টেস্টে সেঞ্চুরিই তো নস্যির মতো ব্যাপার-স্যাপার! কোয়াড্রাপলের গল্প কেবল ব্রায়ান চার্লস লারারই লেখা। কিন্তু এর বাইরে ডাবল-ট্রিপল সেঞ্চুরির কেচ্ছাকাহিনী ভূরি ভূরি। তারপরও টিনো বেস্টের 'মামুলি' ৯৫ রানের ইনিংস নিয়ে চারদিকে কী মাতামাতি! ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নামাদের নিয়ে মাতামাতি পড়ে যাওয়া ৬টি ইনিংসের গল্প এবার_ লিখেছেন সাবি্বর আহমেদ
টিনো বেস্ট-৯৬, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড হলে কথাই নেই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ না কেউ নির্ঘাত জ্বলে উঠবে ব্যাট হাতে, এটাই যেন চিরাচরিত রেওয়াজ! লারা জ্বলেছিলেন, ভিভ জ্বলেছিলেন। কিন্তু তাই বলে টিনো বেস্ট! ক'দিন আগেও তার টেস্ট সর্বোচ্চ ছিল ২৭ রান। পরিচয়, বদরাগী পেসার। আগ্রাসী ভাব আর অক্রিকেটীয় কারণে যিনি শিরোনামে উঠেছেন বেশি। কিন্তু বার্মিহামে 'ব্যাটসম্যান' বেস্টকেই দেখল ক্রিকেটবিশ্ব। ইংল্যান্ডের বোলারদের কানে-মুখে ধোঁয়া তুলে দিলেন ব্যাটের পিটুনিতে। ১৪টি চার ও ১টি বিশাল ছক্কার স্টম্ফুরণে বার্বাডোজের পথহারা ক্রিকেটার দিলেন ৯৫ রানের বিস্টেম্ফারক ইনিংস! বলার অপেক্ষা রাখে না, ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নামাদের মধ্যে টেস্ট সর্বোচ্চ ইনিংসটির মালিক এখন বেস্ট। দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে নেমে মনের জ্বালা জুড়াতে সোয়ান-ব্রেসন্যানদের তুলোধুনে করেছেন ৩১ বছর ছুঁইছুঁই এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান।
জহির খান-৭৫, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ
২০০৪ সালের ঢাকা টেস্ট বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য আজও দুঃস্বপ্নের টেস্ট হয়ে আছে। বোলারদের বেলায় তা ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্ন বললেও কম বলা হবে। প্রথম ইনিংসে তাপস বৈশ্য, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ রফিক, মুশফিকুর রহমানদের ব্যাট দিয়ে পিষে মেরেছিল ভারত। শচীন টেন্ডুলকার করেছিলেন ২৪৮* রান। কিন্তু শেষ দিকে জহির খান যা করেছিলেন, তা বিস্ময়ের গণ্ডি, চরমতম দুঃস্বপ্নকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল! মাশরাফির গতি, রফিকের ঘূর্ণি কোনো জালেই আটকানো যায়নি ডানহাতি জহিরকে। ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৭৫ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। মোহাম্মদ আশরাফুলের বলে খালেদ মাসুদের হাতে ক্যাচ তুলে দেওয়ার আগে ১০ চার ও ২ ছক্কার তাণ্ডব চালিয়েছিলেন ভারতীয় পেসার। বেস্টের আগে জহিরের ইনিংসটিই এতদিন রেকর্ডের এ পাতায় ছিল সবার উপরে।
রিচার্ড কলিঙ্গে-৬৮* প্রতিপক্ষ পাকিস্তান
এ রেকর্ডটি লেখা বছর চলি্লশ আগে, ১৯৭৩ সালে! তখনও পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপে ছিলেন মোশতাক মোহাম্মদ, সেলিম আলতাফ, সরফরাজ নেওয়াজরা। কিন্তু কলিঙ্গে সবাইকে নামিয়ে এনেছিলেন মাটিতে। অকল্যান্ড টেস্টে প্রথম ইনিংসে রডনি রেমন্ড (১০৭) ও ব্রায়ান হাসটিংসের (১১০) ব্যাটিং দেখে বোধহয় কলিঙ্গেরও সাধ হয়েছিল বোলার থেকে ব্যাটসম্যান হওয়ার। মিডল অর্ডারের ব্যর্থতা সত্ত্বেও নিখাদ বোলার বলে ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন তিনি। বল্গ্যাক ক্যাপসদের হয়ে ৩৫ টেস্ট খেলা এ ডানহাতিকে শেষ পর্যন্ত আর আউট করতে পারেনি পাকিস্তানের বোলাররা। বলা বাহুল্য, ৬ বাউন্ডারি ও ১ ওভার বাউন্ডারির উন্মাদনা ছড়িয়ে ৬৮ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে 'ব্যাটসম্যান' হওয়ার ইচ্ছাপূরণের আনন্দে মেতেছিলেন এই কিউই মিডিয়াম পেসার!
