ৮ ফাল্গুন ১৪১৮
আমাদের দেশের অন্তর্ভুক্তিমুলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনেকাংশে নির্ভর করে কৃষিশিল্পের ওপর। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। ২০০৯-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী এ দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ২০.৮৩ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অতীতকালে বাংলাদেশের একটা সাধারণ দৃশ্য ছিল গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গর, পুকুর ভরা মাছ ও স্বাস্থ্যবান কৃষক। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষির অবদান ক্রমেই কমে আসছে। এ কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে যে শুধু অর্থনীতি নির্ভর করছে তা নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়ন।
বর্তমানে হাইব্রিড জাতের ফসল উত্পাদন বাড়লেও বাস্তবে আমাদের দেশে আশানুরূপ ফসল উত্পাদন হচ্ছে না। এর কারণ হলো এদেশের মাটিতে দরিদ্র কৃষকেরা না বুঝেই ব্যবহার করছেন অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার। এসব সারের বেশির ভাগের তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। বর্তমানে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এমওপি, বোরন, জিংক, টিএসপি, ম্যাগনেসিয়াম, ডিএপি। বেশির ভাগ কৃষকই এসব সারের সঠিক ব্যবহার জানেন না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সঠিক মানসম্মত ও ভালো সারের উত্পাদন খরচ আমাদের কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৫০ কেজি মিশ্র সার (এনপিকেএস) তৈরির খরচ কমপক্ষে ২৩০০ টাকা। অথচ আমাদের বাজারে এর সর্বোচ্চ মূল্য ৮০০ টাকা। এতেই বোঝা যাচ্ছে কোম্পানিগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে কোয়ালিটির দিকে খেয়াল না করে ভেজাল মিশিয়ে কম দামে বেশি বিক্রির দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমাদের কৃষকেরা কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তা, সার প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির ওপর নির্ভরশীল। এদের দায়িত্বহীনতা ও অসত্ উপায়ে বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য তারা অনেক সময়ই কৃষকদের ভুল পরামর্শ দিয়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশে বাজারে বেশ ভালো মানের জৈব সার আছে। কৃষকেরা যদি এসব জৈব সার ব্যবহারে আগ্রহী হন, তাহলে তাদের জমির উত্পাদন ক্ষমতা ও ফসল উত্পাদনের হার উভয়ই বৃদ্ধি পাবে।
১৯৭১ সালে আমাদের দেশের লোক সংখ্যা ছিল সাত কোটি। বর্তমানে এসে দাঁড়িছে দ্বিগুণের বেশি। অধিক জনসংখ্যার কারণে আবাদি জমির পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনিভাবে জমি ভাগ হয়ে হয়ে ছোট হওয়াতে চাষাবাদ করতে অসুবিধায় পড়ছেন কৃষকেরা। বর্তমানে আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৮%। এভাবে বৃদ্ধি পেলে ২০৩০-এ জনসংখ্যা হবে ২০ কোটির বেশি এবং মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমাণ হবে ০.০৪৭ হেক্টর। এর মধ্যে ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরে কৃষি জমিতে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তৈরি করার পর যতটুকু জমি বাকি থাকে তা এত বড় আকারের জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে না। কম পরিমাণ জমি থেকে খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের দেশকে এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। জমির উর্বরা শক্তি যেমন কমছে, তেমনিভাবে চাষাযোগ্য জমির পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। তার ওপর আমাদের কৃষকেরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ব্যবস্থা সম্পর্কেও অজ্ঞ। যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ব্রি ধান ৪৭’ আবিষ্কার করেছে। যা লবণাক্ত সহিষ্ণু। এমন কিছু উদ্ভাবন উপকূলীয় এলাকায় চাষের জন্য উপকারী। দুঃখের বিষয়, অধিক লাভ ও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লোভে এখানে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একদিকে যেমন চাষের জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে, তেমনি দেখা দিয়েছে খাদ্য ঘাটতি। অথচ চিংড়ি চাষের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ করা হলে এমন খাদ্য ঘাটতি দেখা যেত না।
এক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল পাট। একে বলা হতো সোনালি আঁশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি মানেই ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বিশ্বে পাট রফতানিতে প্রথম ছিল বাংলাদেশ। ১৯৪০ সালেও রফতানি আয়ের চল্লিশ শতাংশ ছিল পাট থেকে। আমরা এ শিল্প ধরে রাখতে পারিনি।
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু দানাদার খাদ্য উত্পাদন করাকে বোঝায় না, বরং এখানে পুষ্টি সরবরাহকারী শাকসবজি উত্পাদন করাকে বোঝায়। শাকসবজি উত্পাদনের জন্য উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে এদেশে শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাচ্ছে। যার ফলে গম উত্পাদন কম হচ্ছে। ফুলের পরাগ শুকিয়ে পড়ছে। বাঁধাকপির মাথা বাঁকতে পারছে না, ফুলকপির ফুল তৈরি হচ্ছে না, আলুর টিউবার তৈরি কমে যাওয়ায় ফলন কম হচ্ছে। এ কারণে ফুল ফোটা ও পড তৈরি হতে পারছে না বলে বীজ উত্পাদনও কমে যাচ্ছে। উন্নত মানের বীজ উত্পাদন করতে না পারলে কখনোই খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হবে না। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ হলো গ্লোবাল ওয়ার্মিং। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে আগামী ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১০০ সেন্টিমিটার বাড়ে তবে বাংলাদেশের ভেতরে ১৭ থেকে ২০ শতাংশ জমি ডুবে গিয়ে ফসল আবাদের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। এজন্য সরকারের উচিত এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদি সূক্ষ্ম গবেষণা করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নেওয়া।
লেখক : প্রভাষক (অর্থনীতি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি