আমাদের কেন এত বিসিএস ‘জ্বর’

Author Topic: আমাদের কেন এত বিসিএস ‘জ্বর’  (Read 748 times)

Offline Khan Ehsanul Hoque

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 549
  • Test
    • View Profile
আমাদের কেন এত বিসিএস ‘জ্বর’

সমসাময়িককালে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবার কাছে একটাই—যেভাবেই হোক বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। সমাজের লোকজনও বিসিএস-সফলতাকে ঈর্ষার চোখে দেখেন। উচ্চশিক্ষা শেষ করার আগে থেকেই তাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আমাদের এই বিসিএস ‘জ্বর’-এর পেছনে কাজ করছে কোন মনস্তত্ত্ব? আর বিসিএসপ্রীতির কারণই-বা কী?


দোতলার পূর্ব দিকের ঘরের সঙ্গে লাগানো বারান্দা। সেই বারান্দা থেকে শিরীষগাছটা খুব ভালো করে দেখা যায়। বিকেলজুড়ে রবি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিরীষগাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। গাছের একেকটা পাতার ওপর শেষবিকেলের আলো খেলা করছিল। রবি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সেই আলো–ছায়ার খেলা। তারপর সন্ধ্যা লাগতেই ঘরে ঢুকে টেবিলে বসে কবিতা লিখতে শুরু করল।

এ টেবিলেই বেশির ভাগ সময়ে বিসিএস গাইড নিয়ে বসে থাকে সত্যপ্রসাদ। সত্যপ্রসাদ সম্পর্কে রবির ভাগনে। একই বয়সী। সবার আশা, সত্য বিসিএস ক্যাডার হয়ে ঠাকুরবাড়ির মুখ উজ্জ্বল করবে। এর আগে রবির মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। এখন বউ নিয়ে মাদ্রাজে থাকেন। মাদ্রাজে যাওয়ার দিনকয়েক আগে সত্যেন্দ্রনাথের বউ জ্ঞানদানন্দিনী দরজির কাছে নতুন ডিজাইনের জামা বানাতে দিয়েছিলেন। যতই হোক, বিসিএস ক্যাডারের স্ত্রী, যে-সে কাপড় পরে তো আর জাহাজে ওঠা যায় না!

কবিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ রবির মনে হলো, সেজ ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানতে পারলে মুশকিল। বিসিএস পড়া বাদ দিয়ে লেখালেখি করা পরিবারের কেউ পছন্দ করছে না। বাবা দেবেন্দ্রনাথ মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘রবিকে দিয়ে কিছু হবে না।’ রবির বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথেরও ভালো সম্ভাবনা ছিল বিসিএসের। কিন্তু তাঁর কপাল খারাপ। কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকেন। বাড়ির ছোট ছেলে বলে রবির ওপর চাপ বেশি। মা সারদা দেবীই যা একটু রবির হয়ে কথা বলেন।

একসময় ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরীক্ষার খাতায় ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় লিখত, ‘আমি ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই।’ কেউ কেউ লিখত, ‘আমি শিক্ষক হতে চাই। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চাই।’ এখন ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও তরুণ-তরুণীরা পুলিশ, প্রশাসন, রাজস্ব, কাস্টমস কিংবা অন্য কোনো ক্যাডারের স্বপ্ন দেখেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করতে থাকা শিক্ষার্থীও তাঁর বিষয়গত পড়াশোনার চেয়ে বিসিএস প্রস্তুতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ব্যাপারটা ঠিক ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধির মতো।

বাবা রবির পড়াশোনা নিয়ে খেপে উঠলে মা বলেন, ‘এত ভয় করছ কেন? বিসিএস না হলে রবিকে আমাদের জমিদারি দেখাশোনার কাজে লাগিয়ে দিয়ো।’ বাবা বলেন, ‘এখন জমিদারি দিয়ে ভালো আয়ের সুযোগ নেই। দেখছ না, আমি কেমন কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছি!’

সেজ ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে গিয়ে রবিকে আর সত্যকে একটা বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। সত্য সেখানে ঠিকঠাকমতো ক্লাস করছে। মডেল টেস্টগুলোতে ভালো নম্বরও পাচ্ছে। কিন্তু রবি দু-এক দিন ক্লাস করে আর কোচিংয়েও যাচ্ছে না। সেজদার বউ কাদম্বরী মাঝেমধ্যে এসে রবির কবিতা লেখায় বাধা দেন। বলেন, ‘এসব কবিতাটবিতা লেখা বাদ দাও। এসব লিখে কেউ কোনো দিন গাড়ি-বাড়ি করতে পারেনি। নিরাপদ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে এভাবে হেলায় নষ্ট কোরো না।’


দুই


ওপরের ঘটনাটি কাল্পনিক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের দিনে জন্মালে পরিস্থিতি হয়তো এ রকমই হতো। বর্তমানে বিসিএস রীতিমতো ‘ভাইরাল জ্বরে’ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত পরিবার এখন বিসিএসের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। নিরক্ষর মা–বাবাও সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে অপেক্ষা করতে থাকেন, তিনি কবে বিসিএস পাস করে চাকরিতে ঢুকবেন। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবার কাছে একটাই—যেভাবেই হোক বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। সমাজের লোকজনও বিসিএস-সফলতাকে ঈর্ষার চোখে দেখেন। উচ্চশিক্ষা শেষ করার আগে থেকেই তাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

