Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - 710001113

Pages: 1 2 [3] 4 5 ... 11
31
By Farzana Tasnim Pinky
Like what you read ? Give it a star !

একবিংশ শতাব্দীতে এসে নানা ধরনের আবিষ্কারের কথা শুনে আমরা বেশ অবাক হয়ে যাই। অথচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন সব পাণ্ডুলিপি যখন হঠাৎ করেই আমাদের সামনে হাজির হয়, তখন সেই আমলের মানুষের চিন্তাভাবনা আমাদের টনক নড়িয়ে দিতে বাধ্য করে। বলছিলাম সিবিউ পাণ্ডুলিপির কথা। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেকার এই পাণ্ডুলিপিটিতে তরল জ্বালানি, কামান, ক্ষেপণাস্ত্র ও একাধিক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট রকেট তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন কনরাড হাস নামক এক ব্যক্তি। চোখ কপালে তোলা সেই পাণ্ডুলিপিটি নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
শুরুতেই আসা যাক কনরাড হাসের প্রসঙ্গে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে খুব উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিলো প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন। পোপ কর্তৃক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের এক শ্রেণীকে অস্বীকৃতি জানানোর পর পুরো বিষয়টিকে ঢেলে সাজানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ফলে গোটা ইউরোপ ক্যাথোলিক এবং প্রটেস্ট্যান্ট, মোটা দাগে এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। দুই দলে ভাগ হয়ে চলতে থাকে তাদের মধ্যকার অরাজকতা। আর এদিকে প্রাচ্যে তখন অটোমান সাম্রাজ্য বেশ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ১৫২৯ সালে বিধানকর্তা সুলাইমানের হাত ধরে তারা এমনকি ভিয়েনার গেট অব্দি পৌঁছে যায়। এমনই এক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় শতাব্দীতে জন্ম হয় কনরাড হাসের।
Advertisement


হাসের সেই চমকপ্রদ পাণ্ডুলিপি; Source: ancient-code.com
হাস ছিলেন অস্ট্রিয়ান অথবা ট্রানসিলভানিয়ার স্যাক্সন সামরিক প্রকৌশলী। হাঙ্গেরিতে কর্তব্যরত এই ইঞ্জিনিয়ার রকেটের প্রধান নকশাকারী হিসেবে পরিচিত। তার নকশা করা রকেটের মধ্যে তিন স্তর বিশিষ্ট একটি রকেট এবং মনুষ্যবাহী রকেটের অস্তিত্বও পাওয়া গেছে। ১৫০৯ সালে জন্ম নেয়া হাস অস্ত্র প্রকৌশলী এবং প্রশিক্ষক হিসেবে রকেট প্রযুক্তি নিয়ে জার্মান ভাষায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। শুধু রকেটই নয়, এখানে ক্ষেপণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের বিবরণও দিয়েছেন তিনি।
১৯৬১ সালে আবিষ্কৃত হয় হাসের পাণ্ডুলিপিটি। সিবিউয়ের পাবলিক রেকর্ড থেকে এটি উদ্ধার করা হয় বলে একে ‘সিবিউ পাণ্ডুলিপি’ বলেই ডাকা হয়। ডেলটা বা ত্রিভুজাকৃতির ডানা, ঘণ্টাকৃতির নল, বিভিন্ন তরলের সংমিশ্রণে তরল জ্বালানি তৈরি থেকে শুরু করে কয়েক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট রকেটের গতিতত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন হাস। তার সেই প্রবন্ধের মূল পাণ্ডুলিপিটিতে উল্লেখিত রকেটের সামরিক ব্যবহার সংক্রান্ত অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন-
“আমার উপদেশ থাকবে যুদ্ধকে না বলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও বেশি মনোনিবেশের প্রতি। শান্তভাবে রাইফেলগুলো গুদামে রেখে আসা উচিত, যাতে আর একটি গুলিও না চলতে পারে, গানপাউডারগুলোও খরচ না হয়। এতে একদিকে যেমন রাজার টাকা বেঁচে যাবে, অন্যদিকে অস্ত্রাগারের রক্ষীর চাকরিটাও টিকে যাবে বহুদিন। কনরাড হাস তোমাদেরকে অস্ত্রের অপব্যবহার না করার উপদেশ দিচ্ছে”।

রোমানিয়ার ডাকটিকিটে কনরাড হাস; Source: ancient-code.com
হাসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত হাসকে নতুন করে সামনে উপস্থিত করে এই পাণ্ডুলিপিটি। বলা হচ্ছে, এটি মূল পাণ্ডুলিপির তৃতীয় খণ্ড, যা লেখা হয়েছিল প্রায় ১৫০০ সালের দিকে। সামরিক এ ইঞ্জিনিয়ার এখানে ‘ফ্লাইং জ্যাভেলিন’ বা ‘উড়ুক্কু বর্শা’ নামক এক নতুন প্রযুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন, আশ্চর্যজনকভাবে যা বহুস্তর বিশিষ্ট রকেটের বর্ণনার সাথে বহুলাংশে মিলে যায়। কাজেই ইতিহাস খুঁড়ে হাসের নাম নতুন করে উত্থিত হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতদিন ধরে পোল্যান্ডের আর্টিলারি বিশেষজ্ঞ কাজিমিয়ার্জ সিমেনোউইকজকে রকেট উদ্ভাবকের স্বীকৃতি দেয়া হতো। ১৬৫০ সালে তিনি তিন স্তর বিশিষ্ট রকেটের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর কাজিমিয়ার্জকে হটিয়ে রকেট উদ্ভাবকের জায়গায় নাম লেখান কনরাড হাস।
সিবিউ পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করেন ডরু তোদেরিকিউ। রোমান এই লেখক, ঐতিহাসিক, গবেষক সিবিউয়ের স্টেট আর্কাইভের পুরনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছিলেন। এরই মধ্যে তার চোখে পড়ে হাসের পাণ্ডুলিপিটি। সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে থাকা এই পাণ্ডুলিপিটি ডরুকে একটি স্বতন্ত্র গবেষণার খোরাক যোগায়। জার্মান ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপিটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৫০। সিবিউয়ের স্টেট আর্কাইভ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে ডরু নিজেই এর নাম দেন ‘সিবিউ পাণ্ডুলিপি’। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সে সময় খুব বেশি উন্নতি না ঘটলেও হাসের চিন্তা-ভাবনা ছিল অভূতপূর্ব ও চমকপ্রদ।

১৫৫১ সালে উৎক্ষেপিত রকেটের ছবি; Source: toptenz.net
১৯২৬ সালের ১৬ মার্চ রবার্ট গোদার্ড ম্যাসাচুসেটসে বিশ্বের প্রথম তরল জ্বালানি বিশিষ্ট রকেট উৎক্ষেপণ করেন। এর আগপর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারেনি যে এমন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব। অথচ তারও প্রায় ৫০০ বছর আগে এমন একটি অভিনব জিনিসের নকশা তৈরি করে ফেলেছিলেন হাস। পাণ্ডুলিপির তৃতীয় খণ্ডে ১৫৫৫ সালে সিবিউ শহরে হাজার হাজার মানুষের সামনে একাধিক টায়ার বিশিষ্ট একটি রকেট উৎক্ষেপণের সফল বর্ণনাও রয়েছে। ঘটনাটি কতটুকু সত্যি বা কতটুকু মিথ্যে, তা যাচাই করার উপায় নেই। তবে হাসের নিজ হাতে আঁকা রকেটের বিভিন্ন ছবি রকেট উৎক্ষেপণ না হলেও আবিষ্কারের প্রমাণ বহন করছে।
শত শত বছর আগে একজন মানুষ রকেট বিজ্ঞানের এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে আবিষ্কার করলেন, তা এক রহস্যই বটে। শুধু রকেট নয়, মহাকাশযান, তরল জ্বালানি এবং ত্রিভুজাকৃতির ডানা- এতগুলো চমকপ্রদ আবিষ্কার হাসের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
সিবিউ পাণ্ডুলিপি বর্তমানে রোমানিয়ায় সংরক্ষিত আছে। অনেকেই অবশ্য এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, এত বছর আগে যেহেতু এমন জটিল পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল না, সেহেতু ডরু নিশ্চয়ই নিজ হাতে এগুলো লিখে সবাইকে ধোঁকা দেয়ার পাঁয়তারা করছে। তাদের এই সন্দেহের ভিত্তিতে পরবর্তীতে গবেষকরা হাসের বর্ণনা করা পুরো প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখেন। ধোঁয়া এবং জ্বালানির হিসাবে সেখানে বেশ কিছু গরমিল তাদের চোখে পড়ে, যার ফলে ঐ বর্ণনানুযায়ী সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণ করা সম্ভব কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবুও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য হলেও একবার অন্তত সিবিউ পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দেখা প্রয়োজন।

১৯২৬ সালে নিজের উদ্ভাবিত রকেটের পাশে রবার্ট গডার্ড; Source: ancient-origins.net
অসংখ্য নকশা আর আর্টিলারি, ক্ষেপণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্রের বর্ণনা সম্বলিত সিবিউ পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হওয়ার আগপর্যন্ত রকেট উদ্ভাবনের জগতে কাজিমিয়ার্জ ছাড়াও আরেকজন বেশ নাম করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্যাভেরিয়ান আতশবাজি নির্মাতা জোহান স্কিমিডলাপ দ্বি-স্তরবিশিষ্ট রকেট নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। ১৫৯০ সালের দিকে তিনি প্রথম এ ব্যাপারে নিরীক্ষা চালান।কাজিমিয়ার্জ নিজেও তিন স্তর বিশিষ্ট রকেটের নকশা প্রণয়ন করেন ১৬৫০ সালে। কাজেই তাদের সমসাময়িক উদ্ভাবক হাস যদি আগেই রকেটের নকশা প্রণয়ন করেন, তবে তা খুব একটা অবিশ্বাস্য হবে না।
Advertisement

হাসের নকশাকৃত রকেট পরবর্তীতে উৎক্ষেপিত হয় কেপ কেনেডিতে। মার্কারি, জেমিনি এবং অ্যাপোলো নামক নাসার কয়েকটি প্রোগ্রামেও পরীক্ষামূলকভাবে তা ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায়। রোমানিয়ার সিবিউ জাদুঘরে সংরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপিটির তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন লেডি সালা শাবাজ। ২০০২ সালের ২৮ মার্চ তিনি মারা যান। তিনি বলেছিলেন-
“দুর্ভাগ্যবশত বহু বছর আগে লেখা অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিতে কুসংস্কার আর গোঁড়ামির ছাপ বেশি পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত ডায়েরিগুলোতেও মানুষ কেন যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনা বিকৃত করত, এমন প্রমাণ আমি নিজে দেখেছি। এত শত ঠিক-বেঠিকের ভিড়ে অনেক সময় দরকারি বা কাজের তথ্য সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলো জনসাধারণের অগোচরে চলে যায়। অথচ এমন দুয়েকটি লেখাই যথেষ্ট সে সময়কার মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দিতে। এমন আরও কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হলে তৎকালীন মানুষের প্রতি আমাদের ধারণাই পাল্টে যাবে। ডরুকে ধন্যবাদ হাসের এমন তথ্যবহুল পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করার জন্য”।
সিবিউ শহরটি এমন নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বেশ আগে থেকেই খ্যাতি লাভ করেছে। হাসের এই পাণ্ডুলিপি সিবিউয়ের অর্জনের মুকুটে নতুন পালক সংযোজিত করেছে।
ফিচার ইমেজ- thedockyards.com

32
By Monem Ahmed
Like what you read ? Give it a star !

আমরা  অনেকে প্রায়ই আফসোসের সুরে বলে থাকি “কেউ আমায় বুঝলো না”। খুব করে চাই, কেউ যদি বুঝতে পারতো আসলে কী চলছে আমাদের মনের মধ্যে! আচ্ছা একবার ভাবুন তো আমরা যদি বুঝতে পারতাম কী চলছে অন্যদের মনের মধ্যে, তাহলে কত ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতো? কত সম্পর্ক ভাঙার বদলে আরো দৃঢ় হতো?

আচ্ছা আরেকজনের কথা বাদ দেই আমরা, নিজেদের অনুভূতিগুলোই ঠিকমতো বুঝতে পারি কি? ধরুন আপনার মন খারাপ। কিন্তু আমাদের অনুভূতি কি এতই সরল যে স্রেফ মন খারাপ বা ভালো এ দুটো শব্দ  দিয়েই প্রকাশ হয়ে যায়? উত্তর হলো- না। আপনি কি ধরতে পারছেন আপনার আসলে কোন ধরণের মন খারাপ? আপনি কি হতাশ, নাকি বিষণ্ণ? নাকি কোনো অনুতাপে ভুগছেন? আমরা আমাদের অনুভূতির এ সূক্ষ্ম রূপগুলো ধরতে পারি কি?

ছবিসূত্রঃ assets.entrepreneur.com

অনুভূতির এ সূক্ষ্ম রূপগুলো নিয়েই ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর কাজ। নিজের এবং অন্যের আবেগ বুঝতে পারা, অনুভূতির সূক্ষ্মতর রূপগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারা এবং কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়া বা কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাই হলো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স।

জীবনের বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিয়ন্ত্রিত হই আবেগ দ্বারা। আবার এ আবেগের কারণেই সূত্রপাত ঘটে দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ সমস্যার। আবেগকে ঠিকমতো বুঝে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এড়ানো যায় এসব সমস্যা, অর্জন করা যায় অনেক লক্ষ্য। এ কারণেই ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর গুরুত্ব এত বেশী। এমনকি সফলতার ক্ষেত্রে ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকে (‘ই আই’ বা ‘ই কিউ’) ‘আই কিউ’ এর চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়।

ছবিসূত্রঃ mind-setdevelopments.co.uk

ড্যানিয়েল গোলম্যান তার ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর মডেলে পাঁচটি দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন:

১। আত্মসচেতনতা: নিজের অনুভূতি, দুর্বলতা, সবলতা, মূল্যবোধ ও লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ সকল কিছু মাথায় রাখাই আত্মসচেতনতা। এছাড়াও অন্যদের উপর নিজের সহজাত ও প্রতিক্রিয়াশীল অনুভূতিগুলোর (যেমন হতে পারে অতিরিক্ত বিশ্বাস প্রবণতা বা রেগে যাওয়া ইত্যাদি ) প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত।

২। আত্মনিয়ন্ত্রণ: নিজের ক্ষতিকর আবেগ বা মনোবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা বা পরিবর্তিত অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এর অন্তর্ভুক্ত।

৩। সামাজিক দক্ষতা: সম্পর্কের মাধ্যমে সহযোগী বা অধীনস্থ কর্মীদের কোনো একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা।

৪। সহমর্মিতা: কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অন্যদের অনুভূতির বিষয়ে সজাগ থাকা।

৫। প্রেরণা: কোনো কিছু অর্জনের জন্য নিজেকে তাড়িত করা।

ছবিসূত্রঃ sessioncam.com
ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্টদের কিছু বৈশিষ্ট্য

অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর দক্ষতাও অনুশীলনের মাধ্যমে শাণিত করা যায়। তবে এমনটাও হতে পারে যে এটি কি তা না বুঝেই সহজাত ভাবে আপনি উচ্চ ‘ই আই’ সম্পন্ন। নিচে উল্লিখিত ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিদের অভ্যাসগুলো খেয়াল করুন। আপনার অভ্যাসের সাথে কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

১। তারা অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন থাকেন

উচ্চ ‘ই কিউ’ সম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজেকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমি এমন অনুভব করছি কেন?’, ‘আমি এমনটা করলাম কেন?’ এ সকল প্রশ্নের মাধ্যমেই মূলত ‘ই আই’ এর শুরু। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে একজন তার প্রতিক্রিয়াশীল অনুভূতিগুলোর বিষয়ে সচেতন হন এবং একে ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন।

২। তারা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে আগ্রহী হন

তারা জানেন যে তিনি নিজেকে বা নিজের কাজকে যে দৃষ্টিতে দেখেন অন্যরা সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে না। তাই তারা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেমনই হোক না কেন অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে জানতে আগ্রহী হন।

ছবিসূত্রঃ dharmaconsulting.com

৩। তারা সঠিক সময়ে বিরতি দিতে জানেন

হুট করে কোনো কথা বলতে গিয়ে বা কোনো কিছু করতে গিয়ে থেমে একটু ভেবে নেয়া, বিষয়টি সহজ মনে হলেও আসলে ততটা সহজ নয়। তবে এ একটুখানি ভেবে নেয়া আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক সমস্যা থেকে, টিকিয়ে রাখতে পারে অনেক সম্পর্ককে, এমনকি আপনি হয়ে উঠতে পারেন আগের চেয়ে ভাল কর্মীও। ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিরা সঠিক সময়ে এ বিরতিটি দিতে পারেন।

৪। তারা অন্যের অবস্থান থেকে ভাবার চেষ্টা করেন

কোনো বিষয়ে কাউকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করার পূর্বে উচ্চ ‘ই আই’ সম্পন্ন মানুষেরা ঐ ব্যক্তির অবস্থান থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। সে কেন এমনটা করল? তার এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে কী কাজ করছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে তারা সবার মধ্যে একধরণের মিলবন্ধন খুঁজে পান।

৫। ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিরা সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন

নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত কে-ইবা শুনতে চায়! তবে ‘ই আই’ সম্পন্ন ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন সমালোচনা ঠিক ভদ্র ভাবে না আসলেও তার মধ্যেও কিছু সত্যতা লুকিয়ে থাকে। তাই তারা সমালোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়াও সমালোচনা থেকে অন্যরা কিভাবে চিন্তা করে তাও বুঝতে পারেন তারা।

৬। অন্যদের মনোভাবও গুরুত্ব পায় তাদের কাছে

কোনো একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার পর তারা নিজের অজান্তেই ঐ ব্যক্তিকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এর ফলে তাদের কথাগুলি অন্যদের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তারা তা বুঝতে পারেন। তাই তারা কী বলছেন এর পাশাপাশি কিভাবে বলছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তাদের কাছে।

৭। তারা নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চান

নিজের ভুলগুলি স্বীকার করে আবার তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কাজটি সহজ না। কিন্তু ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট ব্যক্তিরা নিজেদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের ভুলগুলো ধরতে পারেন এবং ‘আমি দুঃখিত’ বা ‘আমি ক্ষমা প্রার্থী’ এ শব্দগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত তাই ক্ষমা প্রার্থনা করতে দ্বিধা করেন না।

৮। তারা ক্ষমা করে দেন

তারা বুঝতে পারেন যে কেউই আসলে নিখুঁত নয়। তাই ক্ষমা করতে না চাওয়া আসলে একটি ক্ষতকে নিরাময় হওয়ার সুযোগ না দেয়ার মতো। যখন দোষী ব্যক্তি তার জীবনে এগিয়ে চলছে, তখন অযথা অসন্তোষ ফুঁসে না রেখে ক্ষমা করার মাধ্যমে তারা নিজেদেরও এগিয়ে চলার সুযোগ করে দেন।

ছবিসূত্রঃquotesnpictures.com

৯। তারা তাদের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন

প্রচলিত কথায় আছে, “একটা পাখিকে হুট করে আপনার মাথায় এসে বসার থেকে হয়তো আপনি থামাতে পারবেন না, কিন্তু আপনার মাথায় বসে বাসা বানানোর থেকে তো থামাতে পারেন!”

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট ব্যক্তিরা এটি করার চেষ্টা করেন। কোনো বাজে পরিস্থিতিতে সহজাত কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর থেকে হয়তো তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু এর পরবর্তী বিষয়গুলো তারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তারা ঠিক করেন যে তাদের চিন্তাগুলো কোনদিকে ফোকাস করবেন। তারা সবধরনের নেতিবাচক অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে নিজেকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

ছবিসূত্রঃpbs.twimg.com

১০। তারা কাউকে বিচার করেন না

কারো সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে, পরিস্থিতি, প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিশ্লেষণ না করে কাউকে বিচার করে ফেলা বা কোনো আখ্যা দিয়ে ফেলা খুবই বাজে অভ্যাস। কিন্তু ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্টরা এ কাজটি কখনোই করেন না। তারা মানুষকে জানেন, বিশ্লেষণ করেন কিন্তু কারো উপর কোনো লেভেল এঁটে দেন না কখনোই। তারা জানেন যে, একজন মানুষের একটা খারাপ দিন এমনকি একটা খারাপ বছরও যেতে পারে।

অন্য সব দক্ষতার মতো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকেও নৈতিক, অনৈতিক দুই ভাবেই ব্যাবহার করা যায়। এর মাধ্যমে আমরা যেমন মুক্তি পেতে পারি অনেক নেতিবাচক অনুভূতি থেকে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে করতে পারি অনেক অর্জন, তেমনি অনেকে এ দক্ষতার মাধ্যমে অন্যকে অনেক নেতিবাচক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও প্রভাবিত করতে পারে। তাই অর্জন করতে হবে এর ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধের দক্ষতাও।

    তথ্যসূত্র

    ১) inc.com/justin-bariso/15-signs-youre-emotionally-intelligent-without-even-realizing-it.html

    ২) en.wikipedia.org/wiki/Emotional_intelligence

    ৩) www.psychologytoday.com/basics/emotional-intelligence

33
By Abdullah Ibn Mahmud
Like what you read ? Give it a star !

সারা বিশ্বজুড়ে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মুসলিমের কাছে রমজান মাস একটি পবিত্র সময়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে তারা এ সময়টি পার করে থাকে। কিন্তু কবে প্রথম এই মাসব্যাপী রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়? ইসলামের পূর্বেই বা রোজা কেমন ছিল? এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

রামাদান [رمضان] (ভাষাগত অপভ্রংশ: রমজান) শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদা বা আর-রামাদ থেকে, যার মানে প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। আরবি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথম ওহী পেয়ে নবী হয়েছিলেন ৬১০ সালের রমজান মাসেই। এ মাসের যে রাত্রিতে প্রথম আয়াতগুলো নাজিল হয় (সুরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত) সে রাতকে বলা হয় শবে কদর বা লাইলাতুল কদর (আরবিতে লাইল=রাত)। বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর, প্রসিদ্ধমতে সেটা ২৭ তারিখ ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন প্রার্থনা। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।

মক্কা শরিফ, সৌদি আরব

পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ আছে যে, নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত এসেছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাহিরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্নজাতিক পঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।

তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।

    “রমযান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:185]

মসজিদে নববী, মদিনা, সৌদি আরব

তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কুরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও।

    “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:183]

এমনকি মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররাম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনও ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল হযরত মুসা (আ) এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বনী ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।

মসজিদে নববী, মদিনা, সৌদি আরব

৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত। প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময়সূচী কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।

অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে রয়েছে তারাবিহ, যদিও সেটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথমদিকে জামাতের সাথে সে নামাজ আদায় করলেও পরে জামাতে করেন নি, পাছে সেটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তবে খলিফা উমার (রা) পুনরায় জামাতে আদায় করা শুরু করেন তার শাসনামলে। তবে শিয়াগণ তারাবিকে নবউদ্ভাবন বলে পরিত্যাগ করে থাকে। আট থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে, তবে মক্কার হারাম শরিফে ২০ রাকাতই আদায় করা হয়। উল্লেখ্য, ফজরের ওয়াক্ত হবার পূর্বে খেয়ে রোজা রাখাকে সাহরি আর সূর্যাস্তের পর খেয়ে রোজা ভাঙাকে ইফতার বলা হয়।

সৌদি আরবে তারাবির নামাজ পড়ানো হচ্ছে

অনেক খ্রিস্টানও রোজা রেখে থাকে, তবে কিছুটা ভিন্ন অর্থে। বাইবেলে বর্ণিত যীশু খ্রিস্ট নিজেও টানা ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। (Matthew 4; Luke 4)। আদি খ্রিস্টানরাও রোজা রেখেছিলেন বলে বাইবেলে প্রমাণ পাওয়া যায়। (Acts 13:1-5; 14:23; 27:9); এখনো অনেক ধর্মপ্রাণ রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ইস্টার সানডেরআগের ছয় সপ্তাহ এই প্রথা পালন করেন, একে Lent বলা হয়।

উল্লেখ্য, আরবিতে সিয়াম বললেও উপমহাদেশে ফার্সি “রোজা” শব্দটাই বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। আরবি “সাওম” শব্দ কিংবা সিরিয়াক “সাওমা” অথবা আদি হিব্রু “সম” শব্দের মূল অর্থ “বিরত থাকা”। শুধু খ্রিস্টান বা মুসলিম নয়, ইহুদী ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, কনফুসীয়, সনাতন, তাও কিংবা জৈনবাদ- সকল ক্ষেত্রেই আছে উপবাসের প্রচলন। রমজানের রোজা ছাড়াও মুসলিমদের জন্য শাওয়াল মাসের যেকোনো ৬ দিন, প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩-১৫ তারিখ, আরাফা দিবস, আশুরা দিবস ইত্যাদি দিবসে রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে ঈদের দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

একমাত্র যে ধর্মের ব্যাপারে রেকর্ড পাওয়া যায় যেখানে রোজা রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল সেটি হলো আদি পারস্যের ধর্ম বা জরথুস্ত্রুবাদ।

তবে মুসলিমদের মতো কঠোরভাবে রোজা রাখে কেবল ধার্মিক ইহুদীরাই। বছরে ছয় দিন তাদের বাধ্যতামূলক রোজা রাখতে হয়। সাব্বাথ (সাপ্তাহিক ছুটির শনিবার) দিবসে রোজা রাখা তাদের জন্য হারাম। ইয়ম কিপুর (হিব্রুতে ইয়ম=দিন, কিপুর=প্রায়শ্চিত্ত) এর দিন অবশ্যই অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। এদিন ইহুদী বিশ্বাস মতে, এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এবং তারা টানা ২৫ ঘণ্টা রোজা রাখে।

জেরুজালেমের দেয়ালের কাছে জড়ো হওয়া রোজা রাখা ইহুদীরা

নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন মদিনা এলেন, তখন তিনি দেখলেন ইহুদীরা আশুরার রোজা রাখছে। যদিও তারা ইসরায়েলে থাকতে ইহুদী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত, সেখানকার ইহুদী মাস তিশ্রির দশম দিবসে তারা রোজা রাখত (ইয়ম কিপুর)। আরবে তারা সেটার সাথে মিলিয়ে মুহাররামের দশম দিন আশুরার দিন রোজা রাখত। হযরত মুহাম্মাদ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেন রোজা রাখে? তারা উত্তর করল, এদিন আল্লাহ্‌ বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলেন এবং হযরত মুসা (আ) এজন্য রোজা রেখেছিলেন। তখন হযরত মুহাম্মাদ (স) মুসলিমদেরও এ রোজা রাখতে নির্দেশ দেন যেহেতু হযরত মুসা (আ) ইসলাম ধর্মেও নবী। তবে তিনি সাথে অন্তত একদিন অতিরিক্ত রাখতে বললেন, আগের দিন কিংবা পরের দিন। পেছনের কাহিনী মক্কাবাসীরা না জানলেও, তারা ঠিকই আগে থেকে এ দিন রোজা রাখত, এমনকি ইসলামের আগে হযরত মুহাম্মাদ (স) নিজেও রেখেছিলেন। রমজানের রোজা বাধ্যতামূলক হবার আগে এ রোজাটা সবাইকে রাখতে হত। রমজানের রোজা আসবার পর এ রোজা নফল হয়ে যায়।

মদিনায় ইফতার বিলি

অনেকের আগ্রহের বিষয় থাকতে পারে, নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও সাহাবীরা কী খেয়ে সাহরি বা ইফতার করতেন? নবীজী (সা) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর খেতেন, তা না থাকলে শুকনো খুরমা/খেজুর, আর পানি। এটাই ছিল ইফতার। একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সেহরির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে খেজুরগুলো ছোট ছোট, আরবীয় খেজুর যথেষ্ট বড়, অন্তত আমাদের দেশের তুলনায়।

আরবীয় খেজুর

সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ রমজান মাসটি পালন করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে, এবং পরম আগ্রহে সাদরে বরণ করে নেয় রমজান শেষে ঈদকে। সবাইকে রামাদান মোবারাক!

রমজান মোবারাক

    তথ্যসূত্র

    পবিত্র কুরআন
    মুসলিম শরীফ, ১০৯৯,
    বায়হাকি, মেশকাত : ১৭৪,
    নাসায়ি: ২১৬২,
    আবু দাউদ, ২৩৪৫
    বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ
    নিউ টেস্টামেন্ট, বাইবেল
    telegraph.co.uk/lifestyle/11524808/The-history-of-fasting.html

34
By Shakib Mustavee
Like what you read ? Give it a star !

মিশর নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিরামিডের ছবি। নীলনদের তীরে  সুপ্রাচীনকালে গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতার অনেকগুলো অনন্য নিদর্শনের মধ্যে নিঃসন্দেহে পিরামিড সবচেয়ে বিস্ময়কর ও রহস্যময়। প্রায় ৫০০০ বছর ধরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই পিরামিডকে ঘিরে। এমনকি আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও খুঁজে পাওয়া যায়নি পিরামিডের অনেক রহস্যের কূল কিনারা। তাই প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্যের অন্যতম মিশরের পিরামিডের উপর সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটি।
মরু প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাক পিরামিড আজও মানবজাতির কাছে এক বিস্ময়ের নাম source: www.planetware.com

মরু প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা পিরামিড আজও মানবজাতির কাছে এক বিস্ময়ের নাম
source: www.planetware.com
যে কারণে নির্মাণ করা হত পিরামিড

প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল পরকালে বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করতেন মৃত্যু হল নশ্বর দেহ থেকে পরকালে আত্মার স্থানান্তর। সেখানেও একটি জগত রয়েছে। সেখানেও প্রয়োজন হবে ধন, দৌলত ও অন্যান্য জাগতিক বিষয়াদির। তাই রাজা ও রাণীদের মৃত্যুর পর মৃতদেহের সাথে সাথে দিয়ে দেওয়া হত সোনা, রূপা ও মূল্যবান রত্নাদি। তাঁদের দেহকে সংরক্ষণ করা হত মমি বানিয়ে এবং হত্যা করা হত তাঁদের দাস দাসীদের যাতে পরকালে সেবার অভাব না হয়। কিন্তু সমস্যা হল এই মমি ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী একটি নিরাপদ স্থানে না রাখলে চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। তাই পিরামড তৈরিরও আগে নির্মাণ করা হত ট্রপিজয়েড আকৃতির মাস্তাবা নামক সমাধি।
বেইত খালেফে অবস্থিত একটি মাস্তবা source: www.nemo.nu

বেইত খালেফে অবস্থিত একটি মাস্তবা source: www.nemo.nu

কিন্তু প্রাচীনকালে রডের ব্যবহার ছিল না। সেকারণে এই মাস্তাবাগুলো বেশি উঁচু বানানো ছিল অসম্ভব। তাই কালক্রমে এই মাস্তাবাগুলোর পরিবর্তে স্টেপ পিরামিডের ডিজাইন গৃহীত হতে লাগল। এর পেছনের মূল কারণ পিরামিডের জ্যামিতিক গঠন। আমরা জানি কোন বিল্ডিং এর পুরো ওজন তার ভিত্তির উপর পড়ে। তাই উচ্চতা যত বেশি হবে ভিত্তি হতে হবে তত শক্ত। পিরামিডের ক্ষেত্রফল উচ্চতার সাথে সাথে হ্রাস পেতে থাকে। পিরামিডের ভিত্তির ক্ষেত্রফল উপরের স্তরগুলোর চেয়ে বেশি হওয়ায় এর উপর চাপও পড়ে কম এবং স্থাপনাটি শক্তিশালী হয়। তাই অনেক উঁচু সমাধি নির্মাণের একমাত্র রাস্তা ছিল পিরামিড শেপের ডিজাইন গ্রহণ করা।
306504620_sakkara7

প্রথম দিকের পিরামডগুলো ছিল অমসৃণ স্টেপ পিরামড যেগুলো মিশরের প্রথম তিনটি মহান রাজবংশের আমলে নির্মাণ হত। তবে চতুর্থ রাজবংশের সময় থেকে নির্মাণ করা শুরু হল প্রকৃত পিরামিড আকৃতির সমাধি। এছাড়া পিরামিডের উচ্চতা ক্রম হ্রাসমান হওয়ায় এর আরও একটি দার্শনিক তাৎপর্য ছিল। মনে করা হত পিরামিডগুলো যেন ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে পরজগতের পানে। পিরামিডের আর্কিটেক্টরা ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিত যারা ইমহোটেপ নামে পরিচিত ছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় তাঁদের কাজ শুধু আধ্যাত্মিক জগতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও ছিল পুরোহিত কেন্দ্রিক।
গিজার গ্রেট পিরামিড

মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত মৃত নগরী আল গিজা। এখানে দেখা পাওয়া যায় তিনটি বড় বড় পিরামিডের। এগুলো হল যথাক্রমে ফারাও খুফু, তাঁর ছেলে ফারাও খেফ্রে এবং খেফ্রের ছেলে মেনকাউরে এর পিরামিড। এঁরা সবাই ছিলেন মিশরের চতুর্থ রাজবংশের রাজা। তবে এই তিনটি তো বটেই মিশরের সবগুলো পিরামিডের মধ্যে ফারাও খুফুর পিরামিডটি হল সবচেয়ে উঁচু এবং আকারে সবচেয়ে বড়। একারণে ফারাও খুফুর পিরামিডটি গিজার গ্রেট পিরামিড নামেও বহুল পরিচিত। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ষড়বিংশ শতক থেকে, চতুদর্শ শতক পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ চার হাজার বছর এটিই ছিল মানব সৃষ্ট সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। তাই খুব সহজে অনুমেয় প্রযুক্তি ও প্রাচুর্যে প্রাচীনযুগে মিশরীয় সভ্যতা অন্য সভ্যতাগুলোর চেয়ে কত বেশি অগ্রসর ছিল।
গিজার গ্রেট পিরামিড source: travelingcanucks.com

গিজার গ্রেট পিরামিড source: travelingcanucks.com

গিজার গ্রেট পিরামিডটি তৈরির সময়কাল ২৫৬০ থেকে ২৫৪০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। প্রকৃত উচ্চতা ৪৮১ ফুট হলেও বর্তমান উচ্চতা ৪৫৫ ফুট। পিরামিডটির ভূমি বর্গাকৃতির এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিকেই ৭৫৬ ফুট। পাথরের বড় বড় চাঁই দিয়ে বানানো এই স্থাপনাটি আসলে কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল সেটা আজও গবেষকদের কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আরও অবাক করা বিষয়টি হল এর নির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ২৩ লক্ষ বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের। একেকটি পাথরের চাঁইয়ের ভর ছিল গড়ে কমপক্ষে ২ টন থেকে ১৫ টন। এমনকি কিছু কিছু চাঁইয়ের ভর ৫০ টনেরও বেশি ছিল। চাঁইগুলোর বেশির ভাগই ছিল লাইম স্টোনের। গুণে মানে অনন্য এই লাইমস্টোনগুলো আনা হত তুরা অঞ্চল থেকে। নীল নদের পূর্ব তীর থেকে জলপথে নিয়ে আসা হত এগুলো।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল কালের পরিক্রমায় চুরি হয়ে গেছে অনেকগুলো লাইম স্টোনের চাঁই যার বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানে। গিজার পিরামিডের ভেতরতে রয়েছে তিনটি কক্ষ। একটি বেইসমেন্টে। বাকি দুটি উপরে। উপরের কক্ষ দুটি ছিল যথাক্রমে রাণী ও রাজার সমাধি কক্ষ। এই কক্ষগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল গ্রানাইটের পাথর দিয়ে। প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়া আসা হয়েছিল সেগুলো। পিরামিডের ভেতরে ঢোকার সরাসরি কোন পথ কোন পথ ছিলনা।
গিজার পিরমিডে পর্যটকদের ঢোকার পথ source: www.emaze.com

গিজার পিরমিডে পর্যটকদের ঢোকার পথ source: www.emaze.com

তবে অনেকগুলো চোরাই পথ বানানো হয়েছে যুগে যুগে। এই পথগুলো দিকে ঢুকে গত পাঁচ সহস্রাব্দের বিভিন্ন সময় চুরি করে প্রায় শূন্য করে ফেলা হয়েছিল এক সময়ের ঐশ্বর্যমন্ডিত গিজার গ্রেট পিরামিড। তবে দর্শনার্থীদের জন্য এখন ভেতরে ঢোকার রাস্তা আছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা মিশরের পিরামিডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিত্রায়িত পিরামিডটিও হল গিজার গ্রেট পিরামিড। তাই গিজার গ্রেট পিরামিডকে পিরামিডের সমার্থক বললেও ভুল হবেনা।
নির্মাণ কাল ও শ্রমিকসংখ্যা

গিজার গ্রেট পিরামিডটি নির্মাণ করতে ঠিক কতজন শ্রমিক লেগেছিল সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে জনসংখ্যা ও খাদ্য সরবরাহ পর্যালোচনা এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রকে একত্রে করে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান গেছে। ধারণা করা হয় প্রায় ৪০০০-৬০০০ পাথর খোদাইয়ে দক্ষ রাজমস্ত্রী একটানা প্রায়  বিশ বছর সময় ধরে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিল। তবে নীলনদের দান প্রাচীন মিশর বছরে তিনমাস ডুবে থাকত পানির নিচে। অনুমান করা হয় এই সময়গুলোতে লক্ষাধিক কৃষকও তাদের সাথে যোগ দিত।
পিরামিড নির্মাণরত শ্রমিক source: geekstopten.com

পিরামিড নির্মাণরত শ্রমিক source: geekstopten.com

এছাড়া দাস, যুদ্ধবন্দী ও অন্যান্য শ্রমিকরা তো ছিলই। শ্রমিক ও মিস্ত্রিদের খাবার বাবদ প্রতিদিন ২০০০০০ লক্ষ পিস রুটি ও ১০০০০০ পেয়াজের প্রয়োজন হত। পিরামিডের আসে পাশে ছিল শ্রমিকদের থাকার জায়গা। এই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল কয়েকটি গ্রাম।

আজকের দিনে একটি পিরামিড তৈরি করতে তাহলে কত খরচ পড়ত?ভাবতেই অবাক লাগে গবেষকরা সেটিও হিসাব কষে দেখিয়েছেন। আজকের বাজার মূল্যে গিজার গ্রেট পিরামিডটি তৈরি করতে প্রায় ৫ বিলিওন ডলার ব্যয় করতে হত। কিন্তু মিশরের এই গ্রেট পিরামিডের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতই বেশি যে নিছক কাগজের নোটে এর মূল্য হিসাব করা মূল্য নেহায়েত বোকামো।

তথ্যসূত্র

১) http://traveltips.usatoday.com/able-enter-pyramids-egypt-106535.html

২) http://www.ancientnile.co.uk/pyramids.php

৩) http://www.livescience.com/18589-cost-build-great-pyramid-today.html

৪) http://www.nationalgeographic.com/pyramids/khufu.html

35
By Shah MD. Minhajul Abedin
Like what you read ? Say it !
Like

গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারতের বুক চিরে বয়ে চলা এক নদীর নাম গঙ্গা। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের সীমানা ভাগ হওয়ার অনেক আগেই, গঙ্গা নদীর একটি শাখা পূর্ব বাংলার শস্য-শ্যামল প্রকৃতির বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে শেষ ঠিকানা করে নিয়েছিলো। নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) বইয়ে বুড়িগঙ্গার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন, “পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের (১৬৬০) নকশায় দেখা যাইতেছে পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরাগঞ্জের ভিতর দিয়া দক্ষিণ শাহবাজপুরের দিকে। কিন্তু ঐ নকশাতে আরেকটি প্রাচীন পথেরও ইঙ্গিত আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়ে ঢাকার পাশ ঘেঁষে মেঘনা খাঁড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই। ঐ বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত।”

Frederick William Alexander কর্তৃক ১৮৬১ সালে আঁকা বুড়িগঙ্গার ছবি; Source: collections.vam.ac.uk

গঙ্গার এই বুড়িমা গঙ্গা থেকে আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। গঙ্গোত্রী হিমবাহের সাথে লেনদেন চুকে গেলেও নামের সাথে গঙ্গা শব্দটি শ’খানেক বছর ধরে জুড়ে রেখেছে এই নদী। মাঝে এই নদী দেখেছে কত পরিবর্তন। মোঘল সুবাদারেরা অনেকেই এই নদীর প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরেই গড়ে উঠতে থাকে জমজমাট ঢাকা নগরী। নদীর তীরে ঘেঁষে গড়ে উঠা এই জনপদকে আরেকটু রাঙ্গিয়ে দিতে রাতে নদীর তীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোঘল সুবাদার মুকাররম খাঁ। বর্ষাকালে এই নদীতীরের জনপদকে জলমগ্ন ভেনিস নগরীর সাথে গুলিয়ে ফেলতেন অনেক ইউরোপিয়ান বণিক। এমনকি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি ঢাকার সেই আদি জনপদকে বিনামূল্যেই ভেনিস দেখার ব্যবস্থা করে দিতো। ঢাকার নদীতীরের স্থানের নামের সাথেও জড়িয়ে আছে নদীর ইতিহাস। নদীর অদূরে এখন যেখানে ‘নারিন্দা’, ঢাকার ইতিহাসে আদিকালে সেই এলাকার নাম ছিলো ‘নারায়ণদিয়া’ বা ‘নারায়ণদি’। প্রচলিত ঢাকাইয়া বাংলায় দ্বীপের অপভ্রংশ দাঁড়ায় ‘দিয়া’ বা ‘দি’। বর্ষাকালে এই এলাকা জলমগ্ন দ্বীপের মতো দেখাতো বলে লোকে হয়তো কোনো এককালে এই এলাকার নামই দিয়ে দিলো ‘নারায়ণের দ্বীপ’ বা ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত দীপ’।

বুড়িগঙ্গার স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে সময়ও পেরিয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ের ক্ষুধার্ত গর্ভে নদীর তীরে গড়ে উঠা বহু অট্টালিকাকে নিজের পেটে টেনে নেয়। মিল ব্যারাকের পুলিশ ট্রেনিং স্কুল চলে গেছে রাজারবাগে। এরও অনেক আগে ক্ষুরধার স্রোতে মিল ব্যারাকের কাছের আলমগঞ্জের ‘পাঠান কোট’ বা ‘পাঠান দুর্গে’র মতো অনেক সুরম্য কারুকাজওয়ালা অট্টালিকার আর দুর্গ হারিয়ে গেছে। ১৯৮৪ সালে মিল ব্যারাকের পূর্বাংশে স্থাপন করা হয়েছে ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুল।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ঢাকা; Source: British Library

মোঘল আমল থেকেই নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরের উন্নয়ন করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই আমলের খরস্রোতা বুড়িগঙ্গার তীরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করা ছিলো বেশ মুশকিল। তাই ঢাকার কমিশনার চার্লস থমাস বাকল্যান্ড বুড়িগঙ্গার তীরে বাধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। ১৮৬৪ সালের সেই সময়টাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নদীর তীরে যে বাড়িঘরগুলো আছে তাদের সামনের দিক অনেকখানি বাধাই করে দেওয়া হবে। এতে নদীর পাড় দেখতে অনেকটা স্ট্যান্ডের মতো দেখাবে। কেমন দেখাবে তার চেয়ে বড় কথা ছিলো এই বাধ কাজ করবে কিনা। বাঁধের শুরু হওয়ার পর দেখা গেলো নদীর পাড় পুরোপুরি বাধিয়ে দিলে শহরের লেভেল নদী থেকে বেশ উঁচুতে থাকবে। প্রথম বছর বাঁধ হাটিহাটি পা করে নর্থব্রুক হল ঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ঢাকার বেশ কিছু লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়- সরকারিভাবে পুরো বাঁধ নির্মাণের খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় ঢাকার ধনী ব্যক্তিরা বাঁধ নির্মাণে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন।

বাঁধের পূর্ব অংশটুকু তৈরি হয়েছিলো রূপলাল আর রঘুনাথ সাহার যৌথ উদ্যোগে, পশ্চিমের অংশের কাজে সহায়তা করেছিলেন নবাব আবদুল গণি, বাদবাকি মাঝের অংশটুকু নির্মিত হয়েছিলো সরকারি খরচে। এভাবেই তৈরি হতে থাকে ‘বাকল্যান্ড বাঁধ’। পরে বিভিন্ন সময় প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁধের পরিধি বাড়তে থাকে।

ছবিতে ১৮৮০ সালে বাকল্যান্ড বাঁধের অংশবিশেষ; Source: en.banglapedia.org

তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঁধের যে অংশগুলো নির্মিত হয়েছিলো, সেগুলো কেউই কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি। তবে বাঁধের মালিকানা হস্তান্তর না করলে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ে কর্তৃপক্ষের কাঁধেই। সময়ে সময়ে বুড়িগঙ্গা তার গতিপথ বদলেছে। বাকল্যান্ড বাঁধের ফ্রেমে বাঁধা যায়নি এই নদীকে। ১৮৬৪ সালে যে বুড়িগঙ্গা বয়ে যেত লালবাগ কেল্লা, রায়েরবাজার আর পিলখানা ঘাটের ধার ঘেঁষে, সময়ের সাথে সেই বুড়িগঙ্গা সরে যেতে থাকে দক্ষিণে। উত্তরে জমতে থাকা পলি জন্ম দিতে থাকে শহরের আরেকটি অংশকে।

