1
Story, Article & Poetry / এলিস মুনরোর গল্প: নিশুতি অনুবাদ নুসরাত সুলতানা
« on: July 17, 2017, 11:57:19 AM »
আমার ছোটবেলার কথা বলছি। সে সময় আমাদের এলাকার কেউ প্রসব ব্যাথা বা অ্যপেন্ডিক্সের ব্যাথার ছটফট্ করছে কিংবা হঠাৎ কারো কোনো ভয়াবহ শারিরীক অসুস্থতা, অথচ বাইরে তুষার ঝড় হচ্ছে না এমন কখনো হয়েছে আমার মনে পড়ে না। রাস্তা বন্ধ, গাড়ী চলার প্রশ্নই ওঠে না। রুগী শহরের হাসপাতালে নেবার জন্য তখন ঘোড়াই ছিল একমাত্র ভরসা। ভাগ্যিস তখনও সহজেই ঘোড়া পাওয়া যেত আশেপাশে।
স্বাভাবিকভাবেই আমার পেটের একপাশে যখন ব্যাথা শুরু হল তখন রাত এগারটা এবং বাইরে চলছে তুষার ঝড়ের তান্ডব। আমরা কোন ঘোড়া পালতাম না, তাই প্রতিবেশীদের ডেকে তুলতে হল ঘোড়ায় করে আমাকে হাসপাতালে নেবার জন্য। রাস্তা মোটে দেড় মাইল কিন্তু সে রাস্তা পাড়ি দেয়া এক অভিযান যেন। হাসপাতালে ডাক্তার অপেক্ষা করছিল আগে থেকেই এবং সবাই যেমন ভেবেছিল তেমনই হল। তোড়জোড় শুরু হল আমার অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের।
মাঝে মাঝে ভাবি, সে সময় কি এরকম আরো অ্যপেন্ডিক্স অপারেশন হত? এখন যে প্রচুর হয় তা জানি, এমনকি একজনের কথা জানি যার অপারেশনটা ঠিক সময় না হওয়াতে তাকে বাঁচানোই যায়নি। তবে আমার যতধুর মনে পড়ে আমার বয়সের কারো কারো এই অপারেশনটা করাতে হত। সংখ্যায় খুব একটা বেশী ছিল না যদিও। আর মনে হয় খুব একটা অপ্রত্যাশিত বা দুঃখজনকও ছিল না কারণ অপারেশনটা হওয়া মানেই ছিল স্কুল থেকে ছুটি। আবার ব্যাপারটার সাথে এক ধরনের মর্যাদা যুক্ত ছিল– অন্যদের চেয়ে আলাদা একটা অবস্থান পাওয়া। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার স্বস্তি।
আর বাকী সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটার একধরনের তৃপ্তি ছিল যেন।
অ্যপেন্ডিক্সবিহীন আমি বেশ কিছু দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকলাম, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম চিরহরিৎ গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া বিষণ্ন পথটা জুড়ে বরফ পড়ার দিকে। এই বিশেষ বিলাসিতার টাকাটা বাবা কোত্থেকে জোগাড় করবে সেটা চিন্তা বোধ হয় একবারও আমার মাথায় আসেনি। (আমার ধারণা বাবা দাদার খামার থেকে যে কাঠগুলো নিয়ে এসেছিল সেগুলো বিক্রি করে হাসপাতালের খরচটা মিটিয়েছিল। কাঠগুলো বাবা অনেকদিন রেখে দিয়েছিল। হয়ত ভেবেছিল ফাঁদ বানাবে। কাঠগুলোকে ঘিরে একটা নষ্টালজিয়া কাজ করত বাবার।)
এক সময় আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, শরীর চর্চার ক্লাস থেকে ছুটি পেতে লাগলাম যতদিন প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশী দিন পর্যন্ত। সেরকমই এক শনিবারে রান্নাঘরে শুধু আমি আর মা ছিলাম। মা বলল, অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের সময় শুধু অ্যপেন্ডিক্সটাই নয়, আমার শরীর থেকে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে আরও কিছু। অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তার নাকি অ্যপেন্ডিক্স নয়, চিন্তিত হয়ে পড়েছিল অন্য একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেকে। একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, মা বলেছিল, আকারে একটা টার্কীর ডিমের সমান।
তবে ভয়ের কিছু নেই, মা বলেছিল, এখন আর নেই ওটা।
একবারের জন্যও ক্যান্সারের চিন্তা আমার মাথায় আসেনি আর মাও কখনো ক্যান্সারের কথা উল্লেখ করেছে বলে মনে পড়ে না। মনে হয় না আজকাল আর ওরকম একটা কিছু খুঁজে পাবার পর সেটাকে না খুঁচিয়ে, সেটা ক্যান্সার নাকি ক্যান্সার নয়। সেটা না জেনে এরকম করে ছেড়ে দেয়া সম্ভব। ক্ষতিকর নাকি নিরীহ সেটা এক নিমেষেই জানতে চাই আমরা। আমার অপারেশনের পর আমরা যে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে সেদিনে ক্যান্সার শব্দটিকে ঘিরে থাকা ধোঁয়াশা, যেমন ধোঁয়াশা ছিল যৌনতা শব্দটিকে ঘিরে। আসলে তার চেয়েও খারাপ। যৌনতা নিয়ে আলাপ করাটা জঘন্য ছিল তবে এর কোথাও অন্য ধরনের মজা ছিল অবশ্যই ছিল, আমরা জানতাম, যদিও আমাদের মায়েরা ভাবত আমরা অতশত বুঝিনা– আর ক্যান্সার শব্দটাই এমন ঘিনঘিনে, পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত প্রানীর কথা মনে করিয়ে দিত সেটা হয়ত পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেবার সময়ও কেউ একবার তাকিয়ে দেখতে চাইবে না।
সুতরাং আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি এবং আমাকেও কিছু বলা হয়নি। তখন শুধু ধরে নিতে পারি জিনিসটা ক্ষতিকর প্রজাতির ছিল না অথবা সেটা খুব অভিজ্ঞ হাতে অপসারণ করা হয়েছিল আর সেজন্যই আজ এখানে দিব্যি আছি আমি। এই জিনিসটাকে সারা জীবনই অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়েছি আমি। যতবারই আমার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে যে আমার কি কি অপারেশন হয়েছে, আমি শুধু অ্যপেন্ডিক্সের নামই বলেছি।
যতদূর মনে পড়ে, মা’র সাথে আমার এসব কথা হয়েছিল ইন্টারের ছুটিতে, খাড়িগুলো বইছে প্রবল বেগে। ঝকঝকে গ্রীষ্ম ধীর পায়ে প্রবেশ করছে। ওখানকার আবহাওয়া কালক্ষেপন করতে জানত না, জানত না কৃপা করতেও।
জুনের শুরুর উষ্ণ দিনগুলোতে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়ে গেলাম, বরাবরই বেশ ভাল নম্বর পাওয়াতে আমাকে ফাইনাল পরীক্ষা থেকে অব্যহতি দেয়া হল। বেশ সুস্থ সবল ছিলাম, ঘরের কাজ করতাম, বই পড়তাম আগের মত, কেউ জানত না ভেতরে ভেতরে একটা সমস্যা চলছিল আমার।
এখানে আমাকে একটু বলে নিতে হবে আমরা কে কোথায় ঘুমাতাম। আমি আর আমার বোন একই ঘরে থাকতাম ছোট একটা ঘরে, দু’টো বিছানা পাশাপাপশি ফেলা সম্ভব নয় তাই একটা মই লাগানো দোতলা খাট দেয়া হল। যে উপরে ঘুমাবে সে মই দিয়ে উপরে উঠে যাবে। আমিই উপরে ঘুমাতাম। যখন আরও ছোট ছিলাম, অন্যদের জ্বালাতন করতে অনেক মজা লাগত, তখন তোষকের কোনা তুলে উপর থেকে থুথু ফেলব বলে ছোট বোনকে ভয় দেখাতাম। ও অসহায়ভাবে নিচের বিছানায় শুয়ে থাকত। অবশ্য আমার বোন– ওর নাম ক্যাথেরিন– মোটেও অসহায় ছিল না। ও লেপের ভেতর ঢুকে যেত। আমার মজাটা ছিল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা, দম বন্ধ হয়ে আসলে কিংবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাড়া শব্দ না পেয়ে যেই ও মাথা বের করত অমনি থুথু মারা কিংবা থুথু মারার নিখুঁত অভিনয় করে ওকে রাগিয়ে দেয়া।
এসব ছেলেমানুষি করার বয়স অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আমার বোন তখন নয় আর আমি চৌদ্দ। আমার সাথে আমার বোনের সম্পর্ক এক এক সময় এক এক রকম। আমি যখন ওকে জ্বালাতন করতাম না বা ওর পিছু লাগতাম না তখন আমি বনে বসতাম ভীষণ বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন এক উপদেষ্টা অথবা ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প বলে ওর চুল খাড়া করে দেওয়ার দায়িত্ব নিতাম। মাঝে মাঝে ওকে মা’র পুরানো, বাতিল করে দেয়া কিছু কাপড় পরাতাম, বেশ জমকালো কিন্তু সেকেলে। মা’র পুরানো পাউডার আর রুজ দিয়ে ওকে সাজিয়ে বলতাম, ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। ক্যাথেরিন সুন্দর ছিল, কোন সন্দেহ নেই। তবে আমার মেকাপে ওকে বিদেশী ভূতুড়ে পুতুলগুলোর মত দেখাত।
তার মানে এই নয় যে ওর ওপর সারাক্ষণ ছড়ি ঘুরাতাম আমি। এমনকি আমরা যে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম তাও নয়। ওর নিজের বন্ধু বান্ধব ছিল, নিজের খেলাও। ওর খেলাগুলো বেশীর ভাগই ছিল ঘর গেরস্থালী সংক্রান্ত। পুতুলদের খেলনা গাড়ীতে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে পুতুল নয়, বেড়াল ছানাদের কাপড় চোপড় পরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেত। আবার অন্য একটা খেলাও খেলত ওরা। একজন মাস্টার সেজে অন্য একজনকে শাস্তি দিত অবাধ্যতার জন্য। যে শাস্তি পেত সে মিথ্যামিথ্যি কাঁদত।
জুন মাসে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়েছিলাম, আগেই বলেছি। সে সময়টা আমি বেশ একা থাকার সুযোগ পেতাম, এমনটা আগে কখনও হয়নি। বাড়ির কিছু কাজ আমি করতাম তবে মা সম্ভবত তখনও বেশ সুস্থই ছিল, বেশীর ভাগ কাজ নিজেই করতে পারত। অথবা আমাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা ছিল ফলে কাজ করার জন্য লোক ভাড়া করতে পারতাম আমরা। গ্রীষ্মের শেষ দিকে যখন আমি নিজেই বাড়িটা পরিপাটি রাখার চেষ্টা করত তখনও তেমন কোনো কাজ খুঁজে পেতাম না আমি। আমার জন্য কোনো কাজ কেউ ফেলে রাখত না। সেই রহস্যময় টার্কীর ডিমটা নিশ্চয় আমাকে একটা মেকি পদমর্যাদা দিয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ কিছুটা সময় মেহমানের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারতাম।
এর ফলে যে বিশাল কিছু করে ফেলেছিলাম আমি তা কিন্তু নয়। আমাদের পরিবারে সেরকম বিশাল কিছু করে ফেলার কোন নজিরই নেই। সবকিছুই ছিল খুব অন্তর্মুখী এমনই একটা অদ্ভুত আর অকেজো অনুভূতি হত আমার নিজের সম্পর্কে। সবসময়ই যে অকেজো মনে হত তাও অবশ্য না। আমার মনে আছে, গাজর ক্ষেতে বসে নুয়ে নুয়ে নতুন গজানো গাজর গাছ তুলে নিতাম আমি, যেমন প্রতি বসন্তেই করতে হয়, গাজড়গুলো যেন ভাল বাড়তে পারে। বেশ কাজে আসতাম আমি তখন, দিনে যে সময়টাতে আমার একদমই কিছু করার থাকত না তখনই শুধু আমার ওরকম মনে হত।
একারণেই সম্ভবত আমার ঘুমের সমস্যা শুরু হল। প্রথম প্রথম সমস্যাটা ছিল মাঝরাত পর্যন্ত জেগে শুয়ে থাকা আর ভাবা আমি কেমন তরতাজা হয়ে জেগে আছি আর বাড়ির বাকী সবাই কি ঘুমটাই না ঘুমাচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম, এক সময় ক্লান্ত হয়ে বাতি নিভিয়ে দিতাম। কেউ আমাকে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও বলত না। জীবনে এই প্রথম (এবং এটাও সম্ভবত টার্কীর ডিমের পদমর্যাদার কারনে) আমাকে নিজে নিজে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দেয়া হল।
দিনের আলোতে উজ্বল আর তারপর বেশ রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে থাকা বাড়ীটা বদলে যেতে বেশ খানিকটা সময় নিত। সারাদিনের এলোমেলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, সব কাজ শেষ করা, কিছু কাজ অসমাপ্ত রাখা বাড়িটা একটা অদ্ভুত জায়গা হয়ে উঠত যেখানে তার উপর কর্তৃত্ব করা কোনো মানুষ বা কর্মযজ্ঞ থাকত না, তার কোন ব্যবহারও থাকত না যেন, আসবাবগুলোর অস্তিত্বও বোঝা যেত না ওদেরকে কারো প্রয়োজন হত না বলে।
তোমাদের মনে হতে পারে, এ তো মুক্তি! প্রথম প্রথম হয়ত তাই ছিল। স্বাধীনতা, বিস্ময়। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল আর আমার নিদ্রাহীন রাত লম্বা হতে হতে ভোর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল, আমি ততই ব্যাপারটাতে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমি, প্রথমত নিজেকে এবং আমার ইচ্ছেটাকেও ঘুম পাড়ানোর জন্য, প্রথমে ছড়া তারপর কবিতা বলতে শুরু করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করতে শুরু করল। শব্দগুলো এতটাই এলোমেলো আর অর্থহীন ছিল যে আমার মনে হত আমি নিজেই নিজেকে ব্যাঙ্গ করছি।
আমি যেন ঠিক আমি ছিলাম না।
আমি সারা জীবন বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে একথা শুনে এসেছি, কখনোই ভেবে দেখিনি এর মানে কি হতে পারে।
তাহলে, তোমার কি মনে হয়, তুমি কি?
একথাও আমি শুনে আসছি, কখনো ভীতিকর মনে হয়নি, খুব আটপৌরে একটা বিদ্রুপই ধরে নিয়েছিলাম কথাটাকে।
এখন নতুন করে ভাবতে হবে।
ততদিনে আমি ঘুমের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি বুঝে ফেলেছিলাম ঘুম আর সহজে আসবে না। হয়ত আমি ঘুমাতে চাইতামও না। কিছু একটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছিল, সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম আমি। খুব যুদ্ধ করতাম ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে। তা করার মত জ্ঞান হয়ত সামান্যই ছিল আমার। জিনিসটা যাই হোক, সেটা আমাকে নানান কিছু করতে বলত কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না বলার, শুধু করা সম্ভব কিনা সেটা যাচাই করাই ছিল উদ্দেশ্য। আমাকে সে জানিয়ে দিচ্ছিল উদ্দেশ্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মেনে নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কি অদ্ভুত। কারো উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য নয়, কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণেও নয়। শুধুমাত্র তুমি বিষয়টা ভেবেছিলে বলেই ভাবনাটার কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিৎ।
এবং বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবতাম। যতই ভাবনাটা দূরে সরাতে চাইতাম ততই যেন সেটা ঘিরে ধরত আমাকে। কোনো প্রতিহিংসা বা ঘৃণা নয়– যেমনটা আগেই বলেছি, কোনো বিশেষ কারন নেই, শুধু একটা শীতল গভীর ভাবনা, সেটাকে ঠিক তাড়নাও বলা যায় না। একটা ধ্যানের মত ভাবনা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করত। ভাবনাটাকে আমার প্রশ্রয় না দেয়াই উচিৎ ছিল কিন্তু আমি ডুবে থাকতাম এই ভাবনায়।
ভাবনাটার অস্তিত্ব ছিল আমার চারপাশে, মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরত সে।
আমার মাথায় ঘুরত আমার ছোট বোনকে গলা টিপে মেরে ফেলার চিন্তা। আমার ছোট বোন যে দোতলা খাটে আমার নিচে শুয়ে ঘুমাতো আর এই পৃথিবীতে যাকে আমি ভালবাসতাম সবচেয়ে বেশী। আমি কোনো হিংসা, প্রতিহিংসা কিংবা রাগ থেকে এমন ভাবতাম না, এক ধরনের বিকার ছিল এটা, যেটা হয়ত আমার ঠিক পাশেই শুয়ে থাকত রাতের বেলা। বিকারটা স্বভাবে এমন কিছু হিংস্রও ছিল না, বরং বলা যায় খানিকটা বিদ্রুপ করত যেন ওটা। একটা আলসে, ঢিলেঢালা, বিদ্রুপভরা প্রস্তাব যেটা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল। যেন বলত, কেন নয়? সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা করে দেখই না কি হয়।
সবচেয়ে খারাপ। এ বাড়ীর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমাদের ঘরটা, যেখানে আমরা ঘুমিয়েছি সারা জীবন আর নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেছি এখানে। আমি হয়ত একদম অকারণেই কাজটা করতাম, আমি বা অন্য যে কেউই সেটা বুঝত, শুধু বুঝত না যে আমি কোনো ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
আমি প্রথমে উঠে বসতাম, বিছানা থেকে নামতাম, তারপর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে বাইরে চলে যেতাম, বিছানার ধাপগুলো বেয়ে নামার সময় আমি ভুলেও একবারের জন্যও আমার বোনের দিকে তাকাতাম না। এরপর নিঃশব্দ সিড়ি বেয়ে সোজা নিচে। সেখানে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই, রান্নাঘরে ঢুকে যেতাম সোজা। রান্নাঘরটা আমার ভীষণ চেনা ছিল, কোনো আলো ছাড়াই রান্নাঘর পেরিয়ে যেতে পারতাম সহজেই্ রান্নাঘরের বাইরের দরজায় তালা দেয়া হত না, ওই দরঝার চাবিটা আমাদের কাছে ছিল কিনা সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। একটা চেয়ার কাত করে দরজার হাতলের নিচে ঠেস দিয়ে রাখা হত যাতে বাইরে থেকে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই চেয়ার পড়ে একটা বিকট শব্দ হয়। ধীরে, নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে ফেলতে আমার কোনো সমস্যাই হত না।
প্রথম রাতের পর থেকে আমাকে একবারের জন্যও কোথাও থামতে হত না। তাই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে আমার লাগত কয়েকটা নির্ঝঞ্জাট সেকেন্ড মাত্র।
এ অঞ্চলে রাস্তায় কোন বাতি ছিল না, শহর থেকে অনেক দূরে থাকতাম আমরা।
সবকিছুই কেমন বড় মনে হত অন্ধকারে। আমাদের বাড়ীর চারপাশে যে গাছগুলো ছিল তাদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ নামে ডাকতাম আমরা– বীচ গাছ, এল্ম্ গাছ, ওক গাছ, শুধু মেপলের বেলায় ছিল গাছগুলো, কারণ ওরা সব গায়ে গা লাগিয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের সবাইকে সে সময় ভীষণ কালো দেখাত। সাদা লাইলাক (ফুল ছিল না যদিও) আর বেগুনী লাইলাকের গাছটাকেও ঝোপ না বলে লাইলাক গাছই বলতাম আমরা, আকারে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল বলে।
