1
Common Forum/Request/Suggestions / আপনার সন্তানের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব আপনারই।
« on: December 01, 2020, 04:43:03 PM »
কেস স্টাডি ১ : মাসুম (ছদ্মনাম), বয়স ১১
বাসা ছেড়ে বাইরে বেরুতেই মাসুম তীব্র অনিহা দেখায় আজকাল। খোঁজ করে জানা গেলো, বাসার বাইরে পা ফেললেই কোথা থেকে যেনো পাশের বাসার চল্লিশ বছর
বয়েসী আঙ্কেল এসে উদয় হন এবং আদর করার ছলে তাকে গালে, ঘাড়ে এমনকি ঠোঁটেও চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। ভদ্রবেশী এই কাজগুলাে তিনি কখনো কখনো
মাসুমের বন্ধুদের সামনেই করেন। তাই সেই আঙ্কেলকে দূর থেকে দেখতে পেলেই লজ্জা আর অস্বস্তি এড়াতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় মাসুম। ভয় ও পায়।
বাবা-মা কে জানাতেও সংকোচ তারা বলেন, আঙ্কেল তো তোমায় আদর করছেন বাবা। অথচ মাসুমের যে এরকম আদর একেবারেই ভালো লাগে না সেটা কিছুতেই বাবা-মা কে বুঝিয়ে বলতে পারে না সে। সে অন্তত এটা বুঝতে পারে লোকটির উদ্দেশ্য ভালো নয়। কিংবা আদর করার ছলে তাকে সস্পর্শ করাও গুড টাচ নয়। সন্তান্দের তাই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে হবে অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই। সন্তানের সবথেকে ভরসার জায়গাটিতে তার বাবা মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।
কেস স্টাডি ২ : তানিম (ছদ্মনাম), বয়স
তানিমের খালাতো বোন রুন্টি আপুকে দেখলেই পালিয়ে বেড়ায় সে। অথচ কদিন আগেও সেই আপুর ভীষন ন্যাওটা ছিলো সে। আপু বলতে অস্থির ছেলেটা বড় বোনের মত ভরসা করে। ইদানিং তানিমের ভয়ে হাত পা শুকিয়ে যায়। বিরক্ত বোধ হয়। কাউকে বলতে পারে না। যদি তাকেই মার খেতে হয়! আপু এখনো তাকে খুব কাছে ডাকেন। মা-বাবাও ভীষণ অবাক হয়ে যান তানিমের এই আচরণে এবং হঠাৎ পরিবর্তন দেখে, কিন্তু কিছুতেই তাকে আর সেই আপুর কাছে পাঠানো যায় না। অনেক প্রশ্ন করে মা একদিন জানতে পারলেন, আপু তার সঙ্গে এমন কিছু কাজ করেছেন, যা ওর মোটেই পছন্দ হয়নি। তবে তানিম না বুঝলেও একজন ওইয়ার্কিং লেডী কিসেবে সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার মায়ের বুঝতে অসুবধা রইল না যে রুন্টির কাজগুলো প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্ককেই ইঙ্গিত করে। আর তার ফলেই লজ্জায় তার ৭ বছরের শিশুটি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য হয়েছে। যা হতো এক্সময় সাইকোলজিক্যাল ডিজ অর্ডারে রুপান্তরিত হতে পারে। তাই নিজের সন্তানের ভরসার জায়গাটিকে ধরে রাখুন। কাজের দোহায় দিয়ে তাকে পারিবারিক বন্ধন থেকে আলগা করে রাখবেন না। বাচ্চাদের কথা মন দিয়ে শুনুন। তার কি বলতে চায়। বোঝার চেষ্ঠা করুন। প্রয়োজনে কাজ থেকে ফিরে নিজেই কাছে ডেকে হাসিচ্ছলে সারাদিনের কাজের আপডেট জানতে চান।
কেস স্টাডি ৩ : শাহীন, বয়স ১০।
মধ্যবিত্ত পরিবার। ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকার ঘরের সংকট হওয়ায় কেউ বেড়াতে এলে অতিথিদের সঙ্গেই ঘুমোতে হয় তাকে। এমনই একদিন রাতে বেড়াতে এসে তার এক মামা যৌন নিপীড়ন চালায় শাহীনের ওপর। সকালে সেই মামা আবার তাকে শাঁসায় এসব ঘটনা অন্য কেউ জানলে সবাই শাহীনকেই খারাপ ছেলে ভাববে। তাই ভয়ে কাউকেই কিছু বলতে পারেনি সে, বরং পরপর বেশ কিছুদিন এমন আচরণ নীরবে সহ্য করে যায়। শিশুদের কখনোই ধমকে শাসন করবেন না। তাদের কে গুরুত্ব দিন অন্তত এটা বুঝতে দিন যে পরিবারে সবচেয়ে ছোট সদস্য হলেও তাদের ভূমিকা পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কেস স্টাডি ৪:
অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। যুবায়ের (১৭), ভালো ফুটবল খেলে। ভালো সাঁতারু। বন্ধুবৎসল প্রানোচ্ছল কিশোর। স্থানীয় ফুটবল কোচ, চল্লিশোর্ধ আলজেরিয়ান নাগরিক আবু উবাইদা কাদির। এলাকার সব বয়েসী কিশোরদের সাথেই ভীষণ সখ্য তার। যুবায়েরের সাথেও কোচের খুব ভালো বোঝা-পড়া সেই ছোটবেলা থেকে। প্রায়ই যুবায়েরকে দামী জিনিস উপহার দেন তিনি, যুবায়রের পরিবারের সবাই ও জানেন কোচ আংকেলের সাথে তার সখ্যের কথা। তাই কারো মনে অন্য কোন কিছু সন্দেহ হয়নি কখনোই। খবরে প্রকাশ, গত বছরের পাঁচ অক্টোবর উত্তরার চার নম্বর সেক্টরের একটি পার্কের পুকুর থেকে যুবায়েরের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেই আলজেরিয়ান কোচ, যৌন সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় ব্যার্থ হওয়ার পর খুন করে যুবায়েরকে। আমাদের সাম্নায় অসাব্ধানতায় যেন আমাদের সন্তানদের জৈবন বিপন্ন না হয় সেই বিষয়ে খেয়াল রাখার দাইয় আমাদের উপরেই বর্তায়। এমন আরো অসংখ্য নিপীড়নের ঘটনা প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে পত্রিকায়কিংবা টিভি সংবাদে। সাধারণত, যৌন নিপীড়ন শব্দটি শুনলেই আমরা অবচেতন মনে ধরেই নেই ভিকটিম নারী। কিন্তু নির্যাতিতদের বিশাল একটি অংশ যে ছেলে শিশু তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। ছেলে শিশুদের ওপর যৌননিপীড়নের ঘটনা নেহায়েত কম নয় এ সমাজে। বরং কোন কোনন ক্ষেত্রে ছেলে শিশুরাই বিকৃত যৌন আচরনের শিকার হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই লজ্জা না পেয়ে অভিভাবক হিসেবে সাহসের সাথে তা মোকাবেলা করা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC, Atlanta) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ছেলে শিশুদের উপর
যৌন নিপীড়নের হার শতকরা ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ছয়জন ছেলেশিশুর মধ্যে অন্তত একজন কোন না কোনভাবে যৌন নিপীড়নের
শিকার হয়। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড এডলসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল
উদ্দিন আহমেদ চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ান ডটকমকে বলেন, ছেলেশিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন কেবলমাত্র পুরুষরাই চালান না, অনেক সময়ই নারীরাও যৌননিপীড়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি আরো জানান, শতকরা পঁচাশি ভাগ ক্ষেত্রেই নিপীড়কেরা শিশুটির পূর্বপরিচিত হয়ে থাকে। অচেনা কারো দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়ার হার মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, যৌননিপীড়করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুর ঘনিষ্ঠ বা স্বজন, বা এমন কেউ যাকে পারিবারিকভাবে বিশ্বস্ত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সবচেয়ে ভয়ানক তথ্য হলো, মেয়েশিশুদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে অভিভাবকরা যতটা সতর্ক বা সমাজ যতটা তৎপর, ছেলেশিশুদের
উপর একইরকম ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা ততটাই উদাসীন। যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে আমাদের আরো একটি ভুল ধারণা হলো, কেবলমাত্র ধর্ষণ-ই যৌননিপীড়ন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ জানান, অপ্রাপ্তবয়স্ক কারো সাথে অনুপযোগী যৌন ঠাট্টা বা অশালীন শব্দ ব্যাবহার, দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, শিশুর বয়সের উপযোগী নয় এমন যৌন বস্তু, স্থিরচিত্র বা চলচ্চিত্র প্রদর্শন, শিশুর সামনে এমন কোন আচরণ করা যা একান্তই ব্যাক্তিগত এবং প্রাপ্তবয়স্ক বলে বিবেচিত এবং সর্বোপরি শিশুর সাথে বাধ্যতামূলক যৌন মিলন– সবই শিশু যৌননিপীড়নের তালিকাভুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শারীরিক আক্রমণের শিকার না হওয়া পর্যন্ত আমরা অর্থ্যাৎ অভিভাবকরা এসব ঘটনা এড়িয়ে যাই বা চাপা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা গেছে, শারীরিক ক্ষতির চাইতেও যৌননিপীড়নের ফলে শিশুর পরবর্তী জীবনে দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্ষতিকর মানসিক প্রভাব পড়ে। সাধারণত নিপীড়নের শিকার শিশুর বয়স এবং নিপীড়নের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে শিশুর আচরণে এবং মানসিকতায় এর প্রভাব দেখা যায়। ভয়ানক প্রভাবগুলো : সাধারণভাবে যৌননিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর যে সমস্ত মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিশুর মধ্যে পাপবোধ বা নিজেকে খারাপ ভাবা এবং নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রবণতা। অকারণ এবং অবিরাম কান্নাকাটি, অহেতুক ভীতি। সন্দেহপ্রবণতা, বিষন্নতা, মানসিক অস্থিরতা। নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, খিটখিটে মেজাজ। সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোই বেশি ধরা পড়লেও, সময় মতো কাউন্সিলিং বা যথাযথ চিকিৎসা না নিলে পরবর্তীতে পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বের সংকট, আস্থাহীনতা, আত্মবিশ্বাসের স্বল্পতা, যৌনতা সম্পর্কিত বিভিন্ন ভুল ধারণাসহ, যৌনস্পৃহা হ্রাস পাওয়াসহ আরো নানারকম মানসিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
একটু খেয়াল করুন:
আপনার শিশুকে এই সমস্ত ভয়াবহতার হাত থেকে বাঁচাতে চাইলে সবচেয়ে জরুরি হলো মানসিকতার পরিবর্তন। ছেলে শিশুরাও যে যৌননিপীড়নের শিকার হতে পারে এবং তা যে কেবলমাত্র পুরুষদের দ্বারাই না– এই সহজ সত্যিটি মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা আমাদের অনেকেরই নেই। এরকম কোন পরিস্থিতে শিশুকে কোনভাবেই দোষারোপ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, বুঝে-শুনেসিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার মতোবয়স এবং মানসিক পরিপক্কতা শিশুর নেই। তাছাড়া, দোষারোপ করে শিশুকে চুপ করিয়ে দিলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। নিপীড়কেরা এতে করে আরো বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। শৈশবে বা বয়ঃসন্ধিকালে লজ্জায় এবং বাবা-মা’র সাথে যথেষ্ঠ মানসিক নৈকট্য না থাকায় অনেক কথাই শিশু চেপে যায়। আর নির্যাতনকারীরা ঠিক এ সুযোগটিই নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে পরিবারের অন্য সদস্যদের চাইতে নির্যাতনকারীরা শুরুতেই সচেষ্ট হয় শিশুর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার। আপনার সন্তানের সাথে কখনোই এমন কোন সম্পর্ক হতে দেবেন না যাতে আপনার চাইতেও বাইরের কারো ওপর তার বেশি মানসিক নির্ভরতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হয়। চাকুরীজীবি বাবা মায়েরা বা যারা সার্বক্ষণিকভাবে সন্তানকে সঙ্গ দিতে অসমর্থ, তাদের সব সময়ই সতর্ক থাকা উচিত। মানসিকভাবে শিশুর সাথে যেন কোন দূরত্ব সৃষ্টি না
হয় সে দিকে খেয়াল রাখা। সার্বক্ষণিক নজরদারী অসম্ভব হলেও ফোনে বা মোবাইলে ঘন ঘন সন্তানের খোঁজ খবর রাখাটাও জরুরি। সন্তানের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে করে সে কখনোই ভয় পেয়ে বা লজ্জায় কোন কথা গোপন করে না যায়। তাছাড়া বুঝতে শেখার পর থেকেই ধীরে ধীরে শিশুকে নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন করে দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত যৌনজ্ঞান শেখানোটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আপনার সন্তানের সবরকম ভালো-মন্দের দায়ভার যেমন আপনার, তেমনি তার সমস্ত খোঁজ-খবর রাখা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাটাও আপনারই কর্তব্য।
[/size]