১৮৮৫ সালে বুড়িগঙ্গার তীর অনেকটা এরকমই ছিলো; Source: The British Library

মোঘল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার সন্তান ঢাকার বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। বাকল্যান্ড বাঁধের তীরে গড়ে উঠা এই শহরের উন্নয়নের জঞ্জাল এই নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। চামড়া শিল্পে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানিতে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই চামড়া শিল্পের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে অশোধিত বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।

বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য; Source: Allison Joyce/Getty Images

সাম্প্রতিক এক হিসেবানুযায়ী পাঁচ শতাধিক ট্যানারীর ৪.৭৫ মিলিয়ন লিটার বিষাক্ত বর্জ্য এসে বুড়িগঙ্গাতে এসে পড়ছে। ট্যানারি থেকে বাদ যাওয়া চামড়ার অংশ থেকে শুরু করে বিষাক্ত সব ভারী ধাতুর শেষ ঠিকানা এই বুড়িগঙ্গা। অনেক কম মূল্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্ববাজারে নিজেদের স্থান ধরতে গিয়ে আমরা বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তুলেছি ট্যানারি, যার অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রতিটি ফোঁটা এই নদীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের গ্রিন ক্রস আর ব্ল্যাকস্মিথ ইন্সটিটিউট এর দেওয়া তথ্য অনুসারে হাজারীবাগ এবং আশপাশের এলাকায় পৃথিবীর দূষিত স্থানগুলোর মাঝে পঞ্চম।

হাজারীবাগ এলাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত স্থানগুলোর একটি; Source: Allison Joyce/Getty Images

এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। জলযান আর গৃহস্থালি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২১,৬০০ ঘন মিটার কঠিন বর্জ্যের ঠাই হয় বুড়িগঙ্গায়।

শুধু কি তা-ই? ট্যানারি, জলযান আর গৃহস্থালি বর্জ্য! নদীর তীর জুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট বড় পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ, রঙ আর বিষাক্ত দ্রব্যাদি এই নদীকে কোনো জলজ প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী করে দিয়েছে।

বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে রঙ; Source: thethirdpole.net

বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে যেখানে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে, সেখানে কি আদৌ কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব? সদরঘাট সহ বিভিন্ন এলাকার পানির নমুনা সংগ্রহ করে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নয়, পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের যত ধরনের সূচক আছে সব ধরনের সূচকেই বুড়িগঙ্গার পানি জলজ প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী। এই পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ আর ভারী ধাতুর অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থেকে আসলেই কঠিন। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এই নদীতে।তবে শহর থেকে যত দূরে যাওয়া যায় এই নদীতে দূষণের মাত্রা ততই কম। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে দূষণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কমে আসে।

বুড়িগঙ্গার দূষিত পানির বর্তমান অবস্থা; Source: assets.irinnews.org

যে নদীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী যদি মরে যায় তাহলে ঢাকা কি বেঁচে থাকবে? নদীর তীর জুড়ে গড়ে উঠা সকল শিল্প কারখানাকে অবিলম্বে তাদের বর্জ্যকে পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে বাধ্য করতে না পারলে এই নদীকে বাঁচিয়ে তোলা খুবই কঠিন। পলিথিনের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। নদীর তীর জুড়ে বসবাস করা কিংবা নদীর উপর অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষকে দূষণের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। অন্যথায় প্রতিদিন একটু একটু করে এই নদীর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবে ঢাকার মানুষ।

Feature Image: collections.vam.ac.uk

36
By Monem Ahmed
বিজ্ঞানীদের এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষার কথা ভাবলে আমাদের মাথায় কেমন চিত্র ভেসে ওঠে? মনে হয় গোমড়ামুখো কিছু বিজ্ঞানী রাত-দিন এক করে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে জটিল সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন আর গাদা গাদা অংক কষছেন। কিন্তু বিজ্ঞানের সব পরীক্ষা এমন রসকষহীন ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া নয়। কিছু পরীক্ষা অনেকটা অদ্ভুতুড়ে ধরণের হয়, কিছু পরীক্ষা আবার মানুষকে বিনোদনও দেয়। আজকের লেখায় আমরা বিদ্যুৎ আবিষ্কারের প্রথমদিকের এমন কিছু কাণ্ড-কারখানা সম্পর্কে জানবো।
আনন্দদায়ক বা ততটা জটিল ছিল না বলে এসব পরীক্ষা কিন্তু হেলাফেলা করার মতো কোনো বিষয় নয়। বিদ্যুৎ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে এদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক এমন তিনটি অদ্ভুত বিষয় সম্পর্কে।
দ্য ফ্লাইং বয় এক্সপেরিমেন্ট

দ্য ফ্লাইং বয়; Source: diatrope.com
একে পরীক্ষা না বলে হয়তো প্রদর্শনী বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ বিজ্ঞানী স্টিফেন গ্রে এটিকে ঠিক পরীক্ষা হিসেবে পরিচালনা করতেন না। তিনি তার বিদ্যুৎ বিষয়ক জ্ঞান ব্যবহার করে জনতাকে বিনোদন দেয়ার জন্য এটি পরিচালনা করতেন। দর্শকরা বিদ্যুতের জাদু দেখে আনন্দ পেলেও এ পরীক্ষায় অংশ নেয়া ছেলেটির জন্যও যে এটি আনন্দদায়ক হতো এমনটি বলা চলে না। পরীক্ষাটি সম্পর্কে জানার আগে চলুন বিদ্যুৎ বিষয়ে তখনকার জ্ঞান কোন স্তরে ছিল তা একটু জেনে নেই।
সময়টা ছিল আঠারো শতকের শুরুর দিকে, বিদ্যুৎ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের উল্লেখযোগ্য অর্জন বলতে ছিল কেবল অটো ভন গুয়েরিকের সালফার বল। কাপড়ের সাথে ঘষে এতে বেশ ভালো পরিমাণ বৈদ্যুতিক আধান জমা করা যেত। তবে বিদ্যুৎ পরিবহন সম্পর্কে জ্ঞান তখন ছিলো প্রায় শূন্যের কোঠায়। ১৭২৯ সালের দিকে স্টিফেন গ্রে প্রথম লক্ষ্য করেন বিভিন্ন পদার্থ বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যুৎ পরিবাহী। যেমন ধাতব বস্তু বেশ ভালো বিদ্যুৎ পরিবহণ করে, অন্যদিকে কাঠ বা কাপড় বিদ্যুৎ পরিবহনে তেমন একটা সায় দেয় না।
তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, ভূমি নিজেও বিদ্যুৎ পরিবাহীর ন্যায় আচরণ করে। কপার তার ব্যবহার করে তিনি প্রায় ৩০০ ফুট দূরের এক গুয়েরিক বল থেকে আরেক গুয়েরিক বলে বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার এ জ্ঞানকে জনতার সামনে প্রদর্শনের জন্য একটি পরীক্ষার ছক সাজালেন। এটি করার জন্য তিনি একটি বালককে সিল্কের দড়ির সাহায্যে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিতেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ পরিবাহী ভূমি থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। যেকোনো ধরনের পরিবাহী থেকে সে সম্পূর্ণ পৃথক থাকতো।

স্টিফেন গ্রে; Source: youtube.com
এরপর তিনি ছেলেটির পায়ে একটি চার্জিত গুয়েরিক বল স্পর্শ করতেন। এতে ছেলেটির শরীর চার্জিত হতো। এবার শুরু হতো তার বিদ্যুতের জাদু দেখানোর পালা। কখনো তিনি ছেলেটির নিচে মেঝেতে ফুলের পাপড়ি রেখে দিতেন। ছেলেটির শরীর চার্জিত হওয়ায় ফুলের পাপড়িগুলো তার দিকে আকর্ষিত হতো এবং ছেলেটিকে কেন্দ্র করে শূন্যে ভাসতে থাকতো। কখনো বা তিনি একটি বই মেলে ধরতেন ছেলেটির হাতের সামনে। ছেলেটি বইয়ের পাতা স্পর্শ না করেই পাতা ওল্টাতে পারতো। জনতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেত এসব দৃশ্য দেখে।
কখনো এ ক্ষমতা ছেলেটি দর্শকসারির কাউকেও দিত। আগ্রহী কাউকে ডেকে এনে তাকে একটি অপরিবাহী ড্রামের ওপর দাঁড় করানো হতো। তারপর ছেলেটি তাকে স্পর্শ করতো। অপরিবাহী বস্তুর ওপর দাঁড়ানো বলে তিনি কিছু অনুভব করতেন না, কিন্তু চার্জিত হতেন। একটু পর দেখা যেত সে দর্শকও বালকটির মতো বৈদ্যুতিক ক্ষমতা লাভ করেছেন। তবে স্থির-বৈদ্যুতিক আকর্ষণের খেলা এখানেই শেষ নয়। তার সর্বশেষ পরীক্ষাটা অন্যগুলোর মতো নিরীহ ছিল না।
তিনি জানতেন চার্জের পরিমাণ অধিক হলে ডিসচার্জের সময় স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়। তিনি ছেলেটিকে আরো চার্জিত করতেন। হলের বাতি ঢিম করে দেয়া হতো। এরপর ডেকে আনা দর্শককে অপরিবাহী বস্তু থেকে নামিয়ে এনে বলতেন ছেলেটিকে স্পর্শ করতে। যখন লোকটির আঙ্গুল ছেলেটির আঙ্গুলের দিকে এগোত, সবাই একটি জোরালো শব্দ শুনতে পেতো আর দেখতো উজ্বল বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলে যাচ্ছে দু’জনের আঙ্গুলের মাঝে। এ শক ছেলেটির জন্য সুখকর হতো বলে মনে হচ্ছে?
তবে স্টিফেন গ্রে’র এ পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষ বিদ্যুতকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। এটি সেসময়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠছিল। গোটা ইউরোপেজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি হতে শুরু করে। ১৭৩১ সালে তার এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ রয়্যাল সোসাইটি তাকে সর্বপ্রথম কপলি পদক প্রদান করে। বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য এ পদকটি এখনো দেয়া হয়ে থাকে।
লেইডেন জার ও এক পাদ্রীর গল্প

লেইডেন জার; Source: wikipedia
১৭৪৫ সালের দিকে ডাচ অধ্যাপক পিটার ভন ম্যাশেনব্রোক বৈদ্যুতিক আদান জমা রাখার বিষয়টিকে সাধারণ গুয়েরিক গোলক থেকে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে আসেন। বিশেষভাবে নির্মিত কাঁচের বোতলের মাধ্যমে ‘লেইডেন জার’ তৈরি করেন তিনি। এর গঠন ছিল একদমই সাধারণ। একটি কাঁচের বোতলের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে ধাতব পদার্থ দিয়ে ঘিরে রাখা হতো। ক্যাপাসিটরের গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এটিই ছিল ক্যাপাসিটরের সর্বপ্রথম সংস্করণ। কাঁচের দেয়ালের দু’পাশের পরিবাহী ধাতব পাতগুলো কাজ করতো তড়িৎদ্বার হিসেবে, আর মাঝখানে কাঁচ ডাই-ইলেকট্রিক পদার্থ।
এ তড়িৎদ্বারগুলোকে গুয়েরিক গোলকের মাধ্যমে চার্জ দেয়া যেতো। এরপর যখন একটি পরিবাহী তার দ্বারা ভেতরে ও বাইরের দেয়ালকে যুক্ত করে দেয়া হতো তখন এটি স্ফুলিঙ্গ ও শক সহ ডিসচার্জ হতো। লেইডেন জার অসাধারণ এক উদ্ভাবন ছিল সে সময়, কারণ এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক চার্জ কেবল জমা করে রাখাই যেত না, পাশাপাশি একে বহন করে অন্য কোথাও নিয়েও যাওয়া যেত ডিসচার্জের জন্য। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কৌতূহলী মানুষজন এ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন তখন। তবে এক খ্রিস্টান পাদ্রী যা করেছেন তার জুড়ি মেলা ভার।
১৭৪৬ সালে ফরাসী পাদ্রী জ্যান-অ্যান্টোনি নোলেট তার আশ্রমে এক পরীক্ষার আয়োজন করেন। তিনি প্রায় এক মাইল জায়গা জুড়ে দু’শ পাদ্রীকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে দেন। এরপর তাদের প্রত্যেকের হাতে পঁচিশ ফুট লম্বা পিতলের পাত ধরিয়ে দেয়া হলো, পাশাপাশি দুজন একই পাত ধরে দাঁড়ালেন। এভাবে সবাই সংযুক্ত হলেন একে অপরের সাথে। নলেট এবার বিশেষভাবে নির্মিত, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং পুরোপুরি চার্জড একটি লেইডেন জার নিয়ে হাজির হলেন। তিনি প্রথম ও শেষ পিতলের পাতকে যুক্ত করে দিলেন লেইডেন জারের দুই তড়িৎদ্বারের সাথে।

নোলেট এর এক্সপেরিমেন্ট; Source: sciencesource.com
মুহূর্তের মধ্যে লেইডেন জার থেকে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ল বেচারা পাদ্রীদের শরীরে। তারা সবাই যেন সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলেন, বজ্রাহত ব্যক্তির মতো তাদের মাংসপেশি সংকুচিত হয়ে জমাট বেঁধে গেল। নোলেট তার এ পরীক্ষার মাধ্যমে আসলে বুঝতে চেয়েছিলেন, মানুষের শরীরের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ কতটা দ্রুত প্রবাহিত হয়। এ পরীক্ষা শেষে স্বাভাবিকভাবেই তার সিদ্ধান্তে ছিল ‘অতি দ্রুততার সাথে’।
নোলেটের মূল লক্ষ্য ছিল কীভাবে দ্রুত বার্তা আদান-প্রদানের জন্য বিদ্যুৎকে ব্যবহার করা যায়। এ জন্য তিনি এ নিয়ে আরো পরীক্ষা করতে আবার পাদ্রীদের সাহায্য চাইলেন। কিন্তু ন্যাড়া আর কয়বার বেলতলায় যায়? পাদ্রীরা প্রথমবারের ‘সুখকর’ অভিজ্ঞতা ভোলেননি, তাই তারা সহায়তা করতে অস্বীকার করলেন। আর কোথাও কোনো সুযোগ না পেয়ে শেষে তিনি ধর্না দিয়েছিলেন ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে। রাজা তার কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে তার পরবর্তী পরীক্ষার জন্য ১৮০ জন রাজকীয় পাহারাদার দিলেন। বেচারা পাহারাদারদের কপাল!
ইলেকট্রিক কিস

ইলেকট্রিক কিস; Source: wikipedia
সেসময় বিদ্যুৎ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের এসব গবেষণা মানুষকে আকৃষ্ট করে, নোলেট, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, কুলম্বদের মতো বিজ্ঞানীদের কাজ দেখে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ নিয়ে। এ আগ্রহের ফলে একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে, ছোটখাট বৈদ্যুতিক শক নেওয়া তখন ফ্যাশন হয়ে ওঠে। বার বা পাবে রাখা লেইডেন জার থেকে মানুষ এ শক নিত। এ শক নেয়ার বিষয়টিই পরিচিত হয়ে ওঠে ‘ইলেকট্রিক কিস’ নামে।
ওপরের এসব পরীক্ষা বা প্রদর্শনীগুলো উদ্ভট হলেও এসব বিদ্যুৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। কৌতূহলি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে বিদ্যুৎ নিয়ে জানতে, কাজ করতে। এসময়টি ছিল এ বিষয়ে জ্ঞানের ভিত গড়ার সময়। সে ভিতের ওপরই আরো বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ভিশনারিদের কাজের ফলে সম্ভব হয়েছে আজকের ইলেকট্রনের যুগ, আমাদের আধুনিক সভ্যতা।
তথ্যসূত্র: Conquering the Electron by Derek Cheung , Eric Brach , page (12-16)
ফিচার ইমেজ: devianart.com

37
By Tiasha Idrak
নূর হোসেনকে মনে পড়ে? নিজের শরীরকে ক্যানভাস বানিয়ে যিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে? “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”, তার বুকে-পিঠে সাদা রঙ দিয়ে সেই লেখা, যার জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছিল? অথচ এরই জন্য তিনি এদেশের ইতিহাসের পাতায় হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক।
’৫২ থেকে ’৭১, বাংলার ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহু নিদর্শন আছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও জনমানুষের অধিকারের দাবিতে, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিদর্শন আছে অনেক। ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’১৩ এর গণজাগরণ মঞ্চ, এমনকি সাম্প্রতিককালের কোটা সংস্কার আন্দোলন – দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে এসেছে সাধারণ মানুষ। বিশ্বজুড়ে বহু দেশেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রাণের দাবিতে সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। অনেক সময়ই তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল যেমন অভিনব, তেমনই শক্তিশালী। বিশ্বজুড়ে এমনই কতগুলো প্রতিবাদের নিদর্শন এখানে দেয়া হলো।
১. রাস্তা জুড়ে শ্রমিকদের হেলমেট বিছিয়ে রাখা – ইতালি
২০১২ সালের অক্টোবর মাস। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত ইতালিতে অনেকটা হুট করেই বহু কারখানা বন্ধ করে দেয় মারিও মন্টি সরকার। একে অর্থনৈতিক সঙ্কট তার উপর হঠাৎ বেকারত্বের দরুন দিশেহারা হয়ে পড়ে তৎকালীন সাধারণ শ্রমিকরা। পেটের তাগিদে, কারখানা খোলার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক। এসময় সার্ডিনিয়ার শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের একটি অভিনব উদাহরণ উপস্থাপন করেন।

কারখানা খোলা রাখার দাবিতে ইতালির শ্রমিকদের রাস্তায় হেলমেট রেখে প্রতিবাদ, Source- trueactivist.com
প্ল্যাকার্ড বা স্লোগান নয়, বরং শ্রমিকদের পরনের হেলমেটখানা রাস্তায় রাখেন একে একে সকলে। একেকটি হেলমেট যেন একেকজন শ্রমিক, তাদের বেদনা।
ইতালির রাস্তায় শোভা পায় সারি সারি, হাজার হাজার হেলমেট। শ্রমিকের হেলমেটের রঙে হলুদ হয়ে যায় ইতালির ধূসর রাস্তাগুলো।
২. পুলিশের উপর ইইউ খামারিদের দুগ্ধ কামান – বেলজিয়াম

বেলজিয়ামের পুলিশের উপর দুগ্ধকামান; Source- trueactivist.com
২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস থেকে হাজার হাজার দুগ্ধ খামারি ট্র্যাক্টরে চেপে উপস্থিত হন ব্রাসেলস শহরে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সামনে এসে জড়ো হন তারা, উদ্দেশ্য স্থানীয় খামারিদের স্বার্থবিরোধী ইইউ এর নীতিকে প্রতিহত করা। ইইউ এর প্রস্তাবিত নীতির কারণে ডেইরি বাজার থেকে স্থানীয় খামারিদের বের করে দেয়ার আশঙ্কায় তারা এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশী আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা গেলে খামারিরা নিজেরাই পুলিশের উপর তাদের ‘দুগ্ধ কামান’ চালান।
৩. মানুষের বদলে জুতো দিয়ে র‍্যালি – ফ্রান্স
২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর । বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে একটি র‌্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য প্যারিসে জমায়েত হবার কথা ছিল দেশ-বিদেশের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের। কিন্তু এর কিছুদিন আগে অর্থাৎ নভেম্বরের ১৩ তারিখে প্যারিস হামলায় ১৩০ জনের মৃত্যু হবার পর দেশটিতে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। এর কারণে যেকোনো ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেয় ফ্রান্স সরকার। জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী র‌্যালি বাতিল হয়ে যাবার কারণে আশাহত হন অনেকেই। কিন্তু র‌্যালিটির আয়োজক একটি এনজিও আভাজ (Avaaz.org) থেমে যেতে চায়নি, তাই তারা প্রতীকী আন্দোলনের একটি অভিনব উপায় বের করেন, অংশগ্রহণকারীদের জুতো জোড়া পাঠিয়ে দেয়ার আহবান জানান। তাদের ডাকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। বাক্সে বাক্সে উপস্থিত হয় হাজার হাজার জুতো। র‌্যালির দিন দেখা যায় প্যারিসের Place de la République এ হাজার হাজার জুতো সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ যেন যে র‌্যালিটি সেদিন হবার কথা ছিল তারই প্রকাশ।

মানুষের বদলে জুতার র‌্যালি ; Source- huffingtonpost.ca
এমনকি পোপ ফ্রান্সিস নিজেই তাঁর এক জোড়া জুতো পাঠিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
সেদিন প্যারিসে ঠিক কতগুলো জুতো রাখা হয়েছিল বলতে পারবেন কি? প্রায় ২২,০০০ জোড়া জুতো!
৪. দ্য আমব্রেলা মুভমেন্ট – হংকং
চীনের শাসনাধীন হংকং এর রাস্তায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ, ছাতা হাতে অবস্থান কর্মসূচিতে।

দ্য আমব্রেলা মুভমেন্ট ;Source- mantlethought.org
তাদের দাবি, রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। বিস্তারিত বলতে গেলে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হংকং এর শাসক তথা চিফ এক্সিকিউটিভের নির্বাচন। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বের হবার পর দেশটির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে চীন। চীনের মতে, চীফ এক্সেকিউটিভ পদটি নির্বাচনের জন্য হংকং এর চীন ঘেঁষা গোষ্ঠী এবং টাইকুনদের দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিটি যথেষ্ট। আমব্রেলা মুভমেন্টের আন্দোলনকারীরা এর বিরুদ্ধে ছাতা হাতে অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেয়। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে ছাতাধারী মানুষে ছেয়ে যায় হংকং এর রাস্তাগুলো, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় অনেকগুলোতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতকিছু থাকতে ছাতা কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে আন্দোলনকারীরা বলেন, পুলিশের পিপার-স্প্রে থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করা হয়। এভাবে এ ছাতাই তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এসে পুলিশী বাধার দরুন ৩ মাসব্যাপী এ অবস্থান কর্মসূচি ভেস্তে যায়, তারপরও এটি হংকং এর বৃহৎ জনআন্দোলনের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. ‘হেড ইন দ্য স্যান্ড’ প্রতিবাদ – অস্ট্রেলিয়া
২০১৪ সালের নভেম্বরের ১৩ তারিখে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত বন্ডি সমুদ্র সৈকতে জড়ো হয় ৪০০ জন মানুষ। এর কিছুদিন পরই নভেম্বরের ১৫-১৬ তারিখে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের এজেন্ডায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি রাখতে সারা বিশ্বের অধিকাংশ নেতাদের সায় থাকলেও অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটের বিরোধিতার কারণে সেটা এজেন্ডাভুক্ত করা হয়নি।

হেড ইন দ্য স্যান্ড; Source- riledupjournal.com
অ্যাবটের জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর বিপদকে অস্বীকার করাটা অনেকটা উট পাখির বালুতে মাথা গোঁজার সামিল, এমনটাই মনে করেছিল অনেকেই। আর এটাই মাথায় রেখে তারা জড়ো হয়েছিল বন্ডি সৈকতে, আর একসাথে মাথা গুঁজে ফেলে তারা বালুতে। বিপদ দেখে উট পাখি যেমন বালুতে মাথা গুঁজে, তেমনই অ্যাবটও জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখেও না দেখার ভান করেন, অস্বীকার করেন। অথচ এটা করে কিন্তু বিপদের কোনো সমাধান হয় না- এমনটাই বোঝাতে বালুতে মাথা গুঁজে প্রতীকী প্রতিবাদ করেন তারা।
৬. মোমবাতি আন্দোলন – দক্ষিণ কোরিয়া
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম হল মোমবাতি প্রজ্বলন। একটি মোমবাতির কোনো শক্তি নেই, অথচ শতটি মোমবাতির শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি। এখন মোমবাতির সংখ্যা হাজার হয়, আরো বেশি। এখন যদি সেই মোমবাতির সংখ্যা হয় লক্ষাধিক, তাহলে?
কতখানি শক্তিশালী সেই প্রতিবাদ? কী করতে সক্ষম হবে সেই গণ আন্দোলন?