বাড়ীর পূর্ব পাশ আর পশ্চিম পাশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো জগৎ দেখা যেত, অন্তত আমার চোখে তেমনই দেখাতো। পূর্ব দিকটা ছিল শহরের দিকে, যদিও শহরের কিছুই দেখা যেত না। দু’মাইল দূরে শহর–সারি বাঁধা বাড়ি, রাস্তায় বাতি আর কল খুললেই পানি, যদিও এবারের কিছুই দেখা যেত না, আগেই বলেছি। তবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একটা মৃদু আলোর আভা দেখা যেত কিনা সেটা নিশ্চিত বলতে পারছি না।
পশ্চিমে নদীর দীর্ঘ বাঁকটা, মাঠ আর গাছ, সূর্যাস্তের দৃশ্যে ছেদ ফেলার মত কিছুই ছিল না। এপাশে শুধুই প্রকৃতি, মানুষের হাত পড়েনি, প্রাত্যহিক জীবনের কোলাহলের কোনো চিহ্নও ছিল না এদিকটায়।
আমি হাঁটতে থাকতাম প্রথমে বাড়ীর কাছে কাছে তারপর দৃষ্টি একটু পরিস্কার হয়ে আসলে যখন আত্মবিশ্বাস জন্মাতো যে পাম্পের হাতল কিংবা কাপড় শুকানোর রঙের সাথে ধাক্কা খাব না, তখন ঝুঁকি নিতাম এদিক সেদিক যাবার। এক সময় পাখীদের নড়াচড়া শুরু হত গাছে গাছে, কিছুক্ষণ পর কিচির মিচির। যে সময় পাখীরা জাগে বলে আমার ধারণা ছিল আসলে তার অনেক আগে ওদের সকাল হয়। তবে আকাশ কিন্তু খানিকটা ফর্সা হয়ে যায় প্রথম পাখীর ডাকের পরপরই। আর ঠিক সে সময় হঠাৎ করেই রাজ্যের ঘুম আসত আমার চোখ জুড়ে। আমি ঘরে ফিরে যেতাম, ভেতরটা হঠাৎ খুব অন্ধকার মনে হত, আর আমি খুব নিপুন হাতে, সাবধানে, নিঃশব্দে চেয়ারটা দরজার হাতলের নিচে কাত করে ঠেস দিয়ে রেখে দিতাম। তারপর দোতলায় উঠে যেতাম কোনো শব্দ না করে, দরজা আর সিড়িগুলো সতর্কভাবে ডিঙিয়ে যেতাম আমি যদিও দেখে মনে হত প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। আমি সোজা গিয়ে আমার বালিশের উপর পড়তাম আর বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম– দেরী বলতে আমাদের বাড়ীতে খুব জোর আটটা কি সাড়ে আটটা।
রাতের সব ঘটনা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারতাম কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভীষণ অবাস্তব মনে হয়–ভয়ংকর ঐ চিন্তাটা সত্যিই এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে দিনের বেলা এর কোন প্রভাবই আমার উপর থাকত না। আমি ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আমার ভাই আর বোন স্কুলে চলে যেত কিন্তু টেবিলে তখনও ওদের নাস্তার প্লেটগুলো পড়ে থাকত, দু’একটা সিরিয়ালের টুকরো ভাসতে থাকত বাড়তি দুধটুকুর মধ্যে।
অবিশ্বাস্য। বোন স্কুল থেকে ফিরলে আমরা দুজন হ্যামকের দু’দিকে মাথা দিয়ে দোল খেতাম।
এই হ্যামকে দোল খেতেই আমার দিনের অনেকটা সময় কাটত, একারণেই হয়ত আমার রাতে ঘুম আসতে চাইত না। রাতে ঘুম না আসার বিষয়টা নিয়ে আমি কারো সাথে কথাও বলিনি, আর আমাকেও তাই কেউ বলেনি যে দিনে একটু কাজ কর্ম করলে রাতে ঘুমটা ভাল হয়।
আমার সমস্যাটা সঙ্গে করে নিয়ে রাত আসত। পিশাচগুলো আমাকে পেয়ে বসত আবার। খুব দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত বোধটুকু থাকত আমার। আমি একবারের জন্যও ভাবার চেষ্টা করতাম না যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কিংবা খুব চেষ্টা করলে আমি ঘুমিয়ে যেতে পারব। খুব সাবধানে আমি বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতাম। অন্ধকারে চলাফেরায় আরও পরাদর্শী হয়ে উঠেছিলাম আমি, ঘরের ভেতরটা আরও স্পষ্ট দেখতে পেতাম, আরও অচেনা, রান্না ঘরের পাল্লার কুকুরে চিবানো অংশটা–সব যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম। একটা কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একটা বালি দিয়ে খেলার জায়গা ছিল, উঠানে জায়গাটা এমনভাবে বানানো ছিল যাতে মা উত্তরের জানালা দিয়ে আমার উপর নজর রাখতে পারে কাজ করতে করতে, এখন একটা স্পাইরিয়ার ঝোপ অবাধ্যভাবে বেড়ে উঠে জায়গাটা একদম ঢেকে দিয়েছে।
রান্নাঘরের পূর্ব দিকের দেয়ালে কোনো জানালা ছিল না। একটা দরজা ছিল যেটা খুললেই এক সারি সিড়ি, ওখানে দাঁড়িয়ে আমরা বড় বড় ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দিতাম, আবার শুকিয়ে গেলে ওগুলো ধরে ঝুল খেতাম আর ধোয়া কাপড়ের টাটকা গন্ধ নিতাম– সে সাদা বিচানা চাদরই হোক বা কালো ওভারঅল।
রাতে হেঁটে বেড়ানোর সময় কখনো কখনো আমি সিড়িগুলোর কাছে একটু থামতাম। বসতাম না, শহরের দিকটা একটু ভালভাবে দেখতে পেতাম ওখান থেকে, হয়ত শহুরে সভ্যতার বাতাস একটু গায়ে মাখতে চাইতাম।
এক রাতে– ঠিক বলতে পারব না আমার রাত জেগে হেঁটে বেড়ানোর বিশতম রাত নাকি দ্বাদশ রাত নাকি অষ্টম বা নবম– আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম কোনের দিকে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, ততক্ষণে আমার গতি কমানোর আর সময় নেই। কে যেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, সোজা হেঁটে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলেও তখন ধরা পড়ে যেতাম। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার চেয়ে বরং মুখোমুখী হওয়াই ভাল।
কে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে ? আমার বাবা। বাবাও সিড়ির উপর বসে শহরের দিকে আর প্রায় অদৃশ্য শহরে আলোর আভার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবা দিনের পোশাকই পড়ে ছিল— গাঢ় রংয়ের প্যান্ট, শার্ট আর বুট। সিগারেট ফুকছিল বসে, নিজের হাতে বানানো সিগারেট। হয়ত সিগারেটের গন্ধই আমাকে অন্য কারো ……
তামাকের গন্ধ থাকত সব জায়গায়, ঘরের ভেতরে, বাইরেও। আলাদা করে সেটা টের পাবার সম্ভাবনা কমই ছিল।
বাবা বলল, সুপ্রভাত, যেটা বলাটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে তবে ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। আমাদের পরিবারে আমরা এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় একদমই অভ্যস্ত ছিলাম না। কোনো বৈরী সম্পর্কের কারণে নয়, বরং যেখানে সারাদিনই সবার সাথে সবার দেখা হচ্ছে সেখানে এরকম ঘটা করে সম্ভাষণ বিনিময়টা অপ্রয়োজনীয় মনে করা হত।
আমিও সুপ্রভাত জানালাম বাবাকে। সময়টা তখন নিশ্চয় সকালের খুব কাছাকাছি তা না হলে বাবা এরকম পোশাকে থাকত না। আকাশও ততক্ষণে নিশ্চয় ফর্সা হতে শুরু করেছিল কিন্তু ঘন গাছের সারির জন্য ভাল বোঝা যাচ্ছিল না। পাখিদের ডাকাডাকিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনই আমি আগের দিনের চেয়ে বেশী সময় বাইরে কাটাচ্ছিলাম, প্রথম দিকে যেমন ভাল লাগত সেরকম কিন্তু আর লাগছিল না, যে সম্ভাবনাটা এক সময় শুধু শোবার ঘরেই বাস করত, শুধু দোতলা বিছানায়, সেটা ধীরে ধীরে ঘরের প্রতিটি কোনায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।
এখন যখন সেদিনের কথা চিন্তা করি, আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন বাবা কাজের পোশাক পরে ছিল না সেদিন? পোশাক দেখে মনে হচ্ছিল বাবা কোনো প্রয়োজনে শহরে যাবে। সেদিন সকালের প্রথম কাজটাই ছিল শহরে যাওয়া।
আমি আর হেঁটে বেড়াতে পারলাম না, কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটল আমার ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের।
“ঘুমের সমস্যা হচ্ছে ? বাবা বিজ্ঞেস করল।
আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, না। কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হল রাতভর হেঁটে বেড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করাটা কতটা কঠিন হবে। তাই বললাম, হ্যাঁ।
বাবা বলল, “গ্রীষ্মের রাতে এরকম হতেই পারে। খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে গেলে আর যেই না মনে করলে এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাচ্ছ, অমনি ঘুমের আর দেখা নেই, তাই না?”
