শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন নারী
নোবেল পুরস্কার নিয়ে যত জল্পনা সব শান্তির পুরস্কারকে ঘিরেই। জোর গুঞ্জন ছিল এ বছর আরব গণজাগরণের কিছু নেপথ্য নায়ক আর অগ্রসৈনিক পাচ্ছেন মর্যাদাবান এ পুরস্কার। এবারের মতো সব জল্পনা শেষ। আরব গণজাগরণের এক নেত্রীসহ এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিন মহীয়সী নারী। শান্তির যোদ্ধা এই তিন সৌভাগ্যবান নারীর মধ্যে দু'জন আফ্রিকার দরিদ্র দেশ লাইবেরিয়ার, অপরজন অনগ্রসর অর্থনীতির আরব দেশ ইয়েমেনের। তারা হচ্ছেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন সিরলিফ, তার স্বদেশি নারীনেত্রী লেমাহ গবোই এবং ইয়েমেনের আরব জাগরণ নেত্রী তাওয়াক্কুল কারমান। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য এ তিনজনের নাম ঘোষণা করে নরওয়ের নোবেল কমিটির সভাপতি থরবজোয়ের্ন জ্যাগল্যান্ড বলেন, নারীর নিরাপত্তা ও নারী অধিকারের অহিংস সংগ্রামে অবদানের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে পুরোপুরি শামিল হওয়ার জন্য তাদের এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সমাজের সব পর্যায়ের উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকার অর্জন না করা পর্যন্ত আমরা গণতন্ত্র এবং স্থায়ী শান্তি অর্জন করতে পারব না।
২০০৫ সালেই ইতিহাস :আফ্রিকা মহাদেশের কোনো দেশে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ২০০৫ সালেই ইতিহাস গড়েন ইলেন জনসন সিরলিফ (৭২)। ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে লাইবেরিয়ার হাল ধরেন এ 'লৌহমানবী'। ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছিল আড়াই লক্ষাধিক মানুষ। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন দেশটির অর্থনীতি ছিল পঙ্গু। বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানীয় জল, অবকাঠামো কিছুই ছিল না। মাত্র ৪ দিন পর দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন সিরলিফ। নির্বাচনকে সামনে রেখে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার সমালোচনা করেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী উইনস্টন টুবম্যান। বার্তা সংস্থা এএফপিকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ভোটের আগে নোবেল পুরস্কার প্রদান 'অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত।' উইনস্টনের মতে, ম্যাডাম সিরলিফ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত নন। কারণ তিনি নিজ দেশে সহিংসতা ছড়িয়েছেন। তবে নোবেল কমিটি ইলেন জনসন সিরলিফের প্রশংসা করে বলেছে, লাইবেরিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং মহিলাদের অবস্থান শক্তিশালী করার কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরে আনন্দ প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট সিরলিফ এ পুরস্কারকে নিজ দেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এএফপিকে টেলিফোনে তিনি বলেন, এটা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমার দীর্ঘ বছরের লড়াইয়েরই স্বীকৃতি। এই পুরস্কার লাইবেরিয়ার নারী সমাজেরও বটে। তিনি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীর সহায়তার জন্যই তিনি আজ এর স্বীকৃতি পেয়েছেন।
যার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ইলেন জনসন সিরলিফ হয়ত লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠাও হয়ত যার প্রচেষ্টা ছাড়া সিরলিফের পক্ষে অসম্ভব হতো সেই সহযোদ্ধা লেমেহ গবোইকেও একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে নরওয়ের নোবেল কমিটি। ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজ নেতাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারী অধিকারের ঝান্ডা নিয়ে এগিয়ে যেতে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ৩৯ বছরের এই নারীনেত্রী। পুরুষদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন শান্তির পক্ষে। ২০০২ সালে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সময় মুসলিম-খ্রিস্টান নারীদের নিয়ে একটি বিশাল সংগঠন গড়ে তুলে যুদ্ধ বন্ধ করতে 'যৌথ ধর্মঘট' পালনে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। তার প্রশংসা করে নোবেল কমিটি বলেছে, লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসানে জাত-পাত আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী সমাজকে তিনি সংগঠিত করেন। নারীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারও আদায় করেন তিনি। ২০০৩ সালে লেমেহ গবোইর নেতৃত্বে তার সংগঠনের নেত্রীরা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরকে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেন। এ সময় তারা ঘানায় শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে টেলরের প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন। এরপর নির্বাচনের সময় তিনি নারী সমাজকে সিরলিফের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার প্রচেষ্টায় আফ্রিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হন সিরলিফ। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরে আনন্দ প্রকাশ করে লেমেহ গবোই এ পুরস্কারকে সারা বিশ্বের বিশেষ করে আফ্রিকার নারী সমাজের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