দক্ষিণ কোরিয়ার মোমবাতি আন্দোলন; Source- abc.net.au
ঠিক এ প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেছে দক্ষিণ কোরিয়ার এই গণ আন্দোলনে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতি পার্ক গিউন হাই এর অব্যাহতির দাবিতে দক্ষিণ কোরিয়ার রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষ। হাতে তাদের মোমবাতি। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া এই আন্দোলন চলে প্রায় ৬ মাসব্যাপী। দেইগু থেকে সিউল, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি শহরে গণ আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তো শেষমেশ এই আন্দোলনের ফল? রাষ্ট্রপতি পার্কের অভিশংসন ঘটাতে বাধ্য হয় দক্ষিণ কোরিয়ো শাসক গোষ্ঠী।
অথচ এটি একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছিল।
সফল হোক বা ব্যর্থ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সময়ের সাথে সাথে হতে থাকবে বারবার। যা কিছু ন্যায় এবং কল্যাণকর তার জয় কামনা করা, তার জন্য চেষ্টা করার সৎ সাহস কামনা করে এখানেই শেষ করছি।
ফিচার ছবিসূত্র- qz.com

38
By Mehedi Hasan Nirob

হলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালকদের একটি তালিকা করা হলে একদম উপরের দিকে থাকা নামগুলোর মধ্যে জেমস ক্যামেরন যে থাকবেন এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। তবে বেশীরভাগ মানুষ তাকে শুধু পরিচালক হিসেবে চিনলেও তিনি কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশী কিছু। কানাডিয়ান এই চলচ্চিত্র নির্মাতা একাধারে একজন প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ার। গভীর সমুদ্র নিয়েও তার অনেক কৌতুহল। নিজের বানানো সাবমেরিন দিয়ে সাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ডুব দিয়ে এসেছেন। তিনি তার চলচ্চিত্রে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন সেগুলোকে একেকটা মাইলফলক হিসেবেও ধরা যায়। অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তি তার অ্যাকশনধর্মী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্রগুলোকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।

এখানেই কেটেছে জেমস ক্যামেরনের শৈশব

তার জীবনের গল্পটাও কিন্তু চিত্রনাট্যের মতোই অনেকটা।

জেমস ফ্রান্সিস ক্যামেরনের জন্ম ১৯৫৪ সালে কানাডার অন্টারিওতে। তার মা ছিলেন একজন আর্টিস্ট এবং বাবা ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার পরিবার যখন ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসে তখন তার বয়স ১৭ বছর। সেখানে তিনি ফুলারটন কলেজে ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্য। কিন্তু সেখানে বেশীদিন টিকতে পারলেন না। এক বছর যেতে না যেতেই ড্রপ আউট হয়ে গেলেন কলেজ থেকে।

স্কুলের ল্যাবে জেমস ক্যামেরন

এরপর ট্রাক ড্রাইভারের কাজ নিলেন তিনি এবং সময় পেলে মাঝে মাঝে লেখালেখিও করতেন একটু আধটু। পরে তিনি বলেছেন এই সময়টাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইউএসসি লাইব্রেরীতে নিয়মিত যেতেন এবং ফিল্ম টেকনোলজির সাথে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের বই কিংবা থিসিস পেপার পড়ে ফেলতেন বা খাতায় নোট করে রাখতেন। এই সময়টাতে তিনি অপটিক্যাল প্রিন্টিং, ফ্রন্ট স্ক্রীন প্রজেকশন কিংবা ডাই ট্রান্সফারের মতো বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন যা তাকে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালনায় বিস্তর সাহায্য করেছে।

এরপর ১৯৭৭ সালে একটি ঘটনা তার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। ওই বছর মুক্তি পেল বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিরিজ স্টার ওয়ার্স এর চতুর্থ কিস্তি এ নিউ হোপ (A New Hope)। ওই চলচ্চিত্র দেখে তিনি বুঝতে পারলেন শিল্প এবং বিজ্ঞান কতটা কাছাকাছি থাকতে পারে। এরপর ট্রাক ড্রাইভারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ক্যামেরন ঝুঁকে পড়লেন চলচ্চিত্রের দিকে।

তিনি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে জেনোজেনেসিস (Xenogenesis) নামে একটি ১০ মিনিটের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন। কিন্তু শ্যুট করার মতো যথেষ্ট টাকা তাদের হাতে নেই। শেষ পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে চাঁদা তুলে ৩৩ মিলিমিটার ক্যামেরা, লেন্স, ফিল্ম স্টক এবং স্টুডিও ভাড়া করে ফেললেন। তারা ক্যামেরাটি পুরোটা খুলে এর বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে দেখলেন এটা বোঝার জন্য যে ফিল্ম ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে।

বলা যায় জেমস ক্যামেরন ছিলেন জেনোজেনেসিস এর পরিচালক, লেখক, প্রযোজক এবং প্রোডাকশন ডিজাইনার। এরপর তিনি রক এন্ড রোল হাই স্কুল (Rock and Roll High School) নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন প্রোডাকশন সহকারী হিসেবে। কিন্তু এই কাজের জন্য কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি। তারপরও থেমে না গিয়ে চলচ্চিত্র বানানোর কায়দা-কানুন নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। রজার কোরম্যান স্টুডিওতে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির মডেল বানানোর কাজ শুরু করেন এই সময়টাতে। এরপর ১৯৮১ এবং ১৯৮২ এই দুই বছরে চারটি চলচ্চিত্রে আর্ট ডিজাইনার, প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন।

পিরানহা মুভির সিকুয়্যাল পিরানহা-২ তে কাজ করার জন্য ইটালির রোমে যান ক্যামেরন। সেখানে ফুড পয়জনিং এর কারণে একপর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় একদিন রাত্রে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন ভবিষ্যৎ থেকে একটি রোবট পাঠানো হয়েছে তাকে খুন করার জন্য। এই স্বপ্ন থেকেই তিনি তার দ্য টারমিনেটর (The Terminator) চলচ্চিত্রের আইডিয়া পান। বলা যায় এখান থেকেই তার উত্থান শুরু হয়।

এখন পর্যন্ত জেমস ক্যামেরনের পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা সাতটি। তার পরিচালিত কয়েকটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাহলে একটু জেনে নেওয়া যাক।
১. দ্য টারমিনেটর (১৯৮৪)

ক্যামেরন দ্য টারমিনেটর (The Terminator) চলচ্চিত্রটির জন্য চিত্রনাট্য লিখে সেটি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন যাতে ছবিটি পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু কোনো প্রোডাকশন কোম্পানী তার মতো একজন অনভিজ্ঞ লোককে এরকম একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করার দায়িত্ব দিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষমেশ হেমডেল পিকচার্স (Hemdale Pictures) নামে একটি কোম্পানী তাকে পরিচালকের দায়িত্ব দিতে রাজি হলো। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি বানানোর জন্য বাজেট ছিল খুবই কম, মাত্র ৬.৫ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য ক্যামেরন ততদিনে শিখে গেছেন কীভাবে কম বাজেটে দক্ষতার সাথে কাজ আদায় করে নিতে হয়।

টারমিনেটরের সেটে জেমস ক্যামেরন

এই সিনেমাটিতে টারমিনেটরের ভূমিকায় অভিনয় করেন আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। ২০২৯ সাল থেকে তাকে অতীতে (১৯৮৪) পাঠানো হয়েছিলো সারা কনর নামে একজনকে হত্যা করার জন্য। কারণ সারা কনরের ছেলে একদিন যন্ত্রশক্তিদের বিরুদ্ধে মানব সমাজকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে।

সবাই ভেবেছিল এটিও হবে আর আট-দশটা সাধারণ সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো, যা হয়ত থিয়েটারে এক সপ্তাহের বেশী টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বক্স অফিস হিট হয় টার্মিনেটর। দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্য আর দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া কাহিনী দর্শকরা দারুণভাবে গ্রহন করে। সেই সঙ্গে শোয়ার্জনেগারের অভিনয় ছিলো আক্ষরিক অর্থেই দেখার মতো। সারা বিশ্বে ৭৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী আয় করে এই সিনেমাটি।
২. এলিয়েনস (১৯৮৬)

ক্যামেরন ১৯৭৯ সালে রিডলি স্কটের এলিয়েন (Alien) সিনেমাটির একটি সিকুয়্যাল বানানোর কাজ শুরু করেন এবং এর নাম রাখেন এলিয়েনস (Aliens)।

সিনেমার প্রধান চরিত্র হচ্ছে এলেন রিপ্লে। এলেন রিপ্লেকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সে দাবি করে এলিয়েনরা তাদের স্পেসশিপ ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং শিপের বাকি সবাইকে মেরে ফেলে। কিন্তুই কেউই তার কথা বিশ্বাস করে না। একটি কলোনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করতে। কিন্তু কোনো এক কারণে তাদের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এলেন রিপ্লেকে পাঠানো হয় উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু সে তখনো জানে না কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে তার সামনে। এভাবে এগিয়ে চলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক এই অ্যাকশন হরর সিনেমার কাহিনী।

শ্যুটিং চলাকালীন সময়ে এলিয়েন সিনেমার কর্মকর্তাদের সাথে তার বনিবনা হচ্ছিল না। তারা মনে করতো জেমস ক্যামেরন রিডলি স্কটের মতো ভালো পরিচালক নন। এত ঝামেলার পরও সিনেমাটি বক্স অফিসে সফলতা পায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরীতে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় এলিয়েনস সিনেমাটি।
৩. দ্য অ্যাবিস (১৯৮৯)

জেমস ক্যামেরন এই সিনেমাটির আইডিয়া পান তার হাই স্কুলের একটি বায়োলজি ক্লাস থেকে। একটি আমেরিকান সাবমেরিন ক্যারিবিয়ানে ডুবে গেলে উদ্ধারকারী একটি দল তেল কারখানার কিছু শ্রমিককে সাথে নিয়ে গভীর সমুদ্রে মিশনে যায়। গভীর সমুদ্রে তারা অদ্ভুত কিছু প্রাণীর সন্ধান পায়। এভাবে এগিয়ে যায় এই সিনেমার কাহিনী।

শুরুর দিকে এই সিনেমার বাজেট ছিল ৪১ মিলিয়ন ডলার যা দ্য অ্যাবিস (The Abyss)-কে ওই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমাগুলোর একটিতে পরিণত করে। সিনেমাটির সেট তৈরী করার জন্য একটি অসমাপ্ত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিল্ডিং এবং দুইটি বিশাল সাইজের ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া ওই সময়ে সিনেমাটিতে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল যেটি হয়ত সম্ভব হয়েছে কেবল জেমস ক্যামেরনের কারণেই। ক্যামেরনের অন্য সিনেমাগুলোর তুলনায় এই সিনেমাটি অবশ্য তেমন ব্যবসা করতে পারেনি।
৪. টাইটানিক (১৯৯৭)

টাইটানিক নিয়ে জেমস ক্যামেরনের ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। একটা সময়ে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন টাইটানিক ট্র্যাজেডির উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। শুরু করলেন স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। সিনেমাটি বানানোর আগে ক্যামেরন আটলান্টিকের তলদেশে সত্যিকারের টাইটানিকের ফুটেজ সংগ্রহ করেন যা পরবর্তীতে মূল সিনেমায় যোগ করা হয়।

টাইটানিক জাহাজে উচ্চবিত্ত সমাজের মেয়ে রোজের সাথে নিম্নবিত্ত সমাজের ছেলে জ্যাকের প্রেম এবং ১৯১২ সালে টাইটানিকের পরিণতির পটভূমিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের কাহিনীকে সাদামাটা বলা যায়। কিন্তু এই সিনেমার ভিজুয়্যাল ইফেক্ট অসাধারণ বললেও হয়তো কম বলা হয়। বিশেষ করে টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এজন্য তাকে স্কেল মডেলিং ও কম্পিউটার এনিমেশনের সাহায্য নিতে হয়েছে। চলচ্চিত্রটির প্রেমের গল্প আর প্রধান চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও অনেকগুলো পার্শ্ব চরিত্র ঐতিহাসিক সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

টাইটানিক সিনেমার সেটে কেট উইন্সলেট এবং লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন জেমস ক্যামেরন

এই চলচ্চিত্র তৈরীতে মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তৎকালীন সময়ে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। ক্যামেরনের প্রবল উচ্চাকাঙ্খার এটি একটি উদাহরণ। প্যারামাউন্ট পিকচার্স ও টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সকে যৌথভাবে এই অর্থের যোগান দিতে হয়েছে। বিশাল বাজেটের কারণে মুক্তির আগেই ক্যামেরন ও তার টাইটানিককে সমালোচনার শিকার হতে হয়। সমালোচকরা ধারণা করেছিলেন ফক্স এবং প্যারামাউন্ট বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হবে।

অস্কারের মঞ্চে জেমস ক্যমেরন

কিন্তু টাইটানিক মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কয়েক মাসের জন্য এটি বক্স অফিসের তালিকায় ছিল এক নম্বরে। পুরো বিশ্বজুড়ে টাইটানিক আয় করলো মোট ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সিনেমাটিকে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী উপার্জন করা সিনেমার তালিকায় স্থান দেয়। পরবর্তীতে অবশ্য জেমস ক্যামেরনেরই অ্যাভাটার সিনেমাটি টাইটানিকের আয়ের রেকর্ড ভেঙে দেয়। ১৪টির মধ্যে ১১টি ক্যাটাগরীতেই একাডেমি পুরস্কার বা অস্কার জিতে নেয় এই সিনেমাটি। জেমস ক্যামেরন পান সেরা পরিচালকের পুরস্কার। টাইটানিক সিনেমার জ্যাকের মতোই ক্যামেরন অস্কারের মঞ্চে উঠে বলেছিলেন, “I am the king of the world!”।
৫. অ্যাভাটার (২০০৯)

পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ যার নাম প্যানডোরা। এই গ্রহের অধিবাসীদের বলা হয় নাভি, যারা দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। পৃথিবীর একদল লোভী মানুষ আর নিরীহ নাভীদের মধ্য এক অসম আর সাহসী যুদ্ধ নিয়েই গড়ে উঠেছে অ্যাভাটার (Avatar) সিনেমার কাহিনী।

সিনেমাটি বানানোর পরিকল্পনা ক্যামেরন করেছিলেন সেই ১৯৯৭ সালের টাইটানিক সিনেমার পর থেকেই। এরও আগে ১৯৯৫ সালে ৮০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া স্ক্রিপ্টও লিখে ফেলেন সিনেমাটির জন্য। কিন্তু সিনেমাটি বানানোর জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, তা ওই সময়ে ছিল না। প্যানডোরা গ্রহটির ডিজাইন থেকে শুরু করে সিনেমার প্রায় প্রতিটি অংশই কম্পিউটার এনিমেশনের সাহায্য নিয়ে করা। দ্য পোলার এক্সপ্রেস (The Polar Express) সিনেমাটিতে পরিচালক রবার্ট জেমেকিস পারফরম্যান্স ক্যাপচার টেকনিক ব্যবহার করেছিলেন। জেমস ক্যামেরন ব্যবহার করলেন এই টেকনিকেরই অনেক উন্নত একটি ভার্সন।

অ্যাভাটার সিনেমার পরিচালনার দায়িত্বে জেমস ক্যামেরন

অ্যাভাটার সিনেমার বাজেট ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার যা টাইটানিকের বাজেট থেকেও অনেক বেশী! আর এই সিনেমাটি আয় কত করেছিলেন জানেন? সারা বিশ্ব থেকে সিনেমাটি আয় করে ২.৭৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী!

অ্যাভাটারের এই জনপ্রিয়তা কারণে ২০১০ সালে হলিউডের সবচেয়ে বেশী আয় করা পরিচালকদের মধ্যে এক নম্বরে চলে আসেন জেমস ক্যামেরন। তার মোট সম্পদ তখন ২৫৭ মিলিয়ন ডলার!

জেমস ক্যামেরন সম্পর্কে সমালোচকদের প্রধান যে অভিযোগ সেটা হল তার লেখা স্ক্রিপ্টগুলোর কাহিনীর গভীরতা কম। অভিযোগ অবশ্য মিথ্যা নয়। তবে যে ধরনের সিনেমা তিনি তৈরী করেন, সেখানে কাহিনীর গভীরতা থাকা হয়ত অত আবশ্যকও নয়। এই কারণে সব জায়গায় গভীরতা খুঁজতে যাওয়া লোকেরা হতাশ হতে পারেন তার সিনেমাগুলো দেখে।

কিন্তু পরিচালক হিসেবে ক্যামেরনের সমালোচক খুব বেশী নেই। আর্টিস্টদের কাছ থেকে ষোল আনা কাজ আদায় করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। এই কারণে তার সাথে কাজ করা অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। তিনি শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে সবার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখতে বলেন যাতে তা কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। কোনো একটা দৃশ্য পছন্দ না হলে বারবার শ্যুট করেন। সিনেমাকে বাস্তবসম্মত করার জন্য জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। টাইটানিক চলচ্চিত্রের নায়িকা কেট উইন্সলেট তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে তিনি আর জেমস ক্যামেরনের কোনো সিনেমায় কাজ করবেন না।

নিজের কাজে ডুবে থাকার কারণে পরিবারকেও সময় দিতে পারেননি বেশী একটা। এ কারণে সংসারও ভেঙে গেছে তার। তাও একবার নয়, পাঁচবার!

তবুও জেমস ক্যামেরন থেমে নেই। অ্যাভাটার ২ হয়তো শিগগিরই মুক্তি পাবে। অ্যাভাটার ৩ এবং ৪ ও যে আসবে এরকম ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। ৬২ বছর বয়সেও যেভাবে এগিয়ে চলেছেন তিনি, তাতে মনে হচ্ছে এটা অসম্ভব কিছু নয়। হলিউডে আরও অনেকদিন চলবে জেমস ক্যামেরনের রাজত্ব এটা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।

    তথ্যসূত্র

    ১. en.wikipedia.org/wiki/James_Cameron

    ২. imdb.com

    ৩. jamescamerononline.com

39
By Tawfiqur Rahman

    “ছোট ছোট জিনিস একত্র হয়েই বড় কিছুর জন্ম দেয়” – ভিনসেন্ট ভ্যান গখ

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় জিনিসের শুরু হয়েছে কোনো না কোনো ক্ষুদ্র জিনিস থেকে। কোনো একটি ক্ষুদ্র আইডিয়া, সেই সাথে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা- এ দুয়ের মাধ্যমেই কিন্তু জন্ম হয় বড় কিছুর।

যেমন, ১৯৯০ সালে স্টানফোর্ডের দুই ছাত্র তাদের সমস্ত কিছু বিনিয়োগ করে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তখন তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি ১,৭০০ ডলার নিজেদের পকেটে নিয়ে আসা যায়, যাতে করে তারা তাদের নতুন অফিসের এক মাসের ভাড়া পরিশোধ করতে পারেন। আর তাদের নতুন অফিসটি কোথায় ছিল জানেন? তাদেরই এক বন্ধুর ফাঁকা গ্যারেজে! এখানেই ল্যারি পেইজ আর সের্গেই ব্রিন গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইন্টারনেট ও সফটওয়্যার কোম্পানি গুগল।

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং চল; Source: Wikipedia Commons

আর ঠিক এমনভাবেই ১৯৩০ সালে যখন লি বিয়ং চল দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইগ শহরে প্রথম স্যামসাং নামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন তখন তার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বাজারে ছোটখাট মুদি ব্যবসা করা আর সেই সাথে স্থানীয় নানা পণ্য বাইরে রপ্তানি করা। বিভিন্ন ফ্লাগশিপ পণ্য? না, বর্তমানে স্যামসাং যেসব পণ্য তৈরি করে অতীতে কিন্তু তার ধারে কাছেও ছিল না তারা। আপনি হয়তো জানেন না, সেসময় স্যামসাংয়ের শুরু হয় নুডলস তৈরির মাধ্যমে!