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বুঝতে পরলাম আমার বাড়ী থেকে বের হওয়া আর রাতভর হেঁটে বেড়ানোটা যে বাবা আজই হঠাৎ দেখতে পেল তা নয়। যার বাড়ির সীমানার ভেতরেই তার সব গরু, ছাগল আর ভেড়া যেগুলো কিনা তার রোজগারের ভিত্তি এবং যে তার ড্রয়ারে একটা হ্যান্ডগান রাখে, সিড়িতে সামান্যতম আওয়াজ বা দরজার হাতল ঘুরানোর সুক্ষ্ন শব্দও তার সজাগ কানকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
আমার না-ঘুমানো বিষয়ক আলোচনা এরপর কোনদিকে মোড় নেবে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাবা একরকম ঘোষণাই করল যে রাতে না ঘুমাতে পারাটা একটা ভীষণ যন্ত্রণা। কিন্তু আলোচনা কি এখানেই শেষ ? আমার কোনমতেই তাকে এর চেয়ে বেশী কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও আমাকে বুঝতে দিত যে এই ঘোষণাই আলোচনার শেষ না, যদি একটুও আভাস দিত যে পুরো বিষয়টা জানার জন্যই সে এসেছে, আমার মনে হয় না সে আমার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারত। নীরবতা ভাঙলাম আমিই, নিজের ইচ্ছায়, বললাম আমি ঘুমাতে পারি না। আমি বাধ্য হয়ে বাইরে এসে হেঁটে বেড়াই।
কেন?
আমি জানি না।
খারাপ স্বপ্ন দেখ না তো ?
না।
“বোকার মত প্রশ্ন করলাম”, বাবা বলল “ভাল স্বপ্ন তো আর তোমাকে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসত না”।
বাবা আমাকে সময় নেবার সুুযোগ দিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে চাইছিলাম কিন্তু যা না করে কেন যেন কথা বলতে শুরু করলাম। সত্যই বললাম সব, শুধু সামান্য একটু বদলে দিয়ে।
আমার ছোট বোনের কথা যখন বললাম, আমি বললাম, আমার ভয় হয় ওর কোনো ক্ষতি যদি করে ফেলি। আমার বিশ্বাস ছিল ওটুকু বলাই যথেষ্ট, কি ক্ষতি সেটা বাবা বুঝে নেবে।
“ওকে গলা টিপে মেরে ফেলি যদি”, আমি বলেই ফেললাম। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছিলাম না আমি।
এ কথা ফিরিয়ে নেবার আর সুযোগ নেই, একটু আগ পর্যন্ত যে মানুষটা ছিলাম আর কখনোই সে মানুষটা হতে পারব না আমি।
বাবা কথাটা শুনল। শুনল যে আমি মনে করি কোনো কারণ ছাড়াই আমি ছোট্ট ক্যাথেরিনকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি।
বাবা বলল, “আচ্ছা”।
এরপর বলল আমি যেন দুশ্চিন্তা না করি, বলল, “কখনও কখনও মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে”।
কথাগুলো বাবা বলল খুব গম্ভীরভাবে, গুরুত্ব দিয়ে, কোনো শঙ্কা বা বিস্ময় দেখা গেল না তার ভেতর। মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে কিংবা ভাবনা না বলে ভয় বলতে পার, কিন্তু এ নিয়ে ঘারড়াবার কিছু নেই, বলতে পার এটা একটা দুঃস্বপ্নের মত।
বাবা কিন্তু পরিস্কার করে বলল না যে আমার দ্বারা এরকম ভয়ংকর কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই। দেখে মনে হল বাবা বরং ধরে নিয়েছে এরকম কিছু ঘটতেই পারে না। এটা ইথারের জন্য হচ্ছে, বাবা বলল। তোমাকে হাসপাতালে ইথার দেয়া হয়েছিল। ধরে নাও এটা একটা স্বপ্ন, এর বেশী কিছু না। এরকম কিছুই কখনো ঘটবে না, যেমন কোনো উল্কা কখনোই আমাদের বাড়ির উপর এসে পড়বে না। (অবশ্যই পড়তে পারে কিন্তু এর সম্ভাবনা এতই কম যে সেটা ঘটতেই-পারে-না’র দলে পড়ে গেছে)।
এরকম চিন্তা করার জন্য বাবা আমাকে দোষারোপ করল না মোটেও। বিস্মিতও হল না একটুও।
বাবা অনেক কিছুই বলতে পারত। আমার বোনের ব্যাপারে আমার মনোভাব কেমন সেটা জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারত অথবা আমার জীবনে কোনো সমস্যা চলছে কিনা সেটা জানতে চাইতে পারত। যদি আজ এ ঘটনা ঘটত তবে বাবা হয়ত কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করত। (প্রজন্ম আর আয়-রোজগারের দৌড়ে এক ধাপ এগিয়ে এই আমি মনে হয় সন্তানের জন্য তাই করতাম)।
বাবার কৌশলটাও কিন্তু কাজ করল। আমি আমার আগের অবস্থানে ফেরৎ গেলাম কারো বিদ্রুপের স্বীকার বা শঙ্কার কারণ না হয়েই।
এরকম কিছু কিছু ভাবনার জন্ম হয় মানুষের মনে যেটা খুব ক্ষণস্থায়ী, হারিয়ে যায় অল্প ক’দিনের মধ্যেই, এসব নিয়েই তো জীবন।
তুমি যদি এ যুগের বাবা মা হও আর দীর্ঘদিন বেঁচে থাক তাহলে তুমি তোমার এমন কিছু ভুল হঠাৎ আবিস্কার করবে যেগুলো তুমি একেবারেই জানতে চাও না। আবার একই সাথে খুব ভালভাবে জান। কখনো কখনো তুমি নিজের কাছেই আবার কখনো কখনো ভীষণ বিরক্ত নিজের ওপরে। আমার বাবার এসবের কোনো বালাই ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত জানি, আমি যদি বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করতাম সে আমাকে বেল্ট দিয়ে পেটাত কেন, সে বলত, তোমার ভালর জন্যই। সেই বেদম মারগুলো বাবার মনে, যদি আদৌ তার মনে থেকে থাকে, তার মুখরা সন্তানকে শাসন করার উপযুক্ত ব্যবস্থা হিসেবেই থেকে গেছে, যে মুখরা সন্তানের সুখ-কল্পনা ছিল মুরগীর খোঁয়াড়গুলোর শাসক বনে বসেছে সে।
“নিজেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান মনে করছ তুমি”, বাবা হয়ত শাস্তির কারণ হিসেবে বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটাই উল্লেখ করত, আর সেসময়, সতিই, একথা প্রায়ই শোনা যেত বুদ্ধিমান বাচ্চাদের সম্পর্কে। ওদেরকে পিটিয়ে বুদ্ধির ভূত না ছাড়ালে নাকি ছেলেগুলোর বড় হয়ে নিজেদেরকে বুদ্ধিমান মনে করার সম্ভাবনা থেকে যেত, কিংবা বুদ্ধিমতী, যেমন আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল।
সে যাই হোক, সেদিন ভোরে আমার যা শোনার দরকার ছিল আমাকে ঠিক তাই বলেছিল বাবা আর খুব অল্প দিনের মধ্যে সবকিছু ভুলেও গিয়েছিলাম আমি।
আমি ভেবেছিলাম বাবা ভাল কাপড় চোপড় পরে আছে কারণ তাকে হয়ত সকাল সকাল ব্যাঙ্কে যেতে হবে, যেখানে তাকে শুনতে হবে, যদিও নতুন কিছু নয় সেটা যে ব্যাঙ্ক লোন আর বাড়ানো যাবে না। বাবা তার সাধ্যমত পরিশ্রম করেছে কিন্তু বাজারের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সংসার চালানোর জন্য তাকে নতুন কোনো উপায় খুঁজতে হবে আর একই সাথে ব্যাঙ্কের টাকাটা পরিশোধেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা বাবা হয়ত তখন জানতে পেরেছিল যে মায়ের ক্রমাগত শরীর কাঁপাটার একটা বিশেষ নাম আছে এবং সেটা আর কোনদিনই সারবে না অথবা বাবা অবিশ্বাস্য কোনো মহিলার প্রেমে পড়েছিল।
http://forum.daffodilvarsity.edu.bd/index.php?action=post;board=365.0
স্বাভাবিকভাবেই আমার পেটের একপাশে যখন ব্যাথা শুরু হল তখন রাত এগারটা এবং বাইরে চলছে তুষার ঝড়ের তান্ডব। আমরা কোন ঘোড়া পালতাম না, তাই প্রতিবেশীদের ডেকে তুলতে হল ঘোড়ায় করে আমাকে হাসপাতালে নেবার জন্য। রাস্তা মোটে দেড় মাইল কিন্তু সে রাস্তা পাড়ি দেয়া এক অভিযান যেন। হাসপাতালে ডাক্তার অপেক্ষা করছিল আগে থেকেই এবং সবাই যেমন ভেবেছিল তেমনই হল। তোড়জোড় শুরু হল আমার অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের।
মাঝে মাঝে ভাবি, সে সময় কি এরকম আরো অ্যপেন্ডিক্স অপারেশন হত? এখন যে প্রচুর হয় তা জানি, এমনকি একজনের কথা জানি যার অপারেশনটা ঠিক সময় না হওয়াতে তাকে বাঁচানোই যায়নি। তবে আমার যতধুর মনে পড়ে আমার বয়সের কারো কারো এই অপারেশনটা করাতে হত। সংখ্যায় খুব একটা বেশী ছিল না যদিও। আর মনে হয় খুব একটা অপ্রত্যাশিত বা দুঃখজনকও ছিল না কারণ অপারেশনটা হওয়া মানেই ছিল স্কুল থেকে ছুটি। আবার ব্যাপারটার সাথে এক ধরনের মর্যাদা যুক্ত ছিল– অন্যদের চেয়ে আলাদা একটা অবস্থান পাওয়া। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার স্বস্তি।