বিসিএস আসলে কী দেয়? বিসিএস ক্যাডাররা কোন কোন সুবিধা ভোগ করেন? বিসিএস চাকরি অবশ্যই ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু এর বাইরে বিসিএসের পেছনে আর কোন কোন সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে?
একসময় ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরীক্ষার খাতায় ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় লিখত, ‘আমি ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই।’ কেউ কেউ লিখত, ‘আমি শিক্ষক হতে চাই। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চাই।’

এখন ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও তরুণ-তরুণীরা পুলিশ, প্রশাসন, রাজস্ব, কাস্টমস কিংবা অন্য কোনো ক্যাডারের স্বপ্ন দেখে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করতে থাকা শিক্ষার্থীও তার বিষয়গত পড়াশোনার চেয়ে বিসিএস প্রস্তুতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ব্যাপারটা ঠিক ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধির মতো। এ ব্যাধি মানুষের মনে ও সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে।



কী পাওয়া যায় ক্যাডার হলে? মাস শেষে বেতন পাওয়া যায়। সেই বেতনটা যে কত, তা অধিকাংশ অভিভাবক, এমনকি চাকরিপ্রার্থীও ঠিকমতো বলতে পারবেন না। তবে সবার ধারণা, ক্যাডার হলে টাকার সমস্যা থাকে না। কোনো কোনো ক্যাডারে নাকি টাকার বিছানায় শুয়ে থাকা যায়! আর কী পাওয়া যায় ক্যাডার হলে? প্রবল ক্ষমতা পাওয়া যায়। এ ক্ষমতা এত বেশি যে বাকি জীবনে আরও অনেক প্রাপ্তির দুয়ার খুলে দেয়।

সাধারণের ধারণা, এ ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে ভয় পাওয়ানো যায়, অন্যদের চাকরি দেওয়া যায়, অনেক ক্ষেত্রে কালোকে সাদা আর সাদাকে কালো বানানো যায়।
সন্দেহ নেই, জীবনের একটি দিক খুবই বস্তুগত। খাওয়ার চিন্তা, থাকার চিন্তা, পরার চিন্তা, স্বাস্থ্যের চিন্তা সব মানুষকেই করতে হয়। কিন্তু জীবন মানে শুধু খাওয়া, থাকা আর পরা নয়; জীবন মানে শুধু শরীরের ভাবনা নয়। জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য তাহলে কী?

এ উদ্দেশ্যের কথা সেই পুরোনো আপ্তবাক্যেই রয়ে গেছে—‘মানুষের মতো মানুষ হতে হবে’। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত নিজের উত্তরণ ঘটানো। এ উত্তরণ পুরোপুরি মনোগত। মনের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে মানুষ তার বিত্ত আর ক্ষমতাকে হাতিয়ার মনে করতে শুরু করে। সমাজে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্ম ও বিচরণ এবং অপরের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন দেখে মানুষের মনোগত উৎকর্ষের ধারণা পাওয়া যায়।

বিত্ত ও ক্ষমতাকে মানুষের ও সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারাই প্রকৃত মানুষের ধর্ম। যে ব্যক্তি অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল নন, যাঁর মধ্যে ব্যক্তিক লাভ ও লোভের ব্যাপারটাই মুখ্য, নিশ্চিতভাবে তিনি মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চাকরির বাজারও এখন দুর্মূল্য হয়ে পড়েছে। চাকরিও এখন টাকা দিয়ে কেনা যায়।

ভবিষ্যতে নিয়োগকর্তারা নিলাম ডেকে চাকরি বিক্রি করতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এদিক থেকে বিসিএস চাকরি কিছুটা ব্যতিক্রম। কয়েক বছর চোখ–কান বুজে হাজার হাজার তথ্য মুখস্থ করতে পারলে বিসিএস জেতার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

এ চেষ্টা যিনি না করেন, তিনি সমাজের চোখে একজন ‘জড়বুদ্ধির’ মানুষ! আর চেষ্টা করেও যাঁদের বিসিএস হয় না, তাঁরা একধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তাঁদের মনে হয়, জীবনটা বুঝি ব্যর্থ হয়ে গেল। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে কোন গুণসম্পন্ন প্রার্থীকে যাচাই করা হয়, কে জানে। সেই সফলতার জন্য তথ্য মুখস্থ করতে পারার যোগ্যতা হয়েছে প্রধান মাপকাঠি!


গ্রামের, এমনকি শহরের অনেক তরুণের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে। নিজেরা চাইলেই নিজের মতো স্বাধীন পেশায় ও কাজে নিজের জীবন গড়ে নিতে পারেন। তারপরও তাঁদের সমস্ত মনোযোগ বিসিএসের দিকে। প্রজাতন্ত্রের ‘আজ্ঞাবহ দাস’ হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকারান্তরে কিছু সতর্কবার্তার জানান দেয়।

মানুষ বিত্ত আর ক্ষমতাকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করছে। জীবনের গভীর ও মহৎ তাৎপর্য সম্পর্কে যদি তরুণদের জানানো না যায়, আগামীর দিনগুলোতে ‘যান্ত্রিক’ ও ‘অমানবিক’ মানুষেরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে।

Source: https://www.prothomalo.com/onnoalo/treatise/aplm92ff2e?utm_source=facebook&utm_medium=social&utm_campaign&utm_content=ap_bi59ufrgu9
Khan Ehsanul Hoque

Daffodil International University
01847334702
fd@daffodilvarsity.edu.bd
www.daffodilvarsity.edu.bd