স্যামসাংয়ের লোগোর বিবর্তন; Source: news.samsung.com

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লির জন্ম হয় এক ধনী পরিবারে। তাকে যখন টোকিওর ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় তখন তিনি তার গ্রাজুয়েশন শেষ না করেই আবার বাসায় ফিরে আসেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন নানা পারিবারিক ব্যবসার সাথে। সেসময় তিনি মাত্র ৪০ জন কর্মচারী, একটি ছোট গুদাম ঘর ও কয়েকটি ট্রাক নিয়ে গড়ে তোলেন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যার নাম দেন ‘স্যামসাং’। স্যামসাং একটি কোরিয়ান হানজা শব্দ। এখানে ‘স্যাম’ অর্থ থ্রি বা তিন এবং ‘সাং’ অর্থ স্টার বা তারা। অর্থাৎ দুয়ে মিলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘থ্রি স্টার’ বা তিন তারা। কোরিয়ান ভাষার ‘স্যাম’ শব্দটি দিয়ে বিশাল ও শক্তিশালী বুঝানো হয়। স্যামসাং প্রতিষ্ঠার সময় লির হাতে ছিল মাত্র ৩০,০০০ ওন (প্রায় ২৭ ডলার) আর ব্যবসার মালের মধ্যে ছিল কেবল ময়দা ও শুকনা সীফুড।

এগুলো খুব সহজেই বহন করা যেত এবং অনেক দিন ভালো থাকতো। ফলে ব্যবসার জন্য এগুলো ছিল সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে ব্যবসা এগোতে শুরু করলো। লি তখন তার সমস্ত সঞ্চয় একেবারে বিনিয়োগ করে বিশাল পরিমাণে পণ্য কিনলেন। আর সেই সাথে দিলেন আকর্ষণীয় ছাড়। ফলে মানুষ তার পণ্যের প্রতি ঝুকলো। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেলো অসংখ্য ট্রাক নানা রকম মুদিদ্রব্য নিয়ে চীনের উদ্দেশ্য যাতায়াত করছে। আর এভাবেই শুরু হলো স্যামসাংয়ের এগিয়ে চলা।

স্যামসাংয়ের প্রস্তুতকৃত নুডলসের প্যাকেট; Source: Wikipedia Commons

স্থানীয় নানা পণ্যের পাশাপাশি এসময় স্যামসাং তাদের নিজস্ব গৃহজাত নুডলস বিক্রি করা শুরু করলো। নুডলসগুলোর প্যাকেটের গায়ে থাকতো তিনটি তারাযুক্ত প্রতীক যা ছিল তৎকালীন কোম্পানির লোগো।

এরপর ১৯৪৫ সালের শুরু হওয়া যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে স্যামসাংকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ায় জাপানী ঔপনিবেশিক শাসনের পতন ঘটে। এসময় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী লি তার কোম্পানির সদরদপ্তর সরিয়ে সিউলে নিয়ে আসেন। নানা পদের নানা দরকারি মানুষের সাথে লির ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফলে নানা বিপদ ও আসন্ন কোরিয়ান যুদ্ধের মধ্য দিয়েও তিনি স্যামসাংকে এগিয়ে নিয়ে যান। এসময় সিউলে আক্রমণ হলে তিনি আবার তার কোম্পানির সদরদপ্তর সিউল থেকে উত্তর কোরিয়াতে নিয়ে যান। সেইসাথে তিনি বুসান শহরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন।

১৯৫৪ সালের দিকে লি চিমসাং ডং এ একটি উলের মিল স্থাপন করেন। সেসময় এটি ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় উলের মিল। ১৯৪৭ সালে হিওসাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চো হং যাই এবং লি মিলে ‘স্যামসাং মুলসান গংসা’ নামের একটি যৌথ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ধীরে ধীরে এটি বড় হতে থাকে এবং ১৯৫১ সালে তা ‘স্যামসাং সি এন্ড টি কর্পোরেশন’ নামকরণ করা হয়। পূর্বের নানা পণ্যের পাশাপাশি লি ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যে আবাসন, জীবনবীমা, টেক্সটাইল প্রভৃতি ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই লি বিশাল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স জমিয়ে ফেলেন। তবে ব্যাংক ব্যালেন্সের পাশাপাশি তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও জমা হতে থাকে।

১৯৩০ সালে ডেইগে অবস্থিত স্যামসাংয়ের সদরদপ্তর; Source: thevintagenews.com

১৯৬১ সালে লি টোকিও থেকে ফিরে এসে নতুন সরকারের সাথে এক লেনদেনের চুক্তি করেন। পুরনো দুর্নাম ও দুর্নীতি বাদ দিয়ে স্যামসাং এসময় নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার পরিকল্পনা করে। লি সরকারের সাথে পরিকল্পনা করে এ সময় কোরিয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তার ব্যবসাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় লেগে পড়েন। ১৯৬০ এর শেষের দিকে স্যামস্যাং পেট্রোকেমিক্যালের মতো নানা ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে ১৯৬৯ এর দিকে তারা সামরিক পোশাক ও বস্ত্র ইথিওপিয়ায় রপ্তানি শুরু করে। আর এই বছরই প্রথমবারের মতো ‘স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক’ নামের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় স্যামসাং কর্পোরেশনের সাথে। এই বছরই স্যামসাং সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের তৈরি সাদা-কালো টেলিভিশন বাজারে ছাড়ে।

সাদা-কালো টিভি নির্মাণ করছে স্যামসাংয়ের কর্মীরা; Source: news.samsung.com

১৯৭০ সালে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ব্যাপক জনপ্রিয়তার আভাস পেয়ে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেয়। তারা তাদের সমস্ত কিছু ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণ ও তা নিয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ করে। ফলে গড়ে ওঠে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, স্যামসাং কর্নিং, স্যামসাং ইলেক্ট্রো-মেকানিক্স, স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর এবং স্যামসাং টেলিকমিউনিকেশনের মতো নানা শাখা। আর এসব শাখার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে স্যামসাং হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক ব্রান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম।

স্যামসাংয়ের তৈরি প্রথম কম্পিউটার; Source: Wikipedia Commons

এভাবে নুডলস থেকে শুরু করে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়া স্যামসাংয়ের ২০১৪ এর হিসাব অনুসারে গোটা পৃথিবীতে মোট ৮০টির বেশি দেশজুড়ে ৪,৮৯,০০০ এর বেশি কর্মচারী রয়েছে। ফোর্বসের রিপোর্ট অনুসারে গত বছর স্যামসাং প্রায় ১৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রয় করছে। এতে তাদের লাভ হয়েছে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার।

একজন কলেজ পালানো নুডলস প্রস্তুতকারক কি কখনো চিন্তা করতে পেরেছিলেন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি একদিন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও জনপ্রিয় ব্রান্ডগুলোর একটিতে পরিণত হয়ে উঠবে! লি হয়তো ভাবেননি, তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেই স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দিতে হবে তা জানা ছিলো লিয়ের। লি যদি সেদিন কলেজ না পালিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছে না ছুটতেন তবে হয়তো আজ স্যামসাংয়ের যে রূপ আমরা দেখছি তা কোনো দিন দেখতে পেতাম না। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাই তার সেই নুডলসের প্যাকেটের গায়ের তিন তারাকে বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ তারা যুক্ত এক গ্যালাক্সির রূপ দিয়েছে, যা কিনা এখন স্যামসাং এর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

40
By Sirajam Munir Shraban

অশুভ ও নেতিবাচক যেকোনো কিছুকেই আমরা খারাপ হিসেবে দেখি। রোগ বা অসুস্থতার মতো কোনো কিছুকেই আমরা ভালো হিসেবে দেখি না কখনো। কিন্তু মানবজাতির অস্তিত্ব থাকার পেছনে অসুস্থতার অবদান সীমাহীন। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে অসুস্থতা মানবজাতির জন্য অমূল্য আশীর্বাদ। কীভাবে? সেটা আলোচনা করতে হলে পটভূমির একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

অসুস্থতা আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। ভয়ঙ্কর মাংসাশী প্রাণীরা যেমন আমাদের জন্য বিপজ্জনক, তেমনই ক্ষুদ্র পরজীবীরাও আমাদের জন্য বিপজ্জনক। চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্র পরজীবীরাই রোগ শোকের সৃষ্টি করে। বেকায়দায় বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে মাংসাশী প্রাণীরা হয়ে যায় জীবনের জন্য সাক্ষাৎ হুমকি। তবে পরজীবীরা এদের মতো ‘সাক্ষাৎ’ হুমকি হয় না, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক, এই যা। ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস সহ অন্যান্য পরজীবী আমাদের দেহে বসবাস করে এবং আমাদের দেহকে খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে।

শিকারি প্রাণীরাও অন্য প্রাণীর দেহ খেয়ে বাঁচে, তবে তা পরজীবী থেকে ভিন্ন। শিকারিরা প্রথমে তাদের শিকারকে ধরে মেরে ফেলে, তারপর খায়। অন্যদিকে পরজীবীরা খায় সরাসরি জীবন্ত প্রাণের দেহ। পরজীবীরা তাদের পোষকের (Host) দেহের তুলনায় অনেক অনেক ক্ষুদ্র হয়। শিকারি প্রাণীরা তাদের শিকার থেকে কিছুটা বড় হয়ে থাকে। যেমন- শিকারি বিড়াল তার শিকার ইঁদুর থেকে বড়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে শিকারিরা ছোটও হয়ে থাকে। যেমন- একটি সিংহ তার শিকার জেব্রা থেকে ছোট। তবে ছোট হবার এই পরিমাণ খুব সামান্য। সেই তুলনায় পরজীবী প্রাণী তাদের শিকার (পোষক)-এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি ছোট।

পরজীবীরা পোষকের চেয়ে অনেক ছোট আকারের হয়; Source: Devine Art

শিকারিরা তাদের শিকারকে প্রকাশ্য দিবালোকে শিকার করে এবং খোলাখুলিভাবে খায়। অন্যদিকে পরজীবীরা তাদের পোষক দেহকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে খায়। দেহকে জীবন্ত রাখে, ফলে তাদের খাদ্যের সরবরাহ অব্যাহত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পোষক হয়তো সরাসরি মরে যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচুর ক্ষতির শিকার হয়।

জীবাণুরা মাঝে মাঝে দলবদ্ধ হয়ে একসাথে আক্রমণ করে। এমন পরিস্থিতিতে দেহ তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে অসুস্থ হবার উদাহরণ হচ্ছে সর্দি বা ভাইরাসের জ্বর। পরজীবী এতোই ছোট যে খালি চোখে তাদের দেখাই যায় না। খালি চোখে দেখা যায় না এরকম পরজীবীকে জীবাণু বলা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ‘জীবাণু’ শব্দ দিয়ে খালি চোখে না দেখা পরজীবীর জগৎকে পুরোপুরি তুলে আনা যায় না। এই তালিকায় আছে ভাইরাস, যা ক্ষুদ্রের চেয়েও আরো ক্ষুদ্রতর, অতি অতি ক্ষুদ্র।

এরপর আছে ব্যাকটেরিয়া। এরাও ক্ষুদ্র, এদেরকেও খালি চোখে দেখা যায় না। তবে এরা ভাইরাসের চেয়ে বড়। অনেক ভাইরাস আছে যারা ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহকেও পোষক হিসেবে ব্যবহার করে বসবাস করে। এরপর আছে আরেকটু বড় পরজীবী, যেমন ম্যালেরিয়া। এরাও ক্ষুদ্র, এরাও ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোষী। তবে এরা ব্যাকটেরিয়া থেকে কিছুটা বড়। ব্যাকটেরিয়া থেকে বড় হবার পরেও তারা ক্ষুদ্র। তাদেরকেও মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না।

ব্যাকটেরিয়ার আকৃতি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র জীবের দেহে পরজীবী হিসেবে বাস করে তার চেয়েও আরো ক্ষুদ্র জিনিস ভাইরাস; Source: Public Health Image Library (PHIL)

ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগের উদাহরণ হচ্ছে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি, কলেরা, ডিপথেরিয়া, কুষ্ঠ, বিষফোড়া ইত্যাদি। ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট রোগের মধ্যে আছে হাম, চিকেনপক্স, পনসিকা (গলা ফুলে যায়, খুব ব্যাথা হয় এবং এটি ছোঁয়াচে), হার্পিস, জলাতঙ্ক, পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ঠাণ্ডা জ্বর ইত্যাদি। ম্যালেরিয়া জীবাণু ঘুম অসারতার জন্ম দেয় এবং ম্যালেরিয়া জ্বর তৈরি করে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরজীবী আছে। এরা মোটামুটি বড় আকারের। খালি চোখেই এদেরকে দেখা যায়। যেমন চোখের মাঝে মাঝে একধরনের কীট বসবাস করে যাদেরকে খালি চোখে দেখা যায়। এ ধরনের ক্ষতিকর পরজীবীর আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য আমাদের দেহে অত্যন্ত চমৎকার ও অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রক্রিয়া আছে। প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ‘রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ বা Immune system।

আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি এতটাই জটিল ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত যে একে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে স্বতন্ত্রভাবে আস্ত একটি বই লিখতে হবে। এখানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

দেহ যখন কোনো ক্ষতিকর পরজীবীর উপস্থিতি অনুভব করে, তখন দেহ বিশেষ ধরনের কিছু কোষ তৈরি করার কাজে লেগে যায়। উদ্দেশ্য এই কোষগুলোকে ব্যবহার করে পরজীবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। রক্তের প্রবাহের মাধ্যমে এই কোষগুলো উপযুক্ত স্থানে চলে যায় এবং এরা সৈনিক হিসেবে পরজীবীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধে সাধারণত দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই জয় লাভ করে। পরজীবীরা হেরে ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠে।

(GIF) দেহে আক্রমণ হলে দেহের কিছু বিশেষ ধরনের কোষ পরজীবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। ছবিতে একটি পরজীবীকে ধরে শায়েস্তা করছে দেহের বিশেষ কোষ। কোনায় মরে পড়ে আছে আরেকটি বহিরাগত পরজীবী; Source: The Germ Guy/Imgur

এই ঘটনা ঘটে যাবার পর থেকে দেহ তার স্মৃতিতে ঘটনাটির কথা ‘মনে রাখে’। এই যুদ্ধে কোন ধরনের কোষ তৈরি করে সৈন্য নামানো হয়েছিল তা-ও মনে রাখে। পরবর্তীতে যখন এ ধরনের কোনো পরজীবী এসে মানুষকে আক্রমণ করে, তখন একদম অল্প সময়ের ভেতরেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাদেরকে প্রতিহত করে ফেলে। কারণ দেহ আগে থেকেই জানে যে এদেরকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হবে।

এরকম ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষও করি। কারো যদি কখনো জল বসন্ত হয় তাহলে পরবর্তীতে কখনোই এই রোগ হয় না। কারণ শরীরের ভেতর জল বসন্তের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে আছে প্রথম বারেই। এখন নতুন কেউ আসলে শরীর তাকে সাথে সাথেই শনাক্ত করে ফেলবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঠেকিয়ে দেবে। পুরাতন পাগলেই ভাত পায়নি, নতুন পাগলের আনাগোনা!

এই আক্রমণ যখন প্রথম বার হয়েছিল, তখন শরীর তাকে চিনতে পারেনি। ব্যক্তিটি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। শরীর ধীরে ধীরে প্রতিরোধ করেছে এবং তারপরে ব্যক্তি সুস্থ হয়েছে। প্রথমবার অচেনা ছিল বলে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরেরবার তো আর অচেনা নয়, তাই এবারে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর ক্ষতি করার সুযোগ দেবে না। কেউ কেউ মনে করে ছোটবেলায় এ ধরনের রোগগুলো হয়ে যাওয়া ভালো। ছোটবেলাতেই যদি এই রোগগুলোর প্রতি শরীরের প্রতিরোধ গড়ে উঠে, তাহলে বড় হয়ে আর ভয় থাকে না। কারণ এ ধরনের রোগ বড় অবস্থায় হলে ক্ষতি ও অসুবিধার পরিমাণ হয় বেশি।

চিকেন পক্স একবার হয়ে গেলে পরে আর হয় না; Source: WikiSickness

ভ্যাকসিন নামে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি উপরে উল্লেখ করা প্রতিরোধ ব্যবস্থার অনুরূপ কাজ করে। এটিও চমৎকার ও বুদ্ধিদীপ্ত একটি পদ্ধতি। ভ্যাকসিনে মূলত নির্দিষ্ট রোগের জীবাণু থাকে। তবে এই জীবাণুকে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে দেহে প্রবেশ করানো হয়। জীবাণুর শরীরের অংশবিশেষ কিংবা জীবাণুর মৃতদেহ কিংবা দুর্বল জীবাণু থাকে এক্ষেত্রে। এগুলো নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী হলেও এদের এমন পরিবর্তিত অবস্থা দেহে গিয়ে রোগ তৈরি করতে পারে না, অক্ষম। তবে অক্ষম হলেও দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ঠিকই নাড়িয়ে দিতে পারে।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এদেরকে জীবিত বা কার্যক্ষম ভেবে তাদের জন্য প্রতিরোধ তৈরি করতে শুরু করে। একবার প্রতিরোধ হয়ে গেলে পরবর্তীতে এ ধরনের আক্রমণে দেহকে আর কাবু করে ফেলতে পারবে না এই প্রজাতির জীবাণুগুলো। এই প্রক্রিয়ায় নকল জিনিস প্রবেশ করিয়ে দেহে এমন একটি প্রক্রিয়াকে সচল করা হয় যা দিয়ে আসল ভয়ঙ্কর জিনিসকে প্রতিহত করা যাবে।

জীবাণুকে পরোক্ষভাবে জীবাণু দিয়েই প্রতিহত করা হয়; Source: The Odyssey Online

কিছু কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। বাইরের কোন জিনিসটি দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং কোন জিনিসটি দেহের জন্য প্রয়োজনীয় তা ‘অনুধাবন’ করতে কষ্ট হয়। কোন জিনিসটিকে আক্রমণ করে দফারফা করে ফেলা উচিৎ আর কোন জিনিসটিকে আশ্রয় দিয়ে দেহের অংশ হিসেবে মেনে নেয়া উচিৎ তার সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সমস্যা হয়।

উদাহরণ হিসেবে একজন গর্ভবতী মায়ের কথা বিবেচনা করি। মায়ের পেটে যে নবজাতক আছে সে বহিরাগত। কারণ সন্তানের জিনের অনেক কিছুই মায়ের দেহের সাথে অমিল। সন্তানের অর্ধেক জিন আসে বাবার কাছ থেকে। এই হিসেবে সন্তানের অর্ধেক পরিমাণই হচ্ছে বহিরাগত। কিন্তু তারপরেও তার সবটাই আছে মায়ের ভেতর। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সন্তানকে বহিরাগত বলেই ধরে নেবে। কিন্তু অন্যদিকে সন্তানকে সবকিছু থেকে রক্ষা করাও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাজ। সন্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়াও দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।

মায়ের পেটে নবজাতক একদিক থেকে অন্তর্গত আবার আরেক দিক থেকে বহিরাগত; Source: Stimit/YouTube

বহিরাগতকে প্রতিহত করা এবং অভ্যন্তরস্থ সন্তানকে রক্ষা করা এই দোটানার সমস্যা ছিল স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাসের অন্যতম বড় একটি সমস্যা। প্রাণিজগতে যখন গর্ভধারণের উৎপত্তি হয়, তখন এটি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবে এই চ্যালেঞ্জিং সমস্যাটি মোটামুটি সমাধান হয়েছিল। ভূমিষ্ঠ হবার আগ পর্যন্ত যেন গর্ভে টিকে থাকতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নবজাতক শিশুর মাঝে বিবর্তিত হয়েছে। নবজাতক শিশুর দেহে এমন কিছু প্রক্রিয়া বিদ্যমান আছে যার সাহায্যে মায়ের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে।

কিন্তু তারপরেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কিছু কিছু নবজাতক নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। আজকের যুগের এমন কিছু নবজাতকের জন্ম হয় যারা ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। জন্মের সাথে সাথে খুব দ্রুত তাদের দেহের সকল রক্ত পাল্টে নতুন করে রক্ত দিতে হয়। মায়ের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কর্মকাণ্ডের কারণেই এমনটা হয়। কোনো কোনো শিশু গর্ভেই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে। তাদেরকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে আনা যায় শুধুমাত্র চিকিৎসক ও উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে।

মাঝে মাঝে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলভাবে ভুল জিনিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর নয় এমন কিছু জিনিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে খামোখা দেহেরই ক্ষতি করে। এলার্জি মূলত এ কারণেই হয়। যেমন বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের পোলেন কণা। এরা দেহের জন্য একদমই ক্ষতিকর নয়। কিন্তু দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করবে এরা খুবই ক্ষতিকর এবং এদের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিৎ। দেহ যখন প্রতিরক্ষার মহা-সমারোহে নেমে পড়ে, তখন এলার্জির প্রভাব দেখা দেয় এবং মাঝে মাঝে এটি অত্যন্ত ভয়ানক ক্ষতিও করতে পারে। উপকার তো হয়ই না উপরন্তু দেহের আরো ক্ষতি হয়।

কেউ কেউ ফুলের প্রতি এলার্জিক; Source: Devine Art/PD07

কোনো কোনো মানুষ আছে যারা কুকুর বা বিড়ালের প্রতি এলার্জিক। এসব প্রাণীর গায়ে যে লোম আছে তার উপরের বা ভেতরের অণুগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করে এগুলো ক্ষতিকর। তাই এরা কাছে আসলেই এদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা। এলার্জি মানুষকে মাঝে মাঝে ভয়ানক বিপদে ফেলে দিতে পারে। কিছু কিছু মানুষ আছে বাদামের প্রতি এলার্জিক। কারো কারো ক্ষেত্রে একটা মাত্র বাদাম খেলে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।

মাঝে মাঝে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে যায় যে নিজের দেহের প্রতিই এলার্জিক হয়ে পড়ে! একে বলা হয় আত্ম-প্রতিরোধী রোগ (Auto-immune diseases)। অটো একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আত্ম বা নিজ বা Self। আত্ম-প্রতিরোধী রোগের একটি উদাহরণ হচ্ছে মাথায় টাক পড়া। এই রোগে মাথার চুল পড়ে যায়, কারণ এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের দেহের চুলের ফলিকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। চুলের গোড়ার ফলিকল কেটে দিলে চুল পড়ে যায়। মাথা টাক হয়।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভ্রান্ত হয়ে মাঝে মাঝে নিজের প্রতিই এলার্জিক হয়ে পড়ে। মাথায় টাক পরা এর অন্যতম উদাহরণ। ছবি: The Independent

আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যে মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত আচরণ করে তাতে আসলে খুব বেশি অবাক করার মতো বিষয় নয়। কাকে আক্রমণ করবে আর কাকে ছেড়ে দেবে এ নিয়ে দোটানায় থাকতে হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার। একটি হরিণ যখন সবুজ মাঠে ঘাস খায়, তখনো এরকম সমস্যায় পড়ে। বাতাস বইছে এমন সময় ঘাসের আড়ালে কিছু একটা নড়ে উঠলো। হরিণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এটা কি কোনো ওৎ পেতে থাকা শিকারি নাকি মামুলী একটি খরগোশের নড়াচড়ার শব্দ? দৌড় দিয়ে কি জীবন বাঁচাবো নাকি একটু ঝুঁকি নিয়ে এখানে থেকে খাবার শেষ করবো? দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাবে এটা কি কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নাকি নিরাপদ কোনো পোলেন কণা?