আর বাকী সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটার একধরনের তৃপ্তি ছিল যেন।
অ্যপেন্ডিক্সবিহীন আমি বেশ কিছু দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকলাম, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম চিরহরিৎ গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া বিষণ্ন পথটা জুড়ে বরফ পড়ার দিকে। এই বিশেষ বিলাসিতার টাকাটা বাবা কোত্থেকে জোগাড় করবে সেটা চিন্তা বোধ হয় একবারও আমার মাথায় আসেনি। (আমার ধারণা বাবা দাদার খামার থেকে যে কাঠগুলো নিয়ে এসেছিল সেগুলো বিক্রি করে হাসপাতালের খরচটা মিটিয়েছিল। কাঠগুলো বাবা অনেকদিন রেখে দিয়েছিল। হয়ত ভেবেছিল ফাঁদ বানাবে। কাঠগুলোকে ঘিরে একটা নষ্টালজিয়া কাজ করত বাবার।)
এক সময় আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, শরীর চর্চার ক্লাস থেকে ছুটি পেতে লাগলাম যতদিন প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশী দিন পর্যন্ত। সেরকমই এক শনিবারে রান্নাঘরে শুধু আমি আর মা ছিলাম। মা বলল, অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের সময় শুধু অ্যপেন্ডিক্সটাই নয়, আমার শরীর থেকে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে আরও কিছু। অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তার নাকি অ্যপেন্ডিক্স নয়, চিন্তিত হয়ে পড়েছিল অন্য একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেকে। একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, মা বলেছিল, আকারে একটা টার্কীর ডিমের সমান।
তবে ভয়ের কিছু নেই, মা বলেছিল, এখন আর নেই ওটা।
একবারের জন্যও ক্যান্সারের চিন্তা আমার মাথায় আসেনি আর মাও কখনো ক্যান্সারের কথা উল্লেখ করেছে বলে মনে পড়ে না। মনে হয় না আজকাল আর ওরকম একটা কিছু খুঁজে পাবার পর সেটাকে না খুঁচিয়ে, সেটা ক্যান্সার নাকি ক্যান্সার নয়। সেটা না জেনে এরকম করে ছেড়ে দেয়া সম্ভব। ক্ষতিকর নাকি নিরীহ সেটা এক নিমেষেই জানতে চাই আমরা। আমার অপারেশনের পর আমরা যে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে সেদিনে ক্যান্সার শব্দটিকে ঘিরে থাকা ধোঁয়াশা, যেমন ধোঁয়াশা ছিল যৌনতা শব্দটিকে ঘিরে। আসলে তার চেয়েও খারাপ। যৌনতা নিয়ে আলাপ করাটা জঘন্য ছিল তবে এর কোথাও অন্য ধরনের মজা ছিল অবশ্যই ছিল, আমরা জানতাম, যদিও আমাদের মায়েরা ভাবত আমরা অতশত বুঝিনা– আর ক্যান্সার শব্দটাই এমন ঘিনঘিনে, পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত প্রানীর কথা মনে করিয়ে দিত সেটা হয়ত পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেবার সময়ও কেউ একবার তাকিয়ে দেখতে চাইবে না।
সুতরাং আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি এবং আমাকেও কিছু বলা হয়নি। তখন শুধু ধরে নিতে পারি জিনিসটা ক্ষতিকর প্রজাতির ছিল না অথবা সেটা খুব অভিজ্ঞ হাতে অপসারণ করা হয়েছিল আর সেজন্যই আজ এখানে দিব্যি আছি আমি। এই জিনিসটাকে সারা জীবনই অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়েছি আমি। যতবারই আমার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে যে আমার কি কি অপারেশন হয়েছে, আমি শুধু অ্যপেন্ডিক্সের নামই বলেছি।
যতদূর মনে পড়ে, মা’র সাথে আমার এসব কথা হয়েছিল ইন্টারের ছুটিতে, খাড়িগুলো বইছে প্রবল বেগে। ঝকঝকে গ্রীষ্ম ধীর পায়ে প্রবেশ করছে। ওখানকার আবহাওয়া কালক্ষেপন করতে জানত না, জানত না কৃপা করতেও।
জুনের শুরুর উষ্ণ দিনগুলোতে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়ে গেলাম, বরাবরই বেশ ভাল নম্বর পাওয়াতে আমাকে ফাইনাল পরীক্ষা থেকে অব্যহতি দেয়া হল। বেশ সুস্থ সবল ছিলাম, ঘরের কাজ করতাম, বই পড়তাম আগের মত, কেউ জানত না ভেতরে ভেতরে একটা সমস্যা চলছিল আমার।
এখানে আমাকে একটু বলে নিতে হবে আমরা কে কোথায় ঘুমাতাম। আমি আর আমার বোন একই ঘরে থাকতাম ছোট একটা ঘরে, দু’টো বিছানা পাশাপাপশি ফেলা সম্ভব নয় তাই একটা মই লাগানো দোতলা খাট দেয়া হল। যে উপরে ঘুমাবে সে মই দিয়ে উপরে উঠে যাবে। আমিই উপরে ঘুমাতাম। যখন আরও ছোট ছিলাম, অন্যদের জ্বালাতন করতে অনেক মজা লাগত, তখন তোষকের কোনা তুলে উপর থেকে থুথু ফেলব বলে ছোট বোনকে ভয় দেখাতাম। ও অসহায়ভাবে নিচের বিছানায় শুয়ে থাকত। অবশ্য আমার বোন– ওর নাম ক্যাথেরিন– মোটেও অসহায় ছিল না। ও লেপের ভেতর ঢুকে যেত। আমার মজাটা ছিল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা, দম বন্ধ হয়ে আসলে কিংবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাড়া শব্দ না পেয়ে যেই ও মাথা বের করত অমনি থুথু মারা কিংবা থুথু মারার নিখুঁত অভিনয় করে ওকে রাগিয়ে দেয়া।
এসব ছেলেমানুষি করার বয়স অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আমার বোন তখন নয় আর আমি চৌদ্দ। আমার সাথে আমার বোনের সম্পর্ক এক এক সময় এক এক রকম। আমি যখন ওকে জ্বালাতন করতাম না বা ওর পিছু লাগতাম না তখন আমি বনে বসতাম ভীষণ বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন এক উপদেষ্টা অথবা ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প বলে ওর চুল খাড়া করে দেওয়ার দায়িত্ব নিতাম। মাঝে মাঝে ওকে মা’র পুরানো, বাতিল করে দেয়া কিছু কাপড় পরাতাম, বেশ জমকালো কিন্তু সেকেলে। মা’র পুরানো পাউডার আর রুজ দিয়ে ওকে সাজিয়ে বলতাম, ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। ক্যাথেরিন সুন্দর ছিল, কোন সন্দেহ নেই। তবে আমার মেকাপে ওকে বিদেশী ভূতুড়ে পুতুলগুলোর মত দেখাত।
তার মানে এই নয় যে ওর ওপর সারাক্ষণ ছড়ি ঘুরাতাম আমি। এমনকি আমরা যে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম তাও নয়। ওর নিজের বন্ধু বান্ধব ছিল, নিজের খেলাও। ওর খেলাগুলো বেশীর ভাগই ছিল ঘর গেরস্থালী সংক্রান্ত। পুতুলদের খেলনা গাড়ীতে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে পুতুল নয়, বেড়াল ছানাদের কাপড় চোপড় পরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেত। আবার অন্য একটা খেলাও খেলত ওরা। একজন মাস্টার সেজে অন্য একজনকে শাস্তি দিত অবাধ্যতার জন্য। যে শাস্তি পেত সে মিথ্যামিথ্যি কাঁদত।
জুন মাসে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়েছিলাম, আগেই বলেছি। সে সময়টা আমি বেশ একা থাকার সুযোগ পেতাম, এমনটা আগে কখনও হয়নি। বাড়ির কিছু কাজ আমি করতাম তবে মা সম্ভবত তখনও বেশ সুস্থই ছিল, বেশীর ভাগ কাজ নিজেই করতে পারত। অথবা আমাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা ছিল ফলে কাজ করার জন্য লোক ভাড়া করতে পারতাম আমরা। গ্রীষ্মের শেষ দিকে যখন আমি নিজেই বাড়িটা পরিপাটি রাখার চেষ্টা করত তখনও তেমন কোনো কাজ খুঁজে পেতাম না আমি। আমার জন্য কোনো কাজ কেউ ফেলে রাখত না। সেই রহস্যময় টার্কীর ডিমটা নিশ্চয় আমাকে একটা মেকি পদমর্যাদা দিয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ কিছুটা সময় মেহমানের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারতাম।
এর ফলে যে বিশাল কিছু করে ফেলেছিলাম আমি তা কিন্তু নয়। আমাদের পরিবারে সেরকম বিশাল কিছু করে ফেলার কোন নজিরই নেই। সবকিছুই ছিল খুব অন্তর্মুখী এমনই একটা অদ্ভুত আর অকেজো অনুভূতি হত আমার নিজের সম্পর্কে। সবসময়ই যে অকেজো মনে হত তাও অবশ্য না। আমার মনে আছে, গাজর ক্ষেতে বসে নুয়ে নুয়ে নতুন গজানো গাজর গাছ তুলে নিতাম আমি, যেমন প্রতি বসন্তেই করতে হয়, গাজড়গুলো যেন ভাল বাড়তে পারে। বেশ কাজে আসতাম আমি তখন, দিনে যে সময়টাতে আমার একদমই কিছু করার থাকত না তখনই শুধু আমার ওরকম মনে হত।