আরনেস্ট বার্ট ভগলার-৬২* প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড
দক্ষিণ আফ্রিকার বার্ট ভগলারের কীর্তিই রেকর্ডের পাতায় টিকে ছিল সবচেয়ে বেশিদিন, প্রায় সত্তর বছর! ১৯০৬ সালে ইংলিশ বোলারদের ওপর ব্যাটিং বুলডোজার চালিয়েছিলেন সবার শেষে ব্যাট করতে নেমে। কেপটাউনের ওই টেস্টের গল্পটা এরকম_ ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং বিপর্যয়ের শিকার, ১৮৭ রানে অল আউট। প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়াদের কেউই পারছিলেন না লম্বা ইনিংস খেলতে। তাই শেষ পর্যন্ত ভগলারকেই খেলতে হলো 'সবর্োচ্চ ইনিংস'! ওই টেস্টের প্রথম ইনিংসে টপ অর্ডারের ব্যর্থতার মিছিলে শামিল না হয়ে লোয়ার অর্ডারের টি স্নোক করেছিলেন ৬০ রান। কিন্তু ৫ চার ও ৩ ছয়ে মোড়ানো ৬২ রানের অপরাজিত ইনিংস উপহার দিয়ে স্নোককেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ভগলার। কেপটাউনে ইনিংস ও ১৬ রানের ব্যবধানে জিতেছিল প্রোটিয়ারা।
গেল্গন ম্যাকগ্রা-৬১, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড
১২৪ টেস্টে ৫৬৩ উইকেট। ২৫০ ওয়ানডেতে উইকেট ৩৮১টি। এটুকু পড়ার পর গেল্গন ম্যাকগ্রাকে কেউ 'ব্যাটসম্যান' বলার দুঃসাহস করবেন না নিশ্চয়! কিন্তু ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার সৌন্দর্যে মোড়ানো। কে, কখন ঝানু বোলার থেকে পাকা ব্যাটসম্যান বনে যায়, কে জানে? ব্রিসবেন টেস্টে নিউজিল্যান্ড বোলারদেরও জানা ছিল না 'ব্যাটসম্যান' ম্যাকগ্রার কথা। মাইকেল ক্লার্ক (১৪১), অ্যাডাম গিলক্রিস্টের (১২৬) ব্যাটের পিটুনিতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিস মার্টিন, কাইল মিলসরা। ক্লার্ক-গিলির পর ১১ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে মার্টিনদের আচ্ছামতো পেটালেন ম্যাকগ্রাও। সফরকারী বোলারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ৫ চার ও ১ ছক্কায় তুলে নিলেন ৬১ রান। ২০০৪ সালের ওই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ১৫৬ রানে জিতেছিল। 'পেসার ম্যাকগ্রা' পরে নিয়েছিলেন ৩টি কিউই উইকেট।
ওয়াসিম বারি-৬০*
প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ
অ্যান্ডি রবার্টস, কলিন ক্রফট, জোয়েল গার্নারের মতো কিংবদন্তিরা সেদিন ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইনআপে। ক্যারিবীয় এ ত্রয়ীর বোলিংয়ের উত্তাপ ওই টেস্টে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল পাকিস্তানের ব্যাটিং মহারথীরাও। প্রথম ইনিংসে ৪৩৫ রান তুললেও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৮ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বসেছিল পাকিস্তান। মানে মাজিদ খান (২৮), সাদিক মোহাম্মদ (৯), আসিফ ইকবাল (০), জাভেদ মিয়াঁদাদ (১) কেউই ধোপে টেকেননি। এমন দুঃসময়ে রবার্টস-ক্রফট-গার্নারদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ওয়াসিম বারি! ১১০ বল টিকে ছিলেন, ছক্কা না পেটালেও ক্যারিবীয় বোলারদের মাঠছাড়া করেছিলেন ১০ বার। এমনকি ড্রেসিংরুমে বারি ফিরেছিলেন অপরাজিত ৬০ রানের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে! ১১ নম্বরে দাপুটে ব্যাটিং করাদের নিয়ে গল্পের এ পাতাটা লেখা হয়েছিল বেশিদিন আগে নয়_ ১৯৭৭ সালে, ব্রিজটাউন টেস্টে।