ভারসাম্য আর সাম্যাবস্থার দোটানা। সন্দেহজনক সকল কিছুর বিরুদ্ধেই কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে, নাকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেবে? প্রতিরোধের অতিরিক্ত সক্রিয়তার ফলে জন্ম নিতে পারে এলার্জি কিংবা নিজেকে ধ্বংস করে দেবার মতো পরিস্থিতি। অন্যদিকে কিছু কিছু উপাদানকে ছাড় দিলেও ভয়, এদের কেউ কেউ দেহে মারাত্মক রোগ বাধিয়ে ফেলবে।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দোটানায় পড়ে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে নাকি তুলবে না তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে ক্যানসার। ক্যানসারের প্রক্রিয়াটি বেশ অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ক্যানসার হচ্ছে এমন কিছু দলছুট কোষের পথভ্রষ্ট কার্যক্রম যারা নিজেদেরকে ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে তাদের কী কাজ করা উচিৎ। নিজেদের করণীয় কাজ ভুলে নিজেদের সীমা অতিক্রম করে বিভাজন অব্যাহত রাখে যে কোষ সেগুলো হচ্ছে ক্যানসার।

এ ধরনের কোষগুলো নিজের দেহের মধ্যেই আক্রমণাত্মক পরজীবীর মতো হয়ে ওঠে। এ ধরনের কোষগুলো একত্রে মিলে টিউমার গঠন করে এবং দেহের ভালো কোষগুলোকে খেয়ে খেয়ে নিঃশেষ করে। অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে এটি সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজের দেহকে মেরে ফেলে।

ভ্রষ্ট কোষ, নিজেই নিজের দেহকে মেরে ফেলে; Source: Imgur

ক্যানসার কেন এত ভয়ঙ্কর? ক্যানসার কেন এত অপ্রতিরোধ্য? কারণ হচ্ছে আমাদের ঐ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেবার দোটানা। এই দলছুট কোষগুলো আমাদের নিজেদের দেহের অভ্যন্তরের কোষ। এরা স্বাভাবিক কোষের তুলনায় কিছুটা পরিবর্তিত, কিন্তু তারপরেও এরা দেহেরই কোষ। যার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এদেরকে বহিরাগত জীবাণুর মতো আক্রমণ করবে নাকি দেহের স্বাভাবিক কোষের মতো সুরক্ষা দান করবে। প্রত্যেকটা পদে পদেই দুর্ভাগ্য। প্রত্যেকটা পদে পদে নেতিবাচকতা।

আর সিদ্ধান্তের দোটানায় পড়ে যায়, এর মানে হচ্ছে এরকম হলে বিজ্ঞানী-গবেষকদের দ্বারা ক্যানসারের প্রতিষেধক তৈরি করা অনেক কষ্টকর হবে। কারণ যে প্রতিষেধক দিয়ে ক্যানসার কোষ মারা হবে, সেটি দেহের স্বাভাবিক কোষকেও মেরে ফেলবে। স্বাভাবিক কোষ আর ক্যানসারের কোষ প্রায় একই। ব্যাকটেরিয়া বা এ ধরনের বহিরাগত কোষকে মেরে ফেলা সহজ। কারণ ব্যাকটেরিয়ার কোষ আমাদের দেহের কোষ থেকে আলাদা।

যে প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করলে ব্যাকটেরিয়া মরবে, কিন্তু তাতে দেহের কোষের কোনো সমস্যা হবে না তা ব্যবহার করা যেতে পারে। যে বিষ নিজের কোষকে মারে না, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে, তাকে বলে এন্টিবায়োটিক। ক্যানসার কোষকে মারবে, কিন্তু সুস্থ কোষকে মারবে না এ ধরনের চিকিৎসা এখনো মানুষের হাতের নাগালে আসেনি।

ক্যানসার কোষকে মারতে গেলে দেহের সাধারণ কোষও মরে যাবে; Source: Wikimedia Commons

ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলোকে বিষ প্রদান করা হয়। এতে দেহের অন্যান্য কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই কেমোথেরাপিতে মানুষের চুল পড়ে যায়। দেহের ক্ষতি হয় বলে সীমিত মাত্রায় এবং খুব নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এই থেরাপি প্রদান করা হয়। যদি স্বল্প সময়ের মাঝেই বেশি থেরাপি গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হয়তো ক্যানসার কোষকে মারবে, তবে বেচারা রোগীকে মেরে ফেলার আগে নয়।

এই বেলায় এলার্জি সম্পর্কে একটি অনুমান বা ধারণা প্রকাশ করা যায়। আত্ম-প্রতিরোধী রোগ বা Auto-immune disease এর উৎপত্তি কি আমাদের পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে অনেক আগে থেকে চলে আসা দেহের যুদ্ধের ফল? এমনটা হবার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ক্যানসার বা ক্যানসারের মতো দেহজ রোগগুলোকে প্রতিহত করার জন্য দেহ এমন একটি প্রক্রিয়া আয়ত্ব করতে চাইছে যা দিয়ে নিজের ক্ষতিকর কোষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। প্রক্রিয়াটি হয়তো এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি, তাই দেহ ভুল করছে এবং মানুষ তাতে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে।

এমন কি হতে পারে না এই কষ্টের পেছনে ভালো কিছু হবার উদ্দেশ্য আছে? এমনটা হতে পারে। কারণ ক্যানসার যখন প্রাথমিক অবস্থায় থাকে, তখন ক্ষেত্রবিশেষে দেহ তা প্রতিহত করতে পারে। দেহের প্রতিরোধ এখনো তেমন উন্নত হয়নি যা দিয়ে পরিপক্ব ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। ব্যাপারটা যদিও এখনো অমীমাংসিত, তারপরেও বলা যায়- পদে পদে দুর্ভাগ্য আর অশুভ ঘটনার পেছনেও থাকতে পারে কোনো শুভ উদ্দেশ্য।

41
By Abdullah Ibn Mahmud

মিসর আর সিরিয়ার প্রথম সুলতান সালাহউদ্দিনকে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে সালাদিন (Saladin) নামে। আইয়ুবী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন নানা সেনা অভিযান। তার সালতানাতের অধীনে ছিল মিসর, সিরিয়া, উত্তর ইরাক, হেজাজ, ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ- এতই বিশাল ছিল তার প্রতিপত্তি। শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত এক বীর। যারা বীর সালাদিন সম্পর্কে নামটি কেবল শুনেছেন, কিংবা কিংডম অফ হেভেন দেখা পর্যন্তই যাদের জ্ঞানসীমা, তাদের জন্যই আজকের এ পোস্ট; চলুন জেনে নেয়া যাক সুলতান সালাহউদ্দিনের জীবনের নানা দিক।

১১৮৫ সালের দিকে আঁকা সালাহউদ্দিনের ছবি © Ismail al-Jazari

১১৩৭ সালে ইরাকের বর্তমান তিকরিত এলাকায় তার জন্ম, নাম ছিল আসলে ইউসুফ। তার সম্মানসূচক উপাধি ছিল সালাহ-আদ-দ্বীন যার মানে ‘ধর্মের ন্যায়তা/পুণ্য (Righteousness)’।  কুর্দি পরিবার থেকে তিনি এসেছিলেন, আদি নিবাস মধ্যযুগীয় আর্মেনিয়ার প্রাচীন দ্বীন (Dvin) শহরে। যে রাওয়াদিয়া (Rawadiya) গোত্র থেকে তিনি এসেছিলেন সেটা ততদিনে আরবিভাষীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

প্রাচীন দ্বীন শহর; Source: Wikimedia Commons

তার জন্মের পাঁচ বছর আগে, মসুলের শাসক ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি এক যুদ্ধে পালিয়ে যাবার সময় টাইগ্রিস নদীর দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হন, তখন নদীর উল্টো পাশে তিকরিত দুর্গের রক্ষক ছিলেন সালাহউদ্দিনের বাবা নাজমুদ্দিন আইয়ুব। আইয়ুব তখন ইমাদুদ্দিনের জন্য ফেরির ব্যবস্থা করেন ও তাকে তিকরিতে আশ্রয় দেন।

তাকে আশ্রয় দেবার অপরাধে ১১৩৭ সালে (যে বছর সালাদিনের জন্ম) আইয়ুব পরিবারকে উত্তর মেসোপটিমিয়ার মিলিটারি গ্রিক গভর্নর বহিষ্কার করেন। যে রাতে তারা তিকরিত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সে রাতেই জন্ম হয় আমাদের গল্পের নায়ক ইউসুফের, যাকে বিশ্ব পরে চিনবে সালাহউদ্দিন নামে।

তবে উপকারের প্রতিদান পেলেন আইয়ুব, ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি তার পরিবারকে মসুলে জায়গা করে দিলেন, এবং তাকে বালবেক (Baalbek) দুর্গের কমান্ডার বানিয়ে দিলেন। তবে ইমাদুদ্দিন মারা যান ১১৪৬ সালে, তার ছেলে নুরুদ্দীন তার জায়গা নেন এরপর।

ততদিনে সালাহুদ্দিন বাস করতে শুরু করেছেন দামেস্কে। তার ছোটবেলার খুব একটা কথা জানা যায় না, তবে দামেস্ক শহরটাকে বেশ ভালোবাসতেন তিনি। সালাহউদ্দিন ইউক্লিড জ্যামিতি, গণিত থেকে শুরু করে আইনও শিখে ফেলেন। কুরআন শিক্ষাও সেরে ফেলেন তখন, আর সাথে সাথে ধর্মতত্ত্ব। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চাইতে ধর্মকর্ম নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা বেশি ছিল তার। কিন্তু ধর্ম ছাড়াও তিনি ইতিহাসের পণ্ডিতও হয়ে যাচ্ছিলেন। আরব ইতিহাস তো জানতেনই, এমনকি আরবি ঘোড়ার বংশ-ইতিহাসও তিনি বাদ দেননি পড়তে। তিনি কুর্দি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

দামেস্ক শহরে সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য; Source: Wikimedia Commons

নুরুদ্দীনের অধীনের একজন মিলিটারি কমান্ডার ছিলেন আসাদ আল দীন। তিনিই সালাহউদ্দিনের সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করিয়ে দেন। তার প্রথম সামরিক অভিযান ছিল ২৬ বছর বয়সে। নুরুদ্দীন আসাদকে পাঠান ফাতিমী খলিফা আল-আদিদ এর উজির শাওয়ারকে সাহায্য করবার জন্য যিনি ছিলেন মিসর থেকে বিতাড়িত। সে অভিযানে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসাদ সালাহউদ্দিনকে। মিশনটি সার্থক হয়েছিল।

ঠিক এরপরই যুদ্ধ লেগে যায় ক্রুসেডার-মিসরীয় যুক্তবাহিনীর সাথে। যুদ্ধের জায়গাটা ছিল গিজার পশ্চিমে, নীল নদের পাড়ে। সে যুদ্ধে সালাহউদ্দিন নুরুদ্দীনের বাহিনীর ডান পাশের নেতৃত্ব দেন। বলা হয়, সালাহউদ্দিনের বুদ্ধিতে প্রথমে বাহিনী হেরে যাবার ভান করে প্রস্থান করে এবং এরপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ বিজয়কে ইবনে আল-আছিরের মতে ‘ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজয়’ বলা হয়। এরপর সালাহউদ্দিন তার বাহিনীর অংশ নিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে চলে যান, এবং সে শহরের পাহারা দিতে থাকেন।

১১৯০ সালের দিকের সালাদিনের মুদ্রা; Source: Wikimedia Commons

একটু আগে বলা ফাতিমী খলিফা আল-আদিদের উজির শাওয়ারের সাথে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল আসাদের, ওদিকে জেরুজালেম রাজ্যের অ্যামালরিক দ্য ফার্স্টের সাথেও। শাওয়ার সাহায্য চাইলেন অ্যামালরিকের। কিন্তু ১১৬৯ সালে শাওয়ার নিহত হন গুপ্তঘাতকের হাতে, বলা হয় সেটি সালাহউদ্দিনের কাজই ছিল। সে বছর আসাদও মারা যান। তখন নুরুদ্দীন আসাদের একজন স্থলাভিষিক্তকে বাছাই করলেও, উজির হিসেবে খলিফা আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকেই নিয়োগ দিলেন ২৬ মার্চ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আল আদিদ একজন শিয়া খলিফা ছিলেন, তাই উজির হিসেবে সুন্নি সালাহউদ্দিনকে বাছাই করাটা অবাক করা ছিল।

তবে আনুগত্য খলিফা আল-আদিদের দিকে দেবেন বেশি নাকি নুরুদ্দীনের দিকে, সেটা নিয়ে মনঃদ্বন্দ্বে ছিলেন তিনি। সে বছর, একদল মিসরীয় সেনা আর আমিরের ষড়যন্ত্রে গুপ্তহত্যার মুখে পড়েন সালাহউদ্দিন, কিন্তু গোপন সূত্রে তিনি আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। হোতা ছিল ফাতিমী প্রাসাদের সিভিলিয়ান কন্ট্রোলার। তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন সালাহউদ্দিন। পরদিন ফাতিমী বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার কৃষ্ণবর্ণী সেনা বিরোধিতা করে সালাহউদ্দিনের। এ বিদ্রোহ দমন করতে করতে ২৩ আগস্ট চলে আসে। এরপর থেকে আর কখনো কায়রোর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি সালাহউদ্দিনকে।

১১৬৯ সালে নুরুদ্দীনের সহায়তায় বিশাল এক ক্রুসেডার আর্মিকে পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন। ততদিনে কিন্তু আব্বাসীয় সুন্নি খলিফা আল মুস্তানজিদের সাথে ফাতিমী শিয়া খলিফা আল-আদিদের দ্বৈরথ তুঙ্গে। সালাহউদ্দিন তখন মিসরে নিজের ঘাঁটি শক্ত করছেন। নিজের আত্মীয়দের উচ্চপদ দিলেন তিনি। মালিকি ও নিজের শাফিই মাজহাবের জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন সালাহউদ্দিন তার শহরে।

উনবিংশ শতকে আঁকা সালাহউদ্দিন ©Gustave Doré

মিসরে পাকাপোক্ত হবার পর ১১৭০ সালে দারুম অধিকার করে নিয়ে ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন সেখানে। গাজা থেকে তখন জেরুজালেমের শাসক অ্যামালরিক নাইটস টেম্পলারদের গ্যারিসন বের করে আনেন ও দারুমের পতন রোধ করতে আসেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের উপেক্ষা করে গাজায় গিয়ে শহরটি অধিকার করে নেন তখন।

১১৭১ সালে নুরুদ্দীনের চিঠি পেলেন সালাহউদ্দিন, তিনি যেন মিসরে আব্বাসীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের শাফিঈ মাজহাবের আলেম নাজমুদ্দিন আল খাবুশানি প্রচণ্ড শিয়া বিরোধী ছিলেন, তিনিও সায় দিলেন। মিসরের কয়েকজন আমিরকে হত্যা করা হলো, তবে শিয়া খলিফা আল-আদিদকে বলা হয়েছিল যে, তাদের হত্যা করবার কারণ আসলে খলিফার বিরোধিতা করা। এরপর আল-আদিদ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাকে বিষ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কে দিয়েছিল তা জানা যায় না। অসুস্থ আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকে অনুরোধ করেন তার শিশুদের যেন দেখে রাখেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন না করে দেন, পাছে আব্বাসীয়রা তাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়ী করে। কিন্তু পরে তিনি তার নিজের এ কথার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান আল-আদিদ, পাঁচ দিন পর আব্বাসীয় খুতবা ঘোষিত হলো কায়রোতে, খলিফা হলেন আল-মুস্তাদি (حسن المستضی بن یوسف المستنجد)। তিনি ছিলেন সুন্নি আব্বাসীয় খলিফা।

লোহিত সাগরের তীরে আকাবার মন্ট্রিল দুর্গ আর কারাক শহর আক্রমণের জন্য সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মিসর ত্যাগ করলেন; সিরিয়া থেকে যোগ দিলেন নুরুদ্দীন। কিন্তু ফাতিমী ও ক্রুসেডারদের ষড়যন্ত্র নিয়ে খবর শুনতেই সালাহউদ্দিন ফিরে এলেন কায়রোতে। নুরুদ্দীন একাই গেলেন।

সালাহউদ্দিনের সবগুলো অভিযান বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব না এ সংক্ষিপ্ত লেখায়, তাই মূল ঘটনাগুলোই উল্লেখ করা হবে। ১১৭৪ সালের গ্রীষ্মে, নুরুদ্দীন বিশাল এক বাহিনী যোগাড় করছিলেন। কোনো এক কারণে (হয়ত নুরুদ্দীনের ক্রমঃক্রমঃ অর্থ ও সাপ্লাই চাওয়ার প্রতিউত্তর না দেয়ায়), আইয়ুবীরা ভাবতে লাগলো এ বাহিনী কি তবে কায়রো আক্রমণের জন্য? সালাহউদ্দিনকে কি হুমকি ভাবছেন নুরুদ্দীন? কিন্তু ১৫ মে, নুরুদ্দীন অসুস্থ অবস্থায় মারা যান হঠাৎ। ক্ষমতা চলে যায় তার পুত্র সালিহ ইসমাইল (as-Salih Ismail al-Malik) এর কাছে, বয়স তার মাত্র ১১।

সালাহউদ্দিনের সামনে তখন কয়েকটি অপশন। তিনি নিজেই কি ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে বসবেন? নাকি ১১ বছরের বালকের কথার আশায় বসে থাকবেন? আচ্ছা, তিনি কি নিজেই সিরিয়া অধিকার করে নিতে পারেন না, এ বালক তো কিছু করবে না, দুনিয়ার হালহাকিকত বুঝে উঠবার বয়সই হয়নি তার এখনো- না এটা করলে মানুষ তাকে মুনাফিক ভাববে, নিজের আগের প্রভুর রাজত্ব আক্রমণ কেউ ভালো চোখে দেখবে না। ক্রুসেডের নেতৃত্ব দেবার অধিকার তখন হারাবেন সালাহউদ্দিন।

আগস্টে সালিহ ইসমাইলের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন আলেপ্পোর আমির ও ক্যাপ্টেন গুমুশ্তিগিন। তিনি তখন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরানোর অঙ্গীকার নিলেন, শুরুটা হবে দামেস্ক (সিরিয়ার রাজধানী বর্তমানে) দিয়ে। দামেস্কের আমির তখন আলেপ্পোর বিরুদ্ধে সাহায্য চাইলেন মসুলের সাইফ আল-দীনের কাছে, যিনি কিনা গুমুশ্তিগিনের আত্মীয়। কিন্তু সাইফ না করে দিলেন। তখন সিরিয়ানরা সালাহউদ্দিনের সাহায্য চাইলো। ব্যাপক সাহায্য নিয়ে সালাহউদ্দিন হাজির হলেন প্রিয় শহর দামেস্কে। বাবার পুরনো বাড়িতে বিশ্রাম নিলেন। চার দিন বাদে দামেস্কের সিটাডেলের দরজা খুলে দেয়া হলো। সালাহউদ্দিন তখন সিটাডেল অধিকার করে নিলেন এবং বাসিন্দাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করলেন।

এরপর নিজের ভাইকে দামেস্কের শাসক করে আলেপ্পোর দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সালিহ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে বললেন যেন তাকে কেউ সালাহউদ্দিনের হাতে তুলে না দেয়, কেউ যেন আত্মসমর্পণ না করে। তার অভিভাবক গুমুশ্তিগিন তখন সাহায্য চাইলেন সালাহউদ্দিনের শত্রু অ্যাসাসিনদের গ্র্যান্ডমাস্টার মাসায়েফের রাশিদ আদ্দিন সিনানের। ১১৭৫ সালের ১১ মে, ১৩ জন গুপ্তঘাতক প্রেরণ করা হলো সালাহউদ্দিনকে মারতে। কিন্তু সকলেই নিহত হয়।

অ্যাসাসিনদের হেডকোয়ার্টার সেই মাসায়েফ দুর্গ; Source: Wikimedia Commons

আবার ত্রিপলির রেইমন্ডও মুসলিম এলাকায় আক্রমণ শুরু করেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তখন সালাহউদ্দিন পশ্চিম সিরিয়ার হমসে চলে যান, এবং অধিকার করে নেন সে শহর যুদ্ধ শেষে। এভাবে করে ১১৭৭ সালে সালাহউদ্দিনের বাহিনী এত শক্তিশালী হয়ে গেল যে ক্রুসেডারদের ত্রাস হয়ে গেলেন তিনি। ১১৮৭ সাল পর্যন্ত  তিনি ক্রুসেডারদের পাশাপাশি নিজের সাম্রাজ্যও বিস্তার করতে থাকেন। তার পতাকার নিচে এলো আলেপ্পো, দামেস্ক, মসুল ও আরো নানা শহর। মিসর, সিরিয়া ও ইয়েমেন জুড়ে প্রতিষ্ঠা হলো আইয়ুবী সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য বিস্তার করার সময় তিনি ক্রুসেডারদের সাথে বিভিন্ন চুক্তিতে ছিলেন যেন তার বাহিনী অন্যত্র ব্যস্ত থাকতে পারে। কিন্তু শাতিলনের রেজিনাল্ড এ চুক্তি ভঙ্গ করে বসেন।

সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য © কায়রো যাদুঘর

ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে ছিল বহু বছর। অন্যান্য ক্রুসেডার শহরগুলো অধিকার করার পর নজর দিলেন সালাহউদ্দিন জেরুজালেমের দিকে। তিনি চাইলেন বিনা রক্তপাতে শহরটি অধিকার করবার, কিন্তু ভেতরের বাসিন্দারা জানালো, দরকার হলে এ পবিত্র শহর ধ্বংস করে দেবে তবুও মুসলিমদের কাছে হস্তান্তর করবে না। জেরুজালেমের বালিয়ান অফ ইবেলিন হুমকি দিলেন, যদি জেরুজালেমের খ্রিস্টান অধিবাসীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তির শর্ত মেনে না নেয়া হয় তবে ভেতরের জিম্মি পাঁচ হাজার মুসলিমদের এক এক করে হত্যা করা হবে, এবং মুসলিমদের পবিত্র মসজিদুল আকসা ও ডোম অফ দ্য রক ধ্বংস করা হবে। সালাহউদ্দিন মেনে নিলেন। খ্রিস্টানদের যে মুক্তিপণ তিনি ধার্য করলেন সেটা আজকের হিসেবে চার হাজার টাকা।

জেরুজালেমের খ্রিস্টান যাজক হেরাক্লিয়াস দান করে দিলেন অর্থ যার দ্বারা আঠারো হাজার গরিব খ্রিস্টানের মুক্তিপণের টাকা উঠল। বাকি রইল পনেরো হাজার, তাদের দাসত্ব বরণ করতে হবে।

১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ শুরু হওয়া সালাহউদ্দিনের হাত্তিন যুদ্ধফেরত ২০,০০০ সেনা কর্তৃক করা জেরুজালেম অবরোধ শেষ হয় অক্টোবরের ২ তারিখ। সেদিন আত্মসমর্পণ করে জেরুজালেম। শেষ হয়ে গেল কিংডম অফ জেরুজালেম।

জেরুজালেম জয় করে নিলেন সালাহউদ্দিন; Source: iTravelJerusalem

এর আগে যখন মুসলিমদের হারিয়ে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করেছিল সেদিন মুসলিমদের কচুকাটা করে হাঁটু পর্যন্ত রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছিল তারা। তাই তারা আশংকা করছিল সালাহউদ্দিন এমনটা করবেন কিনা চুক্তিভঙ্গ করে। না, তিনি করেননি। তিনি যারা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল তাদের তো যেতে দিলেনই, যারা দিতে পারেনি তাদেরও বিনা মুক্তিপণে চলে যেতে দিলেন।

জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন প্রাক্তন ইহুদী বাসিন্দাদের বললেন, তারা শহরে ইচ্ছেমত  আবার বসবাস করতে পারে।

হয়ত ভাবছেন কাহিনী এখানেই শেষ। কিন্তু না, জেরুজালেম জয় করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন একটা বিশাল ভুল করেছিলেন, সেটি হলো, তিনি খ্রিস্টানদের টায়ার (Tyre) শহর জয় না করেই এদিকে এসেছিলেন। ইসলামে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম জয়ের জন্য তার তর সইছিল না।

জেরুজালেমের পতনের পর ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের উদ্যোগে ও অর্থায়নে শুরু হয় থার্ড ক্রুসেড (১১৮৯-১১৯১)। টায়ার শহর থেকে খ্রিস্টানরা যোগ দিল তার সাথে। আক্রা (Acre) শহরে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে রিচার্ডের বাহিনী। নারী ও শিশুসহ প্রায় তিন হাজার বন্দী মুসলিমকে হত্যা করেন রিচার্ড। এরপর ১১৯১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আরসুফ যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের বাহিনীর মুখোমুখি হন রিচার্ড। সে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন সালাহউদ্দিন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন বাহিনীসহ। রিচার্ড জাফফা শহর দখল করে নেন।

সেই আক্রা দুর্গ; Source: Visions of Travel

ওদিকে সালাহউদ্দিন মিসর ও ফিলিস্তিনের মাঝের আস্কালন শহরের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেন, যেন ক্রুসেডারদের হাতে এর পতন না হয়। তারা দুজন শান্তিচুক্তির পথ খুঁজতে লাগলেন। রিচার্ড প্রস্তাব দিলেন, রিচার্ডের বোন সিসিলির রানী জোয়ানকে সালাহউদ্দিনের ভাই বিয়ে করুক, আর বিয়ের উপহার হিসেবে জেরুজালেম দিয়ে দেয়া হোক। সালাহউদ্দিন এ প্রস্তাব উড়িয়ে দিলে রিচার্ড বললেন সালাহউদ্দিনের ভাই যেন খ্রিস্টান হয়ে যান।

১১৯২ সালে রিচার্ড জেরুজালেম থেকে ১২ মাইল দূরে থেকেও জেরুজালেম আক্রমণ করলেন না, বরং আস্কালনের দিকে গেলেন। ওদিকে সালাহউদ্দিন গেলেন জাফফা পুনরুদ্ধার করতে, প্রায় করেই ফেলেছিলেন, কিন্তু আস্কালান থেকে ছুটে এলেন কিং রিচার্ড এবং সালাহউদ্দিনকে পরাজিত করলেন শহরের বাইরের এক যুদ্ধে। এটাই ছিল থার্ড ক্রুসেডের শেষ যুদ্ধ। সালাহউদ্দিনকে মেনে নিতে হলো রিচার্ডের শর্তগুলো, টায়ার থেকে জাফফা পর্যন্ত ক্রুসেডারদের অধীনেই থাকবে। মেনে নিলেন যে, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা বিনা অস্ত্রে জেরুজালেম ভ্রমণ করে আসতে পারবে। তিন বছর পর্যন্ত কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না।

কিন্তু তিন বছর আর বাঁচেননি সালাহউদ্দিন। কিং রিচার্ড চলে যাবার পর এক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দামেস্কে মারা গেলেন তিনি, ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ। মৃত্যুর আগে তিনি সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন গরীব দুঃখীদের। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার বাকি। তার জানাজা-দাফন-কাফনের টাকাটাও হচ্ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরের বাগানে তাকে দাফন করা হয়। সাত শতাব্দী পর জার্মানির রাজা দ্বিতীয় উইলহেম সালাদিনের কবরের জন্য একটি মার্বেলের শবাধার দান করেন। এখন আপনি সেখানে জিয়ারত করতে গেলে দেখতে পাবেন কবরের ওপরে দুটো শবাধার, একটি পুরনো ও আসল কাঠের, আর আরেকটি এই মার্বেলের।

তিনি পাঁচ কিংবা বারোজন পুত্র রেখে গিয়েছিলেন। তার অসংখ্য প্রজা হজ্ব করবার সৌভাগ্য ও নিরাপত্তা সালাহউদ্দিনের কল্যাণে পেলেও, সালাহউদ্দিন হজ্ব করবার সৌভাগ্য পাননি, যদিও তার পরিকল্পনা ছিল।

সালাহউদ্দিনের কবর; Source: Wikimedia Commons

ইউরোপজুড়ে সালাহউদ্দিনের নানা ঘটনা প্রচলিত ছিল, এখনো আছে। চুক্তির পর রিচার্ড আর সালাদিন একে অন্যকে অনেক উপহার দিয়েছিলেন। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, এক খ্রিস্টান মহিলার তিন মাসের বাচ্চা চুরি হয়ে যায়, এবং সেই বাচ্চাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। খ্রিস্টানরা তাকে বলল সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে যেতে। মহিলাটির কষ্ট জানবার পর সালাহউদ্দিন নিজের টাকায় বাচ্চাটি কিনে নেন আবার, এবং মহিলাটিকে ফিরিয়ে দেন। সালাহউদ্দিনের দরবারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মহিলার চোখ থেকে। সালাহউদ্দিন একটি ঘোড়ায় করে তাকে নিজের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।

মাইকেল হ্যামিল্টনের লস্ট হিস্টোরি বইতে আমরা জানতে পারি, ১১৯২ সালে আক্রা আক্রমণের সময় রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সালাহউদ্দিন শত্রু রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য নিজের ব্যক্তিগত ডাক্তারদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য পাঠান বরফ, তাছাড়া ফলফলাদিও পাঠান। আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি, যখন রিচার্ড নিজের ঘোড়া হারিয়ে বিশাল মুসলিম বাহিনীর সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন ময়দানে, তখন মুসলিমরা তাকে আক্রমণ করেনি। বরং, সুলতান সালাহউদ্দিন তার জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেন যেন সমানে সমানে যুদ্ধ হতে পারে।

ইতিহাসের পাতা আমাদের বলে না যে, রিচার্ড কোনোদিন সালাহউদ্দিনের সাথে সামনা সামনি দেখা করেছেন, সবই হয়েছিল দূতের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড রকমের সম্মান করতেন সালাহউদ্দিনকে, তার সাহস ও বীর্যের তিনি খুব প্রশংসা করতেন। সালাহউদ্দিনও সম্মান করতেন রিচার্ডকে। সে যুগে একজন মুসলিমের নাম ইউরোপে সম্মানের সাথে নেয়া হচ্ছে সেটাই ছিল অবাক ব্যাপার। সালাদিন নামখানা আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের তাম্রলিপিতে।

42
By Musavvir Mahmud Seazon

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা বঙ্গভঙ্গের পটভূমি, বিভিন্ন কারণ, বঙ্গভঙ্গের পর দুই বাংলার প্রতিক্রিয়া নিয়ে বলা হয়েছে আগের দুই পর্বে (পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ: পেছনের গল্প; বঙ্গভঙ্গ: প্রতিক্রিয়া)। এবার বঙ্গভঙ্গের শেষ পর্বে থাকছে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের পেছনের বিভিন্ন কারণ আর এর ফলে বাংলায় যেসব প্রভাব পড়েছিল সেসব নিয়ে।
বঙ্গভঙ্গ রদ

আগের পর্বে বলা হয়েছিল ১৯১০ সালের শেষের দিকে ভারতের প্রশাসনের দুটি বড় পরিবর্তনের কথা। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর ভারতে আসার ঘোষণা দেন। এ সময় যাতে ভারতীয়রা, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যেন কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে তিনি তাদের সাথে এক প্রকার আপোসে যান। কংগ্রেসের সাথে বঙ্গভঙ্গ রদের ব্যাপারে আপোসে গেলেও অন্যদিকে লর্ড হার্ডিঞ্জের মাথায় ছিল ভিন্ন এক পরিকল্পনা। বঙ্গভঙ্গ রদ করলে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হবে এটি জানা ছিল তার। একইসাথে বাংলাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জোরদার হচ্ছিল। দুই পক্ষকে শান্ত রাখার জন্য গোপনে আরেক চাল চালেন তিনি।

পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ভারত সচিবের কাছে সুপারিশ করেন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। প্রথমত, বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দমন করা যাবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্র দিল্লিকে রাজধানী করে মুসলিমদের খুশি রাখা যাবে। একই সাথে বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক করে দুই বাংলাকে এক করার পরিকল্পনা তো ছিলই। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির মসনদে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় বঙ্গভঙ্গ রদ। একইসাথে কলকাতা হারায় রাজধানীর মর্যাদা। দুই বাংলা এক হলেও রাজধানীর মর্যাদা আর থাকে না বাংলা প্রদেশের।

দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার রানী; Source: Wikimedia Commons
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ

বঙ্গভঙ্গ রদের মূল কারণ ছিল হিন্দুদের বিরোধীতা, স্পষ্ট করে বলতে গেলে পশ্চিম বাংলার উঁচু শ্রেণীর হিন্দুদের বিরোধীতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার কথা ভেবে হিন্দু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ শিক্ষিত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে। অথচ পূর্বের হিন্দুরা ঠিকই বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল। তবে পরবর্তীতে পশ্চিমের উগ্রবাদী আন্দোলনের প্রভাব পূর্বেও পড়ে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয় যখন বাংলাকে ভাগ করাকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয় ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারের চেষ্টায় মুসলমানদের সমর্থন হারায় কংগ্রেসসহ হিন্দু নেতারা।

স্বদেশী আন্দোলনের শুরুতে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটও ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক অচলতার সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ কারখানাগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একইসাথে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে চাপে পড়লেও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। পশ্চিম বাংলাকে শান্ত করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করে, কিন্তু একইসাথে রাজধানীও বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

বঙ্গভঙ্গ রদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মুসলিম লীগের দুর্বলতা। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও সাংগঠনিক দিক দিয়ে কংগ্রেসের চেয়ে দুর্বল ছিল। ফলে কংগ্রেস কলকাতা ও পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গের জন্য যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুসলিম লীগ সেরকম কিছুই করতে পারেনি বঙ্গভঙ্গকে সমর্থনের ব্যাপারে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম সীমিত ছিল বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানানো। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গভঙ্গকে চালু রাখা কিংবা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো কিছু করতে পারেনি মুসলিম লীগ। ফলে কংগ্রেসের কাছে একপর্যায়ে নতি স্বীকার করতেই হয় ব্রিটিশ সরকারকে। মুসলিম লীগ নিজেদের স্বার্থে সেরকম কোনো চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি সরকারের উপর। ফলে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয় স্বাভাবিকভাবেই মাত্র ছয় বছরের মাথায়।
হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দুদের যে প্রতিক্রিয়া ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের পর তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ঠিক উল্টো। কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা একে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার ব্রিটিশ সরকারকে অভিনন্দন জানান বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, “১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছে”।
মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া

স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হতাশ হয়। তারা সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা ছাড়াও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় যে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছিল সেটি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার জনগণ। মুসলিম লীগের নেতারা সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। বঙ্গভঙ্গ রদে সবচেয়ে ব্যথিত হন নবাব সলিমুল্লাহ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলাম তা আমাদের বিরাট দুঃখের কারণ। কিন্তু আমাদের দুঃখ আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখি সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে বা কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করলেন”।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক; Source: Greatest Bangalis

বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার পর ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উভয় বাংলার নেতৃত্বস্থানীয়দের নিয়ে এক সভা করেন। সেই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মুসলিম নেতারাও উপস্থিত ছিলেন এবং মুসলমানদের সাথে কোনো প্রকার পরামর্শ না করে হঠাৎ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় সরকারের সমালোচনা করেন। মুসলিম লীগ মুসলমানদের অধিকার আদায়ের মুখপাত্রে পরীনত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের আসে পরিবর্তন। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ. কে. ফজলুল হকের মতো নেতারা হাল ধরেন মুসলিম লীগের। ফজলুল হক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন মুসলমানদের দাবির প্রতি উপেক্ষা করা হলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ রদ করে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের শান্ত করতে পারলেও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অসন্তোষ ব্রিটিশদের আরেক সমস্যায় ফেলে। বাংলা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া বাংলার মুসলমানদের কোনো প্রভাবই ফেলেনি। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করেন এবং মুসলিম নেতার সাথে বৈঠক করেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেন নতুন প্রশাসনে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। একইসাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। ড. রাসবিহারী ঘোষসহ বেশ কজন হিন্দু নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কার্জন হল, বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন; Source: Wikimedia Commons
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসা নেতারা হিন্দুদের বিরোধীতার বদলে ঐক্যের চেষ্টা চালান। ফলে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দও তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৯১৩ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতের জন্য স্বরাজ দাবি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম লীগের নেতা হবার পরেও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯১৪ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন কংগ্রেসের শ্রীমতি নাইডু। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একসাথে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ‘লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের হারানো ঐক্য আবারো ফিরে আসতে থাকে এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ভারতে। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রমাণ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক রূপ ছিল উগ্রবাদী একটি শ্রেণীর নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।

লক্ষ্ণৌ প্যাক্টের উপস্থিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের একাংশ; Source: Pinterest

শুরুতে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ ব্রিটিশরা নিয়েছিল প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাকে ভাগ করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও যুক্ত হয়। পশ্চিম বাংলার ব্যাপক বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের আন্দোলন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু-মুসলিম উভয়ই উপকৃত হয় এর ফলে। কিন্তু একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারকে হার মানতে হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কাছে। অবশ্য হার মানলেও দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করে পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষেই কাজে লাগায় তারা। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে যে দাগ পড়েছিল সেটি আর কখনোই মুছে যায়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় কিছুদিন ঐক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্য টেকেনি বেশিদিন। ফলে ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় আর দুই বাংলাকে এক রাখা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাকে ভাগ করা নিয়েই ঘটে গেছে কত কিছু!
তথ্যসূত্র

১. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মুনতাসির মামুন

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-১৯৭১), ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন

৩. Bengal Electoral Politics and Freedom Struggle 1832-1947, Gautum Chattopadhyay

৪. The New Province of Eastern Bengal and Assam, M. K. U. Molla

৫. The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar

৬. From Plassey to Partition – A History of Modern India (2004), Sekhar Bandyopadhyay

43
By Rasel Ahmed
১.

গ্রেট ইনিংস কাকে বলে? এই সংজ্ঞাটি একেকজনের চোখে একেক রকম। কারো চোখে সেঞ্চুরি করাটা গ্রেট ইনিংস, আবার কারো চোখে প্রয়োজনের সময় ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেট।

‘বড় উপলক্ষ, প্রতিপক্ষ বড় দল, উইকেট হারিয়ে দল খাদের কিনারে, জেতার সম্ভাবনা খুবই কম’- এমন অবস্থা থেকে কেউ যদি মোটামুটি একাই দলকে রক্ষা করেন, তাহলে ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেটের মর্যাদা পাবে। বলাই বাহুল্য, এমন ইনিংস এক জীবনে খুব বেশি খেলা সম্ভব নয়। খুব ভালো ব্যাটসম্যান হলে হয়তো হাতে গোনা ৫/৬টি। তার চেয়ে বড় কথা, এই ধরনের ইনিংস কেউ একই টুর্নামেন্টে একবারের বেশি খেলতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনো খেলোয়াড় যদি এক টুর্নামেন্টেই এরকম একাধিক ইনিংস খেলেন, তাহলে ইতিহাসে তাকে একটু আলাদা জায়গা দিতেই হয়। আর সেই টুর্নামেন্টটা যদি বিশ্বকাপের মতো বড় হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

ব্যাটিং এ বিধ্বংসী ক্লুজনার; source: ESPNcricinfo

এমনই পারফর্মেন্স করে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে অমর হয়ে আছেন ল্যান্স ক্লুজনার। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে ১৪০.৫০ গড়ে আর ১২২ স্ট্রাইক রেটে তিনি রান করেছেন ২৮১। বোলিংয়ে ২০.৫৮ গড়ে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। টুর্নামেন্টে পেয়েছেন ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার। কিন্তু পরিসংখ্যানের সাধ্য কী সব কিছু বোঝানোর। যদিও ‘ব্যাটিংয়ে ৪১.১০ গড় আর ৮৯.৯১ স্ট্রাইক রেটে ৩,৫৭৬ রান এবং বোলিংয়ে ১৭১ ম্যাচে ১৯২ উইকেট’ পরিসংখ্যান বিবেচনাতেও একজন অলরাউন্ডারের জন্য যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স।

ওয়ানডেতে একই ম্যাচে বোলিং এবং ব্যাটিং ওপেন করেছেন এমন গুটিকয়েক ক্রিকেটারের মাঝে ক্লুজনার একজন। দলের প্রয়োজনে ১ থেকে ১০ নম্বর পজিশন পর্যন্ত ব্যাট করেছেন। ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডারের খুব সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও তার নাম আসবে।

বোলিংয়েও ছিলেন প্রতিপক্ষের ভয়ের কারণ; source: ICC Cricket

অথচ জাতীয় দলে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। ১৯৯৬/৯৭ সালের কলকাতা টেস্টের শুরুটা তার জন্য সুখকর হয়নি। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন তার ১ ওভারেই ৫টি চার মারেন। শেষ পর্যন্ত সেই ইনিংসে কোনো উইকেট পাননি ক্লুজনার। পরের ইনিংসে অবশ্য দুঃখটা ভুলে যান তিনি, ৮টি উইকেট তুলে নেন মাত্র ৬১ রানের বিনিময়ে। অভিষেকেই ১ ইনিংসে ৮টির বেশি উইকেট এখন পর্যন্ত কেউ নিতে পারেননি।

পরবর্তীতে টেস্টে ১৭৪ রানের ইনিংসও আছে তার ক্যারিয়ারে, টেস্ট সেঞ্চুরি আছে ৪টি। কিন্তু ক্লুজনার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বকাপের জন্যই। কী করেছিলেন ক্লুজনার সেই বিশ্বকাপে? একটু ঘুরে আসা যাক সেসময়ে।
২.

সময়টা ১৯৯৯ সাল, ইংল্যান্ডের মাঠে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা টপ ফেভারিট হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। টুর্নামেন্টের বাকি দুই ফেভারিট ছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা সহজেই জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এর মাঝেও ক্লুজনার তার ফর্মের একটা ঝলক দেখান। ৪ বলের ইনিংসে পরপর ৩টি চার মেরে ম্যাচ শেষ করে ফিরেন।

টেস্টেও কার্যকরী ছিলেন ক্লুজনার; source: Devid Munden/Popperfoto/Getty Images

গ্রুপের পরবর্তী ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার সাথে। সেই ম্যাচে মুরালির ঘূর্ণিতে ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে আফ্রিকা। সেখান থেকে ক্লুজনার দলকে ম্যাচে ফেরান ৪৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে। শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ডকে নিয়ে ৩৩ রানের একটি জুটি করেন, যার মাঝে ডোনাল্ডের অবদান ছিল মাত্র ৩ রান। লো স্কোরিং ম্যাচে বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে আফ্রিকাকে জিতিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।

পরের ম্যাচেও একই দৃশ্য। ইংল্যান্ডের সাথে ১৪৮ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ২০০ রানের কমে অল আউট হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮ রান করে পথ হারানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার পথ দেখান ক্লুজনার। দল পায় ২২৫ রানের মাঝারি একটি পুঁজি। পরে বোলিংয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।

কেনিয়ার সাথে পরের ম্যাচেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনি। এবার অবশ্য ব্যাটিং করতে হয়নি, বল হাতেই তুলে নেন ৫ উইকেট। জিম্বাবুয়ের সাথে পরের ম্যাচে বোলিংয়ে পান ১ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ক্লুজনার ৫২ রান করে অপরাজিত থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ হারে।

তবে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপের অন্যতম টপ ফেভারিট পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় সুপার সিক্স পর্বে। সেই ম্যাচে ২২০ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ ছিল দুর্দান্ত, দুইশ’রও বেশি রান করে তারা হারবে, এটা ভাবাই যেত না। ওয়াসিম, সাকলাইন, শোয়েব এর সাথে আজহার মাহমুদ আর আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু অমন বোলিংকেও ছিন্ন-ভিন্ন করে ম্যাচ বের করে নেন সেই একজন, ল্যান্স ক্লুজনার। ৪১ বলে ৪৬ রান করে অপরাজিত থাকার পথে ওয়াসিম আর শোয়েবকে দুটি বিশাল ছয় মারেন তিনি। সাথে বোলিংয়ে ১টি উইকেট পাওয়ায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ আবারও ক্লুজনার।

নিজের বলেই ক্যাচ ধরছেন ক্লুজনার; source: pinsdaddy

পরের ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে, সেটাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সেভাবে বিপদে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সুপার সিক্সের ম্যাচেও ক্লুজনার ২১ বলে ৩৬ রান করেন। কিন্তু সেই ম্যাচে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার।

তবে মূল ম্যাচটা হয় অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেমিফাইনালে। মাত্র ২১৪ রানের টার্গেটে নেমে ৬১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লুজনার যখন মাঠে নামেন, তখন ১৭৫ রানে ৬ উইকেট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শেন ওয়ার্ন তখন তার জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে বোলিং করছেন। উইকেট নেই, আস্কিং রান রেট বাড়ছে- এমন অবস্থায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন পোলক, তখন রান ১৮৩। এরপর মার্ক বাউচার যখন আউট হলেন, তখন ক্লুজনার বুঝে গেলেন, যা করার তাকে একাই করতে হবে। ৪৯তম ওভারের ৪র্থ বলে ম্যাকগ্রাকে উড়িয়ে মারলেন। ক্যাচ হয়ে যেত, কিন্তু টানটান মুহূর্তের স্নায়ুচাপে পড়ে পল রেইফেল মিস করে সেটিকে ছয় বানিয়ে দিলেন। গোটা ম্যাচের অনেক চড়াই-উৎড়াইয়ের পরে শেষ ওভারে দরকার হয় ৯ রান, হাতে তখন উইকেট ১ টি।

স্ট্রাইকে ক্লুজনার থাকায় সেই পরিস্থিতি সামলানোর সম্ভাবনা তখনও বেশ ভালোভাবেই ছিল। ফ্লেমিংয়ের প্রথম বলেই একটা চার মারলেন তিনি, আর দরকার ৫ বলে ৫। দ্বিতীয় বলে আরেকটা চার মারলেন। মাঠে থাকা সব অস্ট্রেলিয়ানরা মুখে হাত দিয়ে নিশ্চুপ। আর মাত্র একটি রান, তাহলেই বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ডোনাল্ড নিজের ভুলে রান আউট হয়ে গেলেন। ক্লুজনার ১৬ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকার পরেও ম্যাচ টাই হলো। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, আগের মুখোমুখি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী থাকার কারণে টাই হওয়ার পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ট্রাজিক হিরো হিসেবে সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে নেন ক্লুজনার।

ঠিক এই মুহূর্তটাই বদলে দিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য; © PA Photos
ম্যাচের হাইলাইটস

৩.

ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্লুজনার সবসময়ই বিধংসী ছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতে শুন্য রান করে আউট হলেও ৩য় ম্যাচেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৮৮ রানের একটি ইনিংস খেলেন। তবে সবাই প্রথম ক্লুজনারের জাত চেনে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত চার জাতির একটা টুর্নামেন্টে। এই টুর্নামেন্টের বাকি তিনটি দল ছিল পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কা। সেই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচে সেই সময়ের সর্বজয়ী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে ৯৯ রানের ইনিংস খেলেন ক্লুজনার।

আধুনিক টি-টুয়েন্টি যুগে তিনি একজন অসাধারণ কার্যকরী খেলোয়াড় হতেন, সেটি না বললেও চলে। তার ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ার সেই সাক্ষ্যই দেয়। ২০০০ সালে উইজডেনের নির্বাচিত বছরের সেরা ৫ ক্রিকেটারের একজন হন এই অলরাউন্ডার।

অবসর পরবর্তীতে শচীনের দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার একটি মূহুর্ত; source: Bob Levey/Getty Images

ইনজুরির জন্য ক্যারিয়ারের শেষভাগটা মনের মতো হয়নি। ২০০৪ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গিয়েছেন ২০১০ সাল পর্যন্ত। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট যতদিন থাকবে, ক্লুজনারের কীর্তির কথা মানুষ সবসময়ই স্মরণ করবেন।

44
By MS Islam

চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিস্ময়কর অগ্রগতি তা মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীববিজ্ঞানের হাত ধরেই এসেছে। অথচ এই অণুজীববিজ্ঞান যার হাত ধরে এসেছে সেই লিউয়েনহুককে কয়জন স্মরণ করেন আজ? যিনি ব্যাকটেরিয়া, স্পার্মাটোজোয়া, এককোষী জীবসহ আরো অনেক মৌলিক আবিষ্কার করে গেছেন তাকে নিয়ে আলোচনার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এই মহান জীববিজ্ঞানীকেই আজ স্মরণ করা যাক তবে।

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক; image source: todayinsci.com
শৈশব

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর নেদারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডেলফটের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফিলিপ অ্যান্টনিজ ভন লিউয়েনহুক ছিলেন একজন সামান্য ঝুড়ি প্রস্তুতকারক। এই ঝুড়ি তৈরিতে সাহায্য করতেন তার স্ত্রী মার্গারেটা ডেল ভন ডেন বার্খ। তবে এই ঝুড়ি তৈরিও বেশিদিন চললো না। শিশু লিউয়েনহুকের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে দিতেই যেন পরকালে পাড়ি জমালেন তার বাবা।

পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারানোয় শিশু লিউয়েনহুকের ভবিষ্যৎ এক ঘোর সংকটের মধ্যে পড়ে। ফিলিপের মৃত্যুর কিছুদিন পরই লিউয়েনহুকের মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎবাবাকে শিশু হুক কখনোই বাবা হিসেবে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি চলে গেলেন তার চাচার কাছে, যিনি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। সেখানে তিনি অল্পবিস্তর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভাগ্য তার নেহায়েত মন্দই বলা চলে। তিনি ডাচ ছাড়া আর কোনো ভাষা শিখতে পারেননি। আর তখনকার সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা অতীব জরুরি বিষয় ছিল। এর উপর তার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন তার সৎবাবাও মারা গেলে মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব তার কাঁধে পড়ে। অগত্যা জীবিকার্জনে নেমে পড়তে হলো কিশোর হুককে।
আমস্টারডামে হুক

যে বছর সৎবাবা মারা গেলেন, সে বছরই জন্মস্থান ডেলফট ছেড়ে বিখ্যাত বাণিজ্যিক শহর আমস্টারডামে পাড়ি জমান লিউয়েনহুক। সেখানে তিনি একটি টেক্সটাইল বিপণিতে কাজ করা শুরু করেন। দ্রুতই তিনি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন এবং এজন্য তাকে ক্যাশিয়ার পদে উন্নীত করা হয়। ১৬৫৪ সালে তিনি এই টেক্সটাইল বিপণিতে কাজ ছেড়ে দেন এবং ডেলফট ফিরে যান। আর এই ফিরে যাওয়াই তার প্রথম এবং শেষ ফিরে যাওয়া। কারণ বাকি জীবনটা তিনি ডেলফটেই কাটিয়ে দেন।

হুক ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কর্নেলিয়া; image source: brookstonbeerbulletin.com

আমস্টারডাম থেকে রপ্ত করা ব্যবসায়িক দক্ষতা কাজে লাগালেন লিউয়েনহুক। তিনি নিজ শহর ডেলফটে নিজের টেক্সটাইল বিপণি খুলে বসলেন। কাপড় ছাড়াও তিনি বোতাম, চেইন, ফিতাসহ আরো অনেক আনুষঙ্গিক জিনিস বিক্রয় শুরু করেন। একই বছর বারবারা ডি মে-কে বিয়ে করেন হুক। বারবারার সাথে ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি ৫ সন্তানের পিতা হন, যাদের মধ্যে কেবল এক মেয়ে মেরিই বেঁচে ছিল। বাকিরা শৈশবেই মারা যায়। ১৬৬৬ সালে যখন বারবারা মারা যান, তখন হুক কর্নেলিয়াকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার আর কোনো সন্তান হয়নি। ১৬৯৩ সালে কর্নেলিয়া মারা গেলে বাকি জীবনটা একাই কাটিয়েছিলেন হুক।

এবার হুকের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করলো। তার টেক্সটাইল ব্যবসা সফল হলো। কালক্রমে তিনি ডেলফটের বেশ প্রভাবশালী এবং পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। ডেলফট কাউন্সিলের ‘মিটিং হল’ পরিচালনার সম্মানজনক দায়িত্ব তাকে দেয়া হলো। এই চাকরি থেকে তিনি বেশ ভালো বেতন পেতেন। এর বাইরেও তিনি ডেলফটের ওয়াইন ব্যবসায়ী সমিতির সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যার কাজ ছিল আমদানিকৃত ওয়াইনের উপর কর বসানো।

এভাবে ব্যবসায়িক কাজকর্ম আর শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েই লিউয়েনহুকের জীবনের ৪০ বছর কেটে যায় কোনোরকম  বৈজ্ঞানিক কাজ ছাড়াই। একটু খটকা লাগছে কি পাঠক? কোনো বিজ্ঞানীর জীবনী পড়তে গিয়ে ভুল করে কার জীবনী পড়ছেন? যে ব্যক্তি প্রাথমিক শিক্ষার পরই আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি, ব্যবসা বাণিজ্য আর শহুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ তদারকি করাই যার কাজ, তিনি ব্যক্তি আবার জীববিজ্ঞানী হন কী করে?
বিজ্ঞানী হবার পথে যাত্রা গ্লাস: পার্ল ও মাইক্রোগ্রাফিয়া

লিউয়েনহুকের বৈজ্ঞানিক সাফল্য অনেকাংশেই তার উচ্চ ক্ষমতার লেন্স তৈরির উপর ভিত্তি করে। তবে তার এই লেন্স তৈরির ব্যাপারটি বেশ মজাদার। কেননা তিনি আমৃত্যু তার লেন্স তৈরির প্রকৃত উপায়টি কাউকে বলে যাননি। বললে যদি তার প্রতিযোগীরা তার চেয়ে এগিয়ে যায়! আরো মজার ব্যাপার হলো তিনি লেন্স তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে একবার একটি পদ্ধতির কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনেকেই লেন্স তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে জানা যায় হুকের বর্ণিত সেই পদ্ধতিটি একেবারেই বানোয়াট, যা হুক তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বোকা বানানোর জন্যই প্রকাশ করেছিলেন!

গ্লাস পার্ল; image source: cousindiy.com

তখনকার সময়ে পোশাক শিল্পে ‘গ্লাস পার্ল’ নামক একপ্রকার সাধারণ কাঁচের লেন্স ব্যবহার করা হতো যার সাহায্যে পোশাকের গুণগত মান সহজে নির্ধারণ করা যেতো। হুক সেসব গ্লাস পার্ল নিয়ে কিছুদিন গবেষণা করেন এবং কিছুটা উন্নতি করতে সক্ষম হন। ধারণা করা হয়, এই কাজের সময়ই হুক লেন্স তৈরির প্রতি আগ্রহী হন। অন্যদিকে ১৬৬৮ সালে লিউয়েনহুক ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। তখন পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে রবার্ট হুকের ‘মাইক্রোগ্রাফিয়া’ (১৬৬৫) বইটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। মাইক্রোগ্রাফিয়াকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া কয়েকটি বইয়ের একটি ধরা হয়। লিউয়েনহুক এই বইয়ের এক কপি নিয়ে দেশে ফিরলেন। যেহেতু হুকের ইংরেজি ভাষায় দখল ছিল না বললেই চলে, তাই তিনি মাইক্রোগ্রাফিয়া আদতে কতটুকু পড়তে পেরেছিলেন তা ভাববার বিষয়। তবে এই বইটি তার উপকারে লেগেছিল এর মধ্যে রবার্ট হুকের আঁকা চিত্রগুলোর জন্য।
লেন্স তৈরি

লিউয়েনহুকের গোলক লেন্স; image source: coreknowledge.org.uk

যদিও লিউয়েনহুক আমৃত্যু নিজের লেন্স তৈরির পদ্ধতি গোপন রেখেছিলেন, তথাপি আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগে উদ্ভাবকরা তার লেন্স তৈরির পদ্ধতি উন্মোচন করে ফেলেছেন। হুক আজীবন ছোট গোলকাকার লেন্স ব্যবহার করেছেন। এই লেন্স তৈরির জন্য তিনি প্রথমেই একটি কাঁচের দন্ডের ঠিক মধ্যভাগ উত্তপ্ত করতেন। যখন কাঁচ নরম হয়ে গলতে শুরু করতো তিনি ধীরে ধীরে দন্ডটির দুই প্রান্ত পরস্পর বিপরীত দিকে টেনে গলিত কাঁচের লম্বা চিকন সুতা তৈরি করতেন। তিনি ততক্ষণ দন্ডের দুই প্রান্ত প্রসারিত করতেন যতক্ষণ না চিকন হতে হতে কাঁচের দন্ডটি মাঝখান থেকে ভেঙে যেত বা (গলিত কাঁচের সুতা) ছিঁড়ে যেতো। এরপর সেই সুতার চিকন অগ্রভাগ আবার আগুনের শিখার উপর ধরলে ঐ সুতার অগ্রভাগে ক্ষুদ্র কাঁচের গোলক সৃষ্টি হয়। গোলকটি যত ছোট হতো, এর বিবর্ধন ক্ষমতা তত বেশি হতো। প্রাথমিকভাবে এই লেন্স তিনি তার টেক্সটাইল ব্যবসার উদ্দেশ্যে তৈরি করছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে (সম্ভবত মাইক্রোগ্রাফিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে) তিনি এই লেন্স দিয়ে প্রাণ প্রকৃতিকে আরো কাছে থেকে দেখার প্রতি আকৃষ্ট হন।
লিউয়েনহুকের মাইক্রোস্কোপ

লিউয়েনহুকের মাইক্রোস্কোপ; image: ScienceBlogs.com

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুকের কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ যেখানে ৪০ থেকে ৫০ গুণ বিবর্ধনে সক্ষম ছিল, সেখানে লিউয়েনহুকের তৈরি ছোট গোলক লেন্স দিয়ে তৈরি মাইক্রোস্কোপ প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বিবর্ধনে সক্ষম ছিল! তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে এই মাইক্রোস্কোপ ছিল অস্বাভাবিকভাবে অগ্রসর, যা দিয়ে ১.৩৫ মাইক্রোমিটার আকারের ক্ষুদ্র বস্তুও দেখা যেত স্পষ্ট, যেখানে মানুষের দেহের রক্তকণিকার আকৃতি ৬-৮ মাইক্রোমিটার! তার এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি সর্বদাই একক লেন্সের ছিল। একাধিক লেন্স ব্যবহারের কথা হুক কখনো ভাবতেই পারেননি।
হুকের অনুপম নমুনা বিশ্লেষণ

লিউয়েনহুক তার জীবনে ৫০০ এর অধিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এগুলোর কোনোটিই আজকের মাইক্রোস্কোপের সাথে তুলনীয় নয়। তথাপি আমাদের জন্য আরেকটি বিস্ময় জাগানো ব্যাপার হচ্ছে তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আলোক সৃষ্টির কোনো উৎস নেই। অথচ এই মাইক্রোস্কোপের দ্বারা তিনি মানবজগতের কাছে উন্মোচিত করেছেন অণুজীবদের এক অচেনা, অজানা, বিশাল জগত!

নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে লিউয়েনহুক এতটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন যে তার মৃত্যুর প্রায় একশ বছর পর্যন্ত আর কোনো জীববিজ্ঞানী এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করেননি। এক ফোঁটা রক্ত কিংবা ডোবার জল, ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের নিখুঁতভাবে কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পেশি আর গাছগাছালির ছাল। এসব নমুনা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে স্থাপন করার আগে তিনি এগুলো এত সূক্ষ্মভাবে কাটতেন যে এগুলোর মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করতে পারতো। ফলে এদের ভেতরের গঠনও স্পষ্টভাবে ভেসে উঠতো তার চোখে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হুক তার জীবনে বিজ্ঞান বিষয়ক পড়ালেখাও খুব একটা করেননি। তথাপি তার অর্জন অভাবনীয়। তার পর্যবেক্ষণ এতটাই মানসম্মত ছিল যে তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজ সেগুলো নিয়ে কোনোরকম প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি। তিনি পত্র মারফত নিজের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও চিত্র লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে প্রেরণ করতেন এবং রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা সেগুলো দেখে বিস্ময়ে বিস্ময়াভিভূত হতেন। রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশনস’-এ সেগুলো প্রকাশিত হতো।
এককোষী জীব

হুকের এককোষী জীব পর্যবেক্ষণ; image source: timetoast.com

জীববিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাস। যারা শ্রেণিবিন্যাস পড়েছেন, তারা অবশ্যই প্রটিস্টা জগতের অন্তর্ভুক্ত এককোষী জীব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এই এককোষী জীবের বিশাল জগত যার হাত ধরে উন্মোচিত হয়, তিনিই লিউয়েনহুক। ১৬৭৪ সালে হুকের এই আবিষ্কারকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে গণ্য করা হয়। তবে প্রাথমিকভাবে জীববিজ্ঞানীদের অনেকেই তার এই আবিষ্কার অস্বীকার করেন। ৩ বছর পর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক সেগুলো যাচাই করার পরই লিউয়েনহুকের আবিষ্কার স্বীকৃত হয়।
লোহিত রক্তকণিকা

লোহিত রক্তকণিকার আবিষ্কারক হিসেবে লিউয়েনহুকের নাম স্মরণ করে থাকেন অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু লোহিত রক্তকণিকা আসলে আবিষ্কার করেন জেন সোয়ামার্ডাম। ১৬৬৮ সালে সোয়ামার্ডামের লোহিত রক্তকণিকা আবিষ্কারের ছয় বছর পর ১৬৭৪ সালে লোহিত রক্তকণিকা পর্যবেক্ষণ করেন লিউয়েনহুক। কিন্তু সোয়ামার্ডামের চেয়ে হুকের পর্যবেক্ষণ ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট এবং বর্ণনা অধিক তথ্যবহুল। তবে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে লোহিত রক্তকণিকার আকৃতি সঠিকভাবে বর্ণনা করেন।
ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া; image source: NetDoctor.com

১৬৭৬ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তিনি ডোবার পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। ব্যাকটেরিয়া এতই ক্ষুদ্র যে তা খালি চোখে দেখা যায় না। তিনি অনুমান করলেন যে একটি বালুর কণার সমআয়তন জায়গা পূরণ করতে ১০ হাজারের অধিক ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন হবে।
আরো কিছু আবিষ্কার

১৬৭৭ সালে লিউয়েনহুক আবিষ্কার করেন স্পার্মাটোজোয়া তথা শুক্রাণু। এই আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন যে শুক্রাণু যখন ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে, তখনই নিষেক ঘটে। ১৬৮৩ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। তিনি একপ্রকার সাদা তরল বিশিষ্ট সূক্ষ্ম কৈশিক নালী আবিষ্কার করেন, যাকে আমরা এখন লসিকানালী বলে চিনি।

স্পার্ম বা শুক্রাণু; image source: austinvasectomycenter.com

এসবের বাইরেও তিনি শূককীট এবং মাছির জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেন। পার্থেনোজেনেসিস পর্যবেক্ষণকারী প্রথম ব্যক্তিও লিউয়েনহুক। এমনকি উইলিয়াম হার্ভের আবিষ্কৃত রক্ত সঞ্চালন নিয়েও তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। লসিকানালী দিয়ে লসিকার প্রবাহ লক্ষ্য করে তিনি হার্ভের পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে সিদ্ধান্ত জানান।
মৃত্যু

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ২৬ আগস্ট, ১৭২৩ সালে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ডেলফটের ‘ওল্ড চার্চ’ কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

লিউয়েনহুকের জীবন ছিল চক্রাকার। একটি বিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহ্যের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়ালেখাই করতে পারেননি। অর্জন হয়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। অথচ মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীববিজ্ঞানী, যিনি অনেকগুলো মৌলিক আবিষ্কার করে গেছেন। রবার্ট হুকের কোষ আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় লিউয়েনহুকের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড বিজ্ঞানের এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়ে যায়, যার নাম ‘মাইক্রোবায়োলজি’ বা অণুজীববিজ্ঞান। তাই মাইক্রোবায়োলজির জনক হিসেবে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।

45
By Shamsun Nahar

    “লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
    কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
    ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
    আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার”

এই গান শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। গানের রচয়িতা মরমী কবি এবং বাউল হাসন রাজা। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বলে। এই মানবতা সাধনার একটি রুপ হলো মরমী সাধনা। যে সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। এক সময়কার প্রতাপশালী অত্যাচারী জমিদার হাসন কীভাবে একজন দরদী জমিদার এবং মরমিয়া কবি ও বাউল সাধক হলেন, চলুন শুনে নেই সেই কাহিনী।

সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া  গ্রামে এই মরমিয়া কবির জন্ম। ৭ পৌষ ১২৬১ ও ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে (ইংরেজী সাল অনুযায়ী) দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবির ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় হাসনের। হুরমত বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা। পরবর্তীতে হাসন রাজার পিতা আলী রাজা তাকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র।

হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের  যশোর জেলা হয়ে সিলেতে এসে থিতু হন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, হাসনের অনেক কবিতা ও গানে পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মিলবন্ধন পাওয়া যায়। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারীতে অভিষিক্ত হন।

‘হাসন রাজা’ সিনেমায় বামে হেলাল খান (হাসন রাজা) এবং শমি কায়সার

হাসন বেশ সুপুরুষ দর্শন ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তখন সিলেটে ঘরে ঘরে আরবী ও ফার্সির প্রবল চর্চা চলত।

হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। সেই গানের মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং নিজের কৃত কর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার!

হাসন রাজার ব্যবহৃত একটি বাংলো

হাছন রাজা পশু পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। ঘোড়াও পুষতেন হাসন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার একটি হলো জং বাহাদুর, আরেকটি চান্দমুশকি। এরকম আরো ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া গেছে। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন।

হাসন রাজার ব্যবহৃত পোশাক

পশু পাখির যত্ন ও লালন পালনের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন হাসনের পশু প্রেম কতটা তীব্র। ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন আসাম এবং সিলেট এলাকায় ৮.৮ রিখটার স্কেলের এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে মানুষসহ অনেক পশুপাখি প্রাণ হারায়। হাসনের নিজেরে কুড়ে ঘরটিও ভেঙ্গে যায়। পরে এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন তাঁর অনেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাসনের প্রাণপ্রিয় অনেক পশু পাখির মৃত্যু তাঁর মনে জীবন সম্পর্কে কঠিন বৈরাগ্যের সূচনা করে।

হাসন রাজার ব্যবহৃত একটি ঢোল

হাসন রাজার এই কালো অধ্যায়ের ইতি ঘটে বেশ অলৌকিক ভাবেই। লোক মুখে শোনা যায়- একদিন তিনি একটি আধ্যাত্নিক স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন। জীবনযাত্রায় আনলেন বিপুল পরিবর্তন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজ খবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করলেন। সেই সাথে চলতে লাগলো গান রচনা।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত ২০৬টি নিয়ে গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয ছিল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী।

হাসন রাজা জাদুঘরের একাংশ

‘হাসন বাহার’ নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যা-ই হোক, আমরা হয়তো দূর্ভাগ্যবান। তা না হলে হাসন রাজার আরো কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টির সাক্ষী হতে পারতাম। হাসন রাজা তার গানের মধ্যে গভীর জীবন দর্শন ও আত্মোপলব্ধি প্রকাশ পায়। যখন তিনি তার ভোগ বিলাস ছেড়ে দিলেন, তখনকার রচিত একটি গানের অংশবিশেষ,

“গুড্ডি উড়াইল মোরে,মৌলার হাতের ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।।
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।”

আরেকটি কবিতায় দেখা যায়, হাসন গৌতম বুদ্ধের মতোই বলেন-

“স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল।
কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল”

জাগতিক দুই চোখ দিয়ে বাস্তব জগত দেখা যায়। তৃতীয় নয়ন বা মানশ্চক্ষ দিয়ে মানুষ জীবন জগত এবং স্রষ্টার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে। যেমনটা দেখা যায় হাসনের আরেকটি কবিতায়-

“আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।”

হাসন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তাঁর গানের পূর্বপুরুষের ধর্ম, হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রেমও লক্ষণীয়। যেমন –

“আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে”

আবার পাশাপাশি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় –

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।”

বাউলা কে বানাইলো রে হাসন রাজারে…… হাসন রাজার ব্যবহৃত একতারা

হাসন দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে Indian Philosophical Congress এ  বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।” এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে `হিবার্ট লেকচারে` রবীন্দ্রনাথ `The Religion of Man` নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণ

সিলেটের জিন্দাবাজারে হাসন রাজা জাদুঘর

হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এছাড়াও, সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তার এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পূর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।

তথ্যসূত্র

১) হাসন রাজা

২) হাসন রাজা, দেওয়ান

৩) somewhereinblog.net/blog/mahalderblog/28900039

৪) poemhunter.com/hason-raja/biography/

Pages: 1 2 [3] 4 5 ... 11