একারণেই সম্ভবত আমার ঘুমের সমস্যা শুরু হল। প্রথম প্রথম সমস্যাটা ছিল মাঝরাত পর্যন্ত জেগে শুয়ে থাকা আর ভাবা আমি কেমন তরতাজা হয়ে জেগে আছি আর বাড়ির বাকী সবাই কি ঘুমটাই না ঘুমাচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম, এক সময় ক্লান্ত হয়ে বাতি নিভিয়ে দিতাম। কেউ আমাকে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও বলত না। জীবনে এই প্রথম (এবং এটাও সম্ভবত টার্কীর ডিমের পদমর্যাদার কারনে) আমাকে নিজে নিজে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দেয়া হল।
দিনের আলোতে উজ্বল আর তারপর বেশ রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে থাকা বাড়ীটা বদলে যেতে বেশ খানিকটা সময় নিত। সারাদিনের এলোমেলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, সব কাজ শেষ করা, কিছু কাজ অসমাপ্ত রাখা বাড়িটা একটা অদ্ভুত জায়গা হয়ে উঠত যেখানে তার উপর কর্তৃত্ব করা কোনো মানুষ বা কর্মযজ্ঞ থাকত না, তার কোন ব্যবহারও থাকত না যেন, আসবাবগুলোর অস্তিত্বও বোঝা যেত না ওদেরকে কারো প্রয়োজন হত না বলে।
তোমাদের মনে হতে পারে, এ তো মুক্তি! প্রথম প্রথম হয়ত তাই ছিল। স্বাধীনতা, বিস্ময়। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল আর আমার নিদ্রাহীন রাত লম্বা হতে হতে ভোর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল, আমি ততই ব্যাপারটাতে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমি, প্রথমত নিজেকে এবং আমার ইচ্ছেটাকেও ঘুম পাড়ানোর জন্য, প্রথমে ছড়া তারপর কবিতা বলতে শুরু করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করতে শুরু করল। শব্দগুলো এতটাই এলোমেলো আর অর্থহীন ছিল যে আমার মনে হত আমি নিজেই নিজেকে ব্যাঙ্গ করছি।
আমি যেন ঠিক আমি ছিলাম না।
আমি সারা জীবন বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে একথা শুনে এসেছি, কখনোই ভেবে দেখিনি এর মানে কি হতে পারে।
তাহলে, তোমার কি মনে হয়, তুমি কি?
একথাও আমি শুনে আসছি, কখনো ভীতিকর মনে হয়নি, খুব আটপৌরে একটা বিদ্রুপই ধরে নিয়েছিলাম কথাটাকে।
এখন নতুন করে ভাবতে হবে।
ততদিনে আমি ঘুমের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি বুঝে ফেলেছিলাম ঘুম আর সহজে আসবে না। হয়ত আমি ঘুমাতে চাইতামও না। কিছু একটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছিল, সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম আমি। খুব যুদ্ধ করতাম ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে। তা করার মত জ্ঞান হয়ত সামান্যই ছিল আমার। জিনিসটা যাই হোক, সেটা আমাকে নানান কিছু করতে বলত কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না বলার, শুধু করা সম্ভব কিনা সেটা যাচাই করাই ছিল উদ্দেশ্য। আমাকে সে জানিয়ে দিচ্ছিল উদ্দেশ্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মেনে নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কি অদ্ভুত। কারো উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য নয়, কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণেও নয়। শুধুমাত্র তুমি বিষয়টা ভেবেছিলে বলেই ভাবনাটার কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিৎ।
এবং বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবতাম। যতই ভাবনাটা দূরে সরাতে চাইতাম ততই যেন সেটা ঘিরে ধরত আমাকে। কোনো প্রতিহিংসা বা ঘৃণা নয়– যেমনটা আগেই বলেছি, কোনো বিশেষ কারন নেই, শুধু একটা শীতল গভীর ভাবনা, সেটাকে ঠিক তাড়নাও বলা যায় না। একটা ধ্যানের মত ভাবনা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করত। ভাবনাটাকে আমার প্রশ্রয় না দেয়াই উচিৎ ছিল কিন্তু আমি ডুবে থাকতাম এই ভাবনায়।
ভাবনাটার অস্তিত্ব ছিল আমার চারপাশে, মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরত সে।
আমার মাথায় ঘুরত আমার ছোট বোনকে গলা টিপে মেরে ফেলার চিন্তা। আমার ছোট বোন যে দোতলা খাটে আমার নিচে শুয়ে ঘুমাতো আর এই পৃথিবীতে যাকে আমি ভালবাসতাম সবচেয়ে বেশী। আমি কোনো হিংসা, প্রতিহিংসা কিংবা রাগ থেকে এমন ভাবতাম না, এক ধরনের বিকার ছিল এটা, যেটা হয়ত আমার ঠিক পাশেই শুয়ে থাকত রাতের বেলা। বিকারটা স্বভাবে এমন কিছু হিংস্রও ছিল না, বরং বলা যায় খানিকটা বিদ্রুপ করত যেন ওটা। একটা আলসে, ঢিলেঢালা, বিদ্রুপভরা প্রস্তাব যেটা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল। যেন বলত, কেন নয়? সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা করে দেখই না কি হয়।
সবচেয়ে খারাপ। এ বাড়ীর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমাদের ঘরটা, যেখানে আমরা ঘুমিয়েছি সারা জীবন আর নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেছি এখানে। আমি হয়ত একদম অকারণেই কাজটা করতাম, আমি বা অন্য যে কেউই সেটা বুঝত, শুধু বুঝত না যে আমি কোনো ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
আমি প্রথমে উঠে বসতাম, বিছানা থেকে নামতাম, তারপর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে বাইরে চলে যেতাম, বিছানার ধাপগুলো বেয়ে নামার সময় আমি ভুলেও একবারের জন্যও আমার বোনের দিকে তাকাতাম না। এরপর নিঃশব্দ সিড়ি বেয়ে সোজা নিচে। সেখানে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই, রান্নাঘরে ঢুকে যেতাম সোজা। রান্নাঘরটা আমার ভীষণ চেনা ছিল, কোনো আলো ছাড়াই রান্নাঘর পেরিয়ে যেতে পারতাম সহজেই্ রান্নাঘরের বাইরের দরজায় তালা দেয়া হত না, ওই দরঝার চাবিটা আমাদের কাছে ছিল কিনা সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। একটা চেয়ার কাত করে দরজার হাতলের নিচে ঠেস দিয়ে রাখা হত যাতে বাইরে থেকে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই চেয়ার পড়ে একটা বিকট শব্দ হয়। ধীরে, নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে ফেলতে আমার কোনো সমস্যাই হত না।
প্রথম রাতের পর থেকে আমাকে একবারের জন্যও কোথাও থামতে হত না। তাই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে আমার লাগত কয়েকটা নির্ঝঞ্জাট সেকেন্ড মাত্র।
এ অঞ্চলে রাস্তায় কোন বাতি ছিল না, শহর থেকে অনেক দূরে থাকতাম আমরা।
সবকিছুই কেমন বড় মনে হত অন্ধকারে। আমাদের বাড়ীর চারপাশে যে গাছগুলো ছিল তাদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ নামে ডাকতাম আমরা– বীচ গাছ, এল্ম্ গাছ, ওক গাছ, শুধু মেপলের বেলায় ছিল গাছগুলো, কারণ ওরা সব গায়ে গা লাগিয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের সবাইকে সে সময় ভীষণ কালো দেখাত। সাদা লাইলাক (ফুল ছিল না যদিও) আর বেগুনী লাইলাকের গাছটাকেও ঝোপ না বলে লাইলাক গাছই বলতাম আমরা, আকারে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল বলে।
বাড়ীর পূর্ব পাশ আর পশ্চিম পাশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো জগৎ দেখা যেত, অন্তত আমার চোখে তেমনই দেখাতো। পূর্ব দিকটা ছিল শহরের দিকে, যদিও শহরের কিছুই দেখা যেত না। দু’মাইল দূরে শহর–সারি বাঁধা বাড়ি, রাস্তায় বাতি আর কল খুললেই পানি, যদিও এবারের কিছুই দেখা যেত না, আগেই বলেছি। তবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একটা মৃদু আলোর আভা দেখা যেত কিনা সেটা নিশ্চিত বলতে পারছি না।
পশ্চিমে নদীর দীর্ঘ বাঁকটা, মাঠ আর গাছ, সূর্যাস্তের দৃশ্যে ছেদ ফেলার মত কিছুই ছিল না। এপাশে শুধুই প্রকৃতি, মানুষের হাত পড়েনি, প্রাত্যহিক জীবনের কোলাহলের কোনো চিহ্নও ছিল না এদিকটায়।
আমি হাঁটতে থাকতাম প্রথমে বাড়ীর কাছে কাছে তারপর দৃষ্টি একটু পরিস্কার হয়ে আসলে যখন আত্মবিশ্বাস জন্মাতো যে পাম্পের হাতল কিংবা কাপড় শুকানোর রঙের সাথে ধাক্কা খাব না, তখন ঝুঁকি নিতাম এদিক সেদিক যাবার। এক সময় পাখীদের নড়াচড়া শুরু হত গাছে গাছে, কিছুক্ষণ পর কিচির মিচির। যে সময় পাখীরা জাগে বলে আমার ধারণা ছিল আসলে তার অনেক আগে ওদের সকাল হয়। তবে আকাশ কিন্তু খানিকটা ফর্সা হয়ে যায় প্রথম পাখীর ডাকের পরপরই। আর ঠিক সে সময় হঠাৎ করেই রাজ্যের ঘুম আসত আমার চোখ জুড়ে। আমি ঘরে ফিরে যেতাম, ভেতরটা হঠাৎ খুব অন্ধকার মনে হত, আর আমি খুব নিপুন হাতে, সাবধানে, নিঃশব্দে চেয়ারটা দরজার হাতলের নিচে কাত করে ঠেস দিয়ে রেখে দিতাম। তারপর দোতলায় উঠে যেতাম কোনো শব্দ না করে, দরজা আর সিড়িগুলো সতর্কভাবে ডিঙিয়ে যেতাম আমি যদিও দেখে মনে হত প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। আমি সোজা গিয়ে আমার বালিশের উপর পড়তাম আর বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম– দেরী বলতে আমাদের বাড়ীতে খুব জোর আটটা কি সাড়ে আটটা।
রাতের সব ঘটনা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারতাম কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভীষণ অবাস্তব মনে হয়–ভয়ংকর ঐ চিন্তাটা সত্যিই এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে দিনের বেলা এর কোন প্রভাবই আমার উপর থাকত না। আমি ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আমার ভাই আর বোন স্কুলে চলে যেত কিন্তু টেবিলে তখনও ওদের নাস্তার প্লেটগুলো পড়ে থাকত, দু’একটা সিরিয়ালের টুকরো ভাসতে থাকত বাড়তি দুধটুকুর মধ্যে।
অবিশ্বাস্য। বোন স্কুল থেকে ফিরলে আমরা দুজন হ্যামকের দু’দিকে মাথা দিয়ে দোল খেতাম।
এই হ্যামকে দোল খেতেই আমার দিনের অনেকটা সময় কাটত, একারণেই হয়ত আমার রাতে ঘুম আসতে চাইত না। রাতে ঘুম না আসার বিষয়টা নিয়ে আমি কারো সাথে কথাও বলিনি, আর আমাকেও তাই কেউ বলেনি যে দিনে একটু কাজ কর্ম করলে রাতে ঘুমটা ভাল হয়।
আমার সমস্যাটা সঙ্গে করে নিয়ে রাত আসত। পিশাচগুলো আমাকে পেয়ে বসত আবার। খুব দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত বোধটুকু থাকত আমার। আমি একবারের জন্যও ভাবার চেষ্টা করতাম না যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কিংবা খুব চেষ্টা করলে আমি ঘুমিয়ে যেতে পারব। খুব সাবধানে আমি বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতাম। অন্ধকারে চলাফেরায় আরও পরাদর্শী হয়ে উঠেছিলাম আমি, ঘরের ভেতরটা আরও স্পষ্ট দেখতে পেতাম, আরও অচেনা, রান্না ঘরের পাল্লার কুকুরে চিবানো অংশটা–সব যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম। একটা কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একটা বালি দিয়ে খেলার জায়গা ছিল, উঠানে জায়গাটা এমনভাবে বানানো ছিল যাতে মা উত্তরের জানালা দিয়ে আমার উপর নজর রাখতে পারে কাজ করতে করতে, এখন একটা স্পাইরিয়ার ঝোপ অবাধ্যভাবে বেড়ে উঠে জায়গাটা একদম ঢেকে দিয়েছে।
রান্নাঘরের পূর্ব দিকের দেয়ালে কোনো জানালা ছিল না। একটা দরজা ছিল যেটা খুললেই এক সারি সিড়ি, ওখানে দাঁড়িয়ে আমরা বড় বড় ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দিতাম, আবার শুকিয়ে গেলে ওগুলো ধরে ঝুল খেতাম আর ধোয়া কাপড়ের টাটকা গন্ধ নিতাম– সে সাদা বিচানা চাদরই হোক বা কালো ওভারঅল।
রাতে হেঁটে বেড়ানোর সময় কখনো কখনো আমি সিড়িগুলোর কাছে একটু থামতাম। বসতাম না, শহরের দিকটা একটু ভালভাবে দেখতে পেতাম ওখান থেকে, হয়ত শহুরে সভ্যতার বাতাস একটু গায়ে মাখতে চাইতাম।
এক রাতে– ঠিক বলতে পারব না আমার রাত জেগে হেঁটে বেড়ানোর বিশতম রাত নাকি দ্বাদশ রাত নাকি অষ্টম বা নবম– আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম কোনের দিকে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, ততক্ষণে আমার গতি কমানোর আর সময় নেই। কে যেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, সোজা হেঁটে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলেও তখন ধরা পড়ে যেতাম। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার চেয়ে বরং মুখোমুখী হওয়াই ভাল।
কে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে ? আমার বাবা। বাবাও সিড়ির উপর বসে শহরের দিকে আর প্রায় অদৃশ্য শহরে আলোর আভার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবা দিনের পোশাকই পড়ে ছিল— গাঢ় রংয়ের প্যান্ট, শার্ট আর বুট। সিগারেট ফুকছিল বসে, নিজের হাতে বানানো সিগারেট। হয়ত সিগারেটের গন্ধই আমাকে অন্য কারো ……
তামাকের গন্ধ থাকত সব জায়গায়, ঘরের ভেতরে, বাইরেও। আলাদা করে সেটা টের পাবার সম্ভাবনা কমই ছিল।
বাবা বলল, সুপ্রভাত, যেটা বলাটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে তবে ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। আমাদের পরিবারে আমরা এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় একদমই অভ্যস্ত ছিলাম না। কোনো বৈরী সম্পর্কের কারণে নয়, বরং যেখানে সারাদিনই সবার সাথে সবার দেখা হচ্ছে সেখানে এরকম ঘটা করে সম্ভাষণ বিনিময়টা অপ্রয়োজনীয় মনে করা হত।
আমিও সুপ্রভাত জানালাম বাবাকে। সময়টা তখন নিশ্চয় সকালের খুব কাছাকাছি তা না হলে বাবা এরকম পোশাকে থাকত না। আকাশও ততক্ষণে নিশ্চয় ফর্সা হতে শুরু করেছিল কিন্তু ঘন গাছের সারির জন্য ভাল বোঝা যাচ্ছিল না। পাখিদের ডাকাডাকিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনই আমি আগের দিনের চেয়ে বেশী সময় বাইরে কাটাচ্ছিলাম, প্রথম দিকে যেমন ভাল লাগত সেরকম কিন্তু আর লাগছিল না, যে সম্ভাবনাটা এক সময় শুধু শোবার ঘরেই বাস করত, শুধু দোতলা বিছানায়, সেটা ধীরে ধীরে ঘরের প্রতিটি কোনায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।
এখন যখন সেদিনের কথা চিন্তা করি, আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন বাবা কাজের পোশাক পরে ছিল না সেদিন? পোশাক দেখে মনে হচ্ছিল বাবা কোনো প্রয়োজনে শহরে যাবে। সেদিন সকালের প্রথম কাজটাই ছিল শহরে যাওয়া।
আমি আর হেঁটে বেড়াতে পারলাম না, কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটল আমার ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের।
“ঘুমের সমস্যা হচ্ছে ? বাবা বিজ্ঞেস করল।
আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, না। কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হল রাতভর হেঁটে বেড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করাটা কতটা কঠিন হবে। তাই বললাম, হ্যাঁ।
বাবা বলল, “গ্রীষ্মের রাতে এরকম হতেই পারে। খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে গেলে আর যেই না মনে করলে এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাচ্ছ, অমনি ঘুমের আর দেখা নেই, তাই না?”