আরব গণজাগরণের রূপকার
ইয়েমেনের ৩২ বছরের টগবগে তরুণী সাংবাদিক তাওয়াক্কুল কারমান। নারী অধিকার আন্দোলনেও তার রয়েছে অনন্য অবদান। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দেশে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতেও সোচ্চার এ সাহসী আরব নারী। আরব নারীদের মধ্যে প্রথম নোবেল জয়ী তাওয়াক্কুল কারমানের প্রশংসা করে নোবেল কমিটি বলেছে, আরব গণজাগরণের আগে ও পরে ইয়েমেনে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার নেতৃত্ব অবিস্মরণীয়। পুরস্কার পাওয়ার খবরে আল অ্যারাবিয়া টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাওয়াক্কুল এ পুরস্কারকে আরব গণজাগরণের সব কর্মীর জন্য উৎসর্গ করেছেন। এ বিজয়কে তিনি অভিহিত করেন ইয়েমেন বিপ্লবের বিজয় হিসেবে।
বছরের গোড়ার দিকে তিউনিশিয়ায় শুরু, মিসরেও শান্তিপূর্ণ সফলতা। তারপর জর্দান, সৌদি আরব, মরক্কো, বাহরাইন, ওমান, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লিবিয়ায় আছড়ে পড়ল যার উত্তাল ঢেউ। সেই আরব গণজাগরণ এখনও চলমান। অর্ধলক্ষাধিক লোক নিহত হওয়ার পরও শান্তি নেই লিবিয়ায়। সিরিয়ায় চলছে পাইকারি নিধনযজ্ঞ। রক্তাক্ত তাওয়াক্কুলের দেশ ইয়েমেনও। অজ্ঞাত স্থান থেকে ছোড়া রকেট হামলায় নিজ প্রাসাদে গুরুতর আহত হন দেশটির প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ। কয়েক মাস সৌদি আরবে চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন তিনি। এখনও ক্ষমতার হাল ছাড়ছেন না। গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে রাজধানী সানার চেঞ্জ স্কয়ার চার মাস আঁকড়ে ছিলেন তিন সন্তানের জননী তাওয়াক্কুল কারমান। আশঙ্কা ছিল সেখান থেকে সরলেই প্রেসিডেন্ট সালেহর গুন্ডারা তাকে হত্যা করবে। ২০০৫ সালে তাওয়াক্কুল গড়ে তোলেন 'ওমেন জার্নালিস্টস উইদাউট চেইঞ্জ' নামের একটি সংগঠন। প্রেসিডেন্ট সালেহবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তিনি। সালেহকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে তার নেতৃত্বাধীন আন্দোলন এখনও থামেনি। ইয়েমেনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন গতকাল তার নোবেল প্রাপ্তির খবরটি পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে।
একসঙ্গে তিন নারীর একই বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরল ঘটনাটি ঘটল এবারই। নোবেল কমিটির এ পছন্দের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গও। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমি এটাকে দেখছি সারা বিশ্বের নারী অধিকার আন্দোলনে জড়িত সকল নারীর অবদানের প্রতি একটা স্বীকৃতি হিসেবেই। পুরস্কার হিসেবে এই তিন মহীয়ষী নারী পাবেন একটি ডিপ্লোমা সনদ ও একটি স্বর্ণপদক। পুরস্কারের নগদ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনের (১৪ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার) সমানভাবে ভাগ করে নেবেন তারা। নোবেল পুরস্কারের জনক আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন আগামী ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানী ওসলোতে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। গত বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন চীনের ভিন্নমতাবলম্বী নেতা লিউ জিয়াও বো, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
নারী অধিকার আন্দোলনের বিজয়
নারী নেত্রীকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার ব্যাপারে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এটা নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। অন্য মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এ সিদ্ধান্ত নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র আর স্থায়ী শান্তি যে অর্জিত হতে পারে না, তারই একটা স্বীকৃতি। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এটাকে তাক লাগানো খবর হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এ পুরস্কারের জন্য এরচেয়ে আর কোনো ভালো পছন্দ হতে পারে না। এটা নারী নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রতি একটা স্বীকৃতি। আরব গণজাগরণে মিসর অভ্যুত্থানের অন্যতম পুরোধা ওয়ায়েল গনিম নোবেলপ্রাপ্তির জন্য তাওয়াক্কুল কারমানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, একজন আরব হিসেবে তিনি গর্ববোধ করছেন। এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, আমাদের আসল পুরস্কার হচ্ছে আমাদের দেশগুলোতে আরও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেন, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন সিরলিফ তার দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকবার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে পরিচিত জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এ তিন নারীকে নোবেল পুরস্কার প্রদানকে শুভ সংকেত উল্লেখ করে বলেন, তাদের এ অর্জন আরও অনেক নারী-পুরুষকে গণতন্ত্র, মুক্তি ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করবে।