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বুঝতে পরলাম আমার বাড়ী থেকে বের হওয়া আর রাতভর হেঁটে বেড়ানোটা যে বাবা আজই হঠাৎ দেখতে পেল তা নয়। যার বাড়ির সীমানার ভেতরেই তার সব গরু, ছাগল আর ভেড়া যেগুলো কিনা তার রোজগারের ভিত্তি এবং যে তার ড্রয়ারে একটা হ্যান্ডগান রাখে, সিড়িতে সামান্যতম আওয়াজ বা দরজার হাতল ঘুরানোর সুক্ষ্ন শব্দও তার সজাগ কানকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
আমার না-ঘুমানো বিষয়ক আলোচনা এরপর কোনদিকে মোড় নেবে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাবা একরকম ঘোষণাই করল যে রাতে না ঘুমাতে পারাটা একটা ভীষণ যন্ত্রণা। কিন্তু আলোচনা কি এখানেই শেষ ? আমার কোনমতেই তাকে এর চেয়ে বেশী কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও আমাকে বুঝতে দিত যে এই ঘোষণাই আলোচনার শেষ না, যদি একটুও আভাস দিত যে পুরো বিষয়টা জানার জন্যই সে এসেছে, আমার মনে হয় না সে আমার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারত। নীরবতা ভাঙলাম আমিই, নিজের ইচ্ছায়, বললাম আমি ঘুমাতে পারি না। আমি বাধ্য হয়ে বাইরে এসে হেঁটে বেড়াই।
কেন?
আমি জানি না।
খারাপ স্বপ্ন দেখ না তো ?
না।
“বোকার মত প্রশ্ন করলাম”, বাবা বলল “ভাল স্বপ্ন তো আর তোমাকে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসত না”।
বাবা আমাকে সময় নেবার সুুযোগ দিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে চাইছিলাম কিন্তু যা না করে কেন যেন কথা বলতে শুরু করলাম। সত্যই বললাম সব, শুধু সামান্য একটু বদলে দিয়ে।
আমার ছোট বোনের কথা যখন বললাম, আমি বললাম, আমার ভয় হয় ওর কোনো ক্ষতি যদি করে ফেলি। আমার বিশ্বাস ছিল ওটুকু বলাই যথেষ্ট, কি ক্ষতি সেটা বাবা বুঝে নেবে।
“ওকে গলা টিপে মেরে ফেলি যদি”, আমি বলেই ফেললাম। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছিলাম না আমি।
এ কথা ফিরিয়ে নেবার আর সুযোগ নেই, একটু আগ পর্যন্ত যে মানুষটা ছিলাম আর কখনোই সে মানুষটা হতে পারব না আমি।
বাবা কথাটা শুনল। শুনল যে আমি মনে করি কোনো কারণ ছাড়াই আমি ছোট্ট ক্যাথেরিনকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি।
বাবা বলল, “আচ্ছা”।
এরপর বলল আমি যেন দুশ্চিন্তা না করি, বলল, “কখনও কখনও মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে”।
কথাগুলো বাবা বলল খুব গম্ভীরভাবে, গুরুত্ব দিয়ে, কোনো শঙ্কা বা বিস্ময় দেখা গেল না তার ভেতর। মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে কিংবা ভাবনা না বলে ভয় বলতে পার, কিন্তু এ নিয়ে ঘারড়াবার কিছু নেই, বলতে পার এটা একটা দুঃস্বপ্নের মত।
বাবা কিন্তু পরিস্কার করে বলল না যে আমার দ্বারা এরকম ভয়ংকর কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই। দেখে মনে হল বাবা বরং ধরে নিয়েছে এরকম কিছু ঘটতেই পারে না। এটা ইথারের জন্য হচ্ছে, বাবা বলল। তোমাকে হাসপাতালে ইথার দেয়া হয়েছিল। ধরে নাও এটা একটা স্বপ্ন, এর বেশী কিছু না। এরকম কিছুই কখনো ঘটবে না, যেমন কোনো উল্কা কখনোই আমাদের বাড়ির উপর এসে পড়বে না। (অবশ্যই পড়তে পারে কিন্তু এর সম্ভাবনা এতই কম যে সেটা ঘটতেই-পারে-না’র দলে পড়ে গেছে)।
এরকম চিন্তা করার জন্য বাবা আমাকে দোষারোপ করল না মোটেও। বিস্মিতও হল না একটুও।
বাবা অনেক কিছুই বলতে পারত। আমার বোনের ব্যাপারে আমার মনোভাব কেমন সেটা জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারত অথবা আমার জীবনে কোনো সমস্যা চলছে কিনা সেটা জানতে চাইতে পারত। যদি আজ এ ঘটনা ঘটত তবে বাবা হয়ত কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করত। (প্রজন্ম আর আয়-রোজগারের দৌড়ে এক ধাপ এগিয়ে এই আমি মনে হয় সন্তানের জন্য তাই করতাম)।
বাবার কৌশলটাও কিন্তু কাজ করল। আমি আমার আগের অবস্থানে ফেরৎ গেলাম কারো বিদ্রুপের স্বীকার বা শঙ্কার কারণ না হয়েই।
এরকম কিছু কিছু ভাবনার জন্ম হয় মানুষের মনে যেটা খুব ক্ষণস্থায়ী, হারিয়ে যায় অল্প ক’দিনের মধ্যেই, এসব নিয়েই তো জীবন।
তুমি যদি এ যুগের বাবা মা হও আর দীর্ঘদিন বেঁচে থাক তাহলে তুমি তোমার এমন কিছু ভুল হঠাৎ আবিস্কার করবে যেগুলো তুমি একেবারেই জানতে চাও না। আবার একই সাথে খুব ভালভাবে জান। কখনো কখনো তুমি নিজের কাছেই আবার কখনো কখনো ভীষণ বিরক্ত নিজের ওপরে। আমার বাবার এসবের কোনো বালাই ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত জানি, আমি যদি বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করতাম সে আমাকে বেল্ট দিয়ে পেটাত কেন, সে বলত, তোমার ভালর জন্যই। সেই বেদম মারগুলো বাবার মনে, যদি আদৌ তার মনে থেকে থাকে, তার মুখরা সন্তানকে শাসন করার উপযুক্ত ব্যবস্থা হিসেবেই থেকে গেছে, যে মুখরা সন্তানের সুখ-কল্পনা ছিল মুরগীর খোঁয়াড়গুলোর শাসক বনে বসেছে সে।
“নিজেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান মনে করছ তুমি”, বাবা হয়ত শাস্তির কারণ হিসেবে বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটাই উল্লেখ করত, আর সেসময়, সতিই, একথা প্রায়ই শোনা যেত বুদ্ধিমান বাচ্চাদের সম্পর্কে। ওদেরকে পিটিয়ে বুদ্ধির ভূত না ছাড়ালে নাকি ছেলেগুলোর বড় হয়ে নিজেদেরকে বুদ্ধিমান মনে করার সম্ভাবনা থেকে যেত, কিংবা বুদ্ধিমতী, যেমন আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল।
সে যাই হোক, সেদিন ভোরে আমার যা শোনার দরকার ছিল আমাকে ঠিক তাই বলেছিল বাবা আর খুব অল্প দিনের মধ্যে সবকিছু ভুলেও গিয়েছিলাম আমি।
আমি ভেবেছিলাম বাবা ভাল কাপড় চোপড় পরে আছে কারণ তাকে হয়ত সকাল সকাল ব্যাঙ্কে যেতে হবে, যেখানে তাকে শুনতে হবে, যদিও নতুন কিছু নয় সেটা যে ব্যাঙ্ক লোন আর বাড়ানো যাবে না। বাবা তার সাধ্যমত পরিশ্রম করেছে কিন্তু বাজারের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সংসার চালানোর জন্য তাকে নতুন কোনো উপায় খুঁজতে হবে আর একই সাথে ব্যাঙ্কের টাকাটা পরিশোধেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা বাবা হয়ত তখন জানতে পেরেছিল যে মায়ের ক্রমাগত শরীর কাঁপাটার একটা বিশেষ নাম আছে এবং সেটা আর কোনদিনই সারবে না অথবা বাবা অবিশ্বাস্য কোনো মহিলার প্রেমে পড়েছিল।
http://forum.daffodilvarsity.edu.bd/index.php?action=post;